শক্তিপদ রাজগুরু
চলচ্চিত্রপ্রেমী বাঙালির কাছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘অমানুষ’ এবং ‘অনুসন্ধান’ অত্যন্ত পরিচিত নাম। যাঁরা ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখেছেন, তাঁদের অনেকেই দর্শকাসনে বসে ছলছল চোখে স্বগতোক্তি করেছেন—‘যদি এমনটা না হতো!’ শেষ দৃশ্যে নীতা যখন দাদা শঙ্করের কাছে বলেছে, ‘দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম, দাদা আমি বাঁচতে চাই’। সিনেমার অন্তিম দৃশ্যে সেই আর্তি পাহাড়ের সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। দেশভাগের প্রেক্ষিতে উদ্বাস্তু মানুষের জীবনকাহিনি নিয়ে নির্মিত ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্রের কাহিনি রচনা করেছিলেন কথাকার শক্তিপদ রাজগুরু। চিত্রনাট্যও তিনিই রচনা করেছিলেন। শক্তিপদ নিজেই জানিয়েছেন, তিনি ‘উদ্বাস্তু’ ছিলেন না। এ পার বাংলায় বাঁকুড়া জেলায় তাঁদের পুরুষানুক্রমিক বসবাস। কিন্তু মানুষের শিকড় ছিন্ন হওয়ার বেদনা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ভিন্ন প্রেক্ষিতে। তাঁর বাল্যকাল কেটেছিল মুর্শিদাবাদ জেলার পাঁচথুপি গ্রামে। বাবার চাকরিসূত্রে বাল্যের শিকড়ভূমি এই গ্রামে বন্ধু-বান্ধব, খেলার সঙ্গী, নদীনালা, খাল-বিলের স্মৃতিমেদুর ক্রীড়াভূমি ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল কলকাতায়।
অন্য দিকে, তিনি দেখেছিলেন স্বাধীনতার পরেই কেমন করে কাতারে কাতারে মানুষ ও পার বাংলা থেকে শিকড় ছিন্ন করে বাধ্য হয়ে এ পারে চলে আসছেন। এক দিকে, তাঁদের পুরুষানুক্রমিক বসবাসের স্মৃতিমেদুর স্বভূমি ত্যাগের হাহাকার আর অন্য দিকে, এ দেশে এসে সহায়-সম্বলহীন হয়ে তীব্র দারিদ্রের মুখোমুখি হওয়া— এই হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন শক্তিপদ। সেই ছিন্নমূল, বেদনার্ত পরিবারগুলির কাহিনি আছে এই ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ও আরও কয়েকটি উপন্যাস এবং ছোটগল্পে।
শক্তি সামন্ত পরিচালিত ‘অমানুষ’ অত্যন্ত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের কাহিনি রচনা করেছিলেন শক্তিপদ রাজগুরু। তাঁর লেখা ‘নয়া বসত’ উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বন করে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সেখানে দেখা যায় মধু নামে এক যুবক তার কাকার সঙ্গে থাকে। সে ভালবাসে স্থানীয় চিকিসৎক আনন্দবাবুর বোন লেখাকে। কিন্তু তার কাকার বাজার-সরকার মহিম ঘোষাল বিভিন্ন ভাবে তাকে বিপদে ফেলে তার কাকার সম্পত্তি হস্তগত করতে চায়। মধুর কাকার রহস্যজনক মৃত্যু হয় আবার মধুকে মিথ্যে মামলায় জেলে যেতে বাধ্য করে মহিম। এক পুলিশ অফিসারের দক্ষতায় ও বদান্যতায় মধু মিথ্যে মামলা থেকে ছাড়া পায় এবং কাকার সম্পত্তির মালিক হয়। এই চলচ্চিত্রে উত্তম কুমার, শর্মিলা ঠাকুর, উৎপল দত্ত, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করে।
শক্তি সামন্ত পরিচালিত ‘অনুসন্ধান’ চলচ্চিত্র জগতে বাণিজ্যিক ভাবে যথেষ্ট সফল। এর কাহিনিও রচনা করেছিলেন শক্তিপদ রাজগুরু। প্রেক্ষাপট উত্তরবঙ্গের কালিঝোড়া বনাঞ্চল। কালিঝোরা নামে ছোট একটি নদী এসে তিস্তায় মিশেছে। ‘অনুসন্ধান’ গল্পটির মূল আখ্যান খুব ছোট। এখানে বসবাসকারী এক দম্পতির সন্তানকে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে। এই দুর্বৃত্তের প্রধান ছিল কালীরাম। অপহৃত সন্তানের অন্ধ মা সন্তান অন্বেষণে গিয়ে দুর্বৃত্তদের কবলে পড়ে। এক বর্ষণমুখর রাতে এক যুবক তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের অন্বেষণে গিয়ে বিভিন্ন সংঘাত-সংঘর্ষের মাঝে পড়ে। দুর্গম পাহাড়ের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বনভূমির মাঝে অবস্থিত দুর্বৃত্তের ডেরা থেকে উদ্ধার হয় মা ও শিশু। এই বাংলা চলচ্চিত্রের হিন্দি রূপান্তর হয় সেই সময়েই। নাম হয় ‘বরসাত কি এক রাত’। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন, রাখী, আমজাদ খান প্রমুখ। এ ছাড়াও শক্তিপদর আরও বেশ কয়েকটি গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র হয়। যেমন ‘মুক্তিস্নান’, ‘শেষ নাগ’ প্রভৃতি।
১৯২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাঁকুড়া জেলার গোপবন্দী গ্রামে জন্মেছিলেন শক্তিপদ রাজগুরু। তাঁর বাবা ‘ডাক ও তার বিভাগে’ চাকরি করতেন। বাবার কর্মক্ষেত্র ছিল মুর্শিদাবাদের পাঁচথুপিতে। লেখাপড়ার সুবিধার জন্যে সেখানেই চলে আসেন শক্তিপদ। এখানেই তাঁর বাল্য ও কৈশোরকাল অতিবাহিত হয়। গ্রামটি বেশ প্রাচীন। এক সময়ে জৈন সম্প্রদায়ের লোকজন এই গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিল (পঞ্চম শতক)। সতেরো শতকের শেষ দিকে কায়স্থ কুলপতি সোম ঘোষের উত্তর পুরুষেরা জজান গ্রাম থেকে এই গ্রামে এসে বসবাস করতে শুরু করে। ফলে এই গ্রাম পুনরায় সমৃদ্ধ হতে থাকে। আঠারো শতকের প্রথমার্ধে দিল্লির বাদশা ঔরঙ্গজেবের গৃহশিক্ষকের বাস ছিল এই গ্রামে। সেই সময়ে ঔরঙ্গজেব শিক্ষাগুরু-দক্ষিণা স্বরূপ এই গ্রামে একটি সুদৃশ্য মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা স্থাপন করে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন কারণে এই গ্রাম ছিল ঐতিহাসিক ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক দিকে, এই গ্রামে ছিল ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের বনেদিয়ানা অন্য দিকে ছিল তাদের অহমিকা। গত শতকের তিরিশের দশকে যখন বালক শক্তিপদ এই গ্রামে আসে তখন এই গ্রাম শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ উন্নত ছিল। বর্ষায় এই গ্রামের চারপাশ জলবন্দি থাকত আর চারদিক সবুজে পরিপূর্ণ হয়ে যেত। শীতকালে এই গ্রামে মেলা হত। বাল্যসখা ন্যাড়া ছিল শক্তিপদর সর্বক্ষণের সঙ্গী। তার সঙ্গে মেলায় ঝুমুরগান শুনতে গিয়েছে; আবার বায়োস্কোপওয়ালার ছেঁড়া ফিল্ম নিয়ে ‘সিনেমা’ তৈরির চেষ্টা করেছে। মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়িয়েছে দু’জনে। পাখি ধরেছে, পুষেছে। গ্রামে বাউল-বোষ্টমদের গান হত। হত নানা কিসিমের গ্রাম্য খেলা। আমরা দেখতে পাব, শক্তিপদ পরবর্তী জীবনে কিশোরদের জন্যে ‘পটলা’ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। তাকে কেন্দ্র করে অনেক গল্প, অনেক রোমাঞ্চকর রূপকথা তিনি রচনা করেছেন। এই শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনার প্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা শিশু সারাজীবন বাস করে’। তাঁর মধ্যেও যে কিশোর আমৃত্যু বসবাস করেছে, তার রসদ সংগৃহিত হয়েছিল এই পাঁচথুপি গ্রামেই। আর সেই সংগ্রহের অন্যতম সঙ্গী ছিল ন্যাড়া। এই ন্যাড়ার এক প্রবর্ধিত রূপ হলো ‘পটলা’ বা পটল।
শক্তিপদ পাঁচথুপি গ্রামের ত্রৈলোক্যনাথ ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় চলে যান উচ্চ শিক্ষার জন্যে। তাঁর বাবা তখন চাকরি নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। শক্তিপদ কলকাতার মেসে থেকে লেখাপড়া করার সময় থেকেই সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। সেই সময়ে ‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রবাসী’, ‘দেশ’, ‘উল্টোরথ’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠান। কোথাও কোথাও তা প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে ‘আবর্তন’ গল্পটি প্রকাশিত হয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সান্নিধ্যে চলে আসেন তিনি। চাকরি করার সময়ে কলকাতার যে মেসে থাকতেন তার কিছুটা দূরেই থাকতেন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় এবং শৈলজানন্দ। শৈলজানন্দের আদি বাড়ি বীরভূম জেলায় নাকড়াকোন্দা গ্রামে আর ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের আদি বাড়ি সাঁইথিয়ার কাছে চাপড়া গ্রামে। এই গ্রাম দু’টি পাঁচথুপি থেকে বেশি দূরে নয়। ফলে আগে থেকেই তাঁদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন শক্তিপদ। ধীরে ধীরে লেখালেখির সূত্রে তিনি বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসতে থাকেন। লেখক জীবনের প্রথম পর্বেই চলচ্চিত্রের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। যে আকর্ষণ বাল্যকালে তৈরি করে দিয়েছিল পাঁচথুপি গ্রামের বালক ন্যাড়া।
লেখক কান্দি রাজ কলেজের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy