Sourced by the ABP
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এলিট’ তকমা ঘোচানোর জন্য, শিক্ষাঙ্গনটিকে এক হাত নেওয়ার জন্য আস্তিন গুটিয়ে ক্রমাগত গণছিছিক্কারের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন কিছু ছিদ্রান্বেষী। তাঁদের বিরুদ্ধে সময়োচিত তিরটি নিক্ষেপ করেছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় (‘মুক্ত চিন্তা’ই কি খলনায়ক?, ২৫-৮)। ছাত্রমৃত্যুর মর্মান্তিক বিষয়টিকে এক পাশে রেখে এখন ‘দাদারাজ’ যাদবপুরকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তারই হিসাবনিকাশ চলছে। মুক্ত চিন্তার পরিসরকে খর্ব করার জন্য চলছে ছিদ্রান্বেষীদের অন্বেষণ। এমনিতেই পরনিন্দা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় বিষয়। “পরনিন্দা সমাজের কণায় কণায় যদি মিশিয়া না থাকিত তবে নিশ্চয়ই একটা বড়ো রকমের অনর্থ ঘটিত। উহা লবণের মতো সমস্ত সংসারকে বিকার হইতে রক্ষা করিতেছে।... একটা ভালো কিছু লিখিলাম, তাহার নিন্দুক কেহ নাই, ভালো গ্রন্থর পক্ষে এমন মর্মান্তিক অনাদর কী হইতে পারে!... মহত্বকে পদে পদে নিন্দার কাঁটা মাড়াইয়া চলিতে হয়। ইহাতে যে হার মানে বীরের সদ্গতি সে লাভ করে না” (‘পরনিন্দা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। সুতরাং, ‘ভাল র্যাঙ্কিং, ভাল পরিকাঠামো, পরীক্ষায় সাফল্য’ যে প্রতিষ্ঠানকে ‘এলিট’ করেছে, তাকে একটা ছুতোয় নিন্দা করতে পারলে নজর কাড়া যায় বলে কি যে ছেলেটিকে অকালে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে না-ফেরার দেশে চলে যেতে হল, তা মেনে নেওয়া যায়?
র্যাগিং-সংস্কৃতি তো সদ্যোজাত নয়! যাঁরা বর্তমানে প্রাক্তনী, লব্ধপ্রতিষ্ঠ, তাঁরাও কমবেশি এই যাত্রার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁরা সমব্যথী হবেন ওই মৃত ছাত্রটির হতভাগ্যের কারণে। কিন্তু, তাঁরাও কি পেরেছিলেন এই তথাকথিত রোগটির বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ করতে?
একটি উচ্চমার্গীয় ‘মুক্ত চিন্তা’র ধারক-বাহক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিতে তৎপর র্যাগিং-করিয়েরা মনোরোগী কি না, সে বিষয়ে মনোবিদরা বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। কিন্তু, যাদবপুরে পড়লেই ‘অহংদীপ্ত গজদন্তমিনার’-এ পরিণত হওয়া কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষের পরিচায়ক? যখন র্যাগিং নিয়ে গণরোষ চরমে, তখনও সমাজমাধ্যমে ভাববাচ্যে ‘এক বার চান্স পেয়ে দেখা’ পোস্টও হরবখত দেখা গেছে। যাদবপুরের পড়ুয়া বলেই কি শার্টের কলার ওঠানো দাদাগিরি? এলিট-এর সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের যে ব্যবধান তৈরি হচ্ছে, সেটাও সম্মুখে আসে। মেধা যাদের দুর্বিনীত হওয়ার শিক্ষা দেয়, অপরকে নিগ্রহের মাধ্যমে অবদমিত কামনা-বাসনা পূরণের লক্ষে ধাবিত করে, তাদের ধিক। ‘হোক কলরব’ ইতিহাস হয়ে যায়নি! তবে কেন র্যাগিং প্রতিরোধে ‘মুক্ত চিন্তা’ উপ্ত হবে না?
ধ্রুবজ্যোতি বাগচি, কলকাতা-১২৫
কর্মশিক্ষা
শিক্ষাব্যবস্থায় খুঁজে পাওয়ার চেয়ে, খুঁজে পাওয়ার প্রেরণা তৈরি করা জরুরি। গান্ধীজি প্রবর্তিত বনিয়াদি শিক্ষা ভাবনার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বপন করা হয়েছিল কর্মশিক্ষার বীজ। পুঁথিগত শিক্ষার সঙ্গে কাজের সমন্বয় সাধনই কর্মশিক্ষার মূলকথা। সাহিত্য-বিজ্ঞানের জীবন দর্শনের সহজ সমন্বয় শিশুমনে অনুপ্রবিষ্ট হয় কর্মশিক্ষার মাধ্যমে। ১৯৯৫ সালে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বিজ্ঞপ্তিতে নবম ও দশম শ্রেণিতে ঐচ্ছিক বিষয় রূপে কর্মশিক্ষার পদাবনতি ঘটানো হয়। বর্তমানে, পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্য বিষয়গুলির সঙ্গে এই বিষয়টি এখনও রুটিনে ‘টিকে’ আছে। ঐচ্ছিক বিষয় কখনও আবশ্যিক বিষয়ের মর্যাদা, শিক্ষার্থীর আগ্রহ দাবি করতে পারে না।
বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব, স্থানাভাব, সময়ের অভাব, আগ্রহ ও প্রেরণার অভাব, অর্থ ও উপকরণজনিত সমস্যা, যথার্থ মূল্যায়নের সমস্যা এবং সর্বোপরি তৎকালীন সরকারের উপেক্ষা করার নীরব নির্দেশনার পরিণামে বর্তমান কর্মশিক্ষার এ-হেন সঙ্কোচন। মূল্যবোধের শিক্ষা, আত্মপ্রতিষ্ঠাময় মনুষ্যত্বের শিক্ষা, কল্যাণকামী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার শিক্ষা, কর্মনৈপুণ্যের শিক্ষা, সমাজ কল্যাণে শিক্ষাকে কথার কথা-র পরিবর্তে বাস্তব করে তুলতে হলে কর্মশিক্ষা নৈমিত্তিক অনুশীলন বিদ্যালয় স্তরে অত্যন্ত অপরিহার্য। তাই ভেবে দেখার সময় এসেছে, কর্মশিক্ষার উন্নয়নে আধুনিক চিন্তাভাবনাকে বিকশিত করে কী ভাবে বিষয়টিকে পাঠ্যক্রমে পুনরায় পূর্ব মর্যাদায়, স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
অমিয় বিশ্বাস, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
বিজ্ঞান ও রাষ্ট্র
‘ভ্রমসাধনা’ (৩০-৮) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ‘এত যজ্ঞ কেন?’ তার উত্তরের খোঁজে প্রাসঙ্গিক হতে পারে কিছু দিন আগে প্রকাশিত তাপস কুমার দাসের প্রবন্ধ ‘বিশ্বাসে মিলায় বিজ্ঞান?’ (২০-৭)। দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা ধর্মীয় পূজা-অর্চনা সেরে তবে চন্দ্রযান উৎক্ষেপণ করেছিলেন। মহাকাশ গবেষণার উদ্যোগে নাকি ক্ষেত্রবিশেষে জ্যোতিষীরা দিনক্ষণ স্থির করে দিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান ও ধর্মীয় আচারের দু’টি স্বতন্ত্র বৃত্তকে একত্রে মিশিয়ে ফেলতে কোনও সঙ্কোচ করলেন না দেখে মনে অস্বস্তি অনুভব করেছি। অবশ্য দেশে আজকাল চিন্তাভাবনার আবহমণ্ডল সংস্কার-প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বস্তরেই ব্যবহারিক আচরণও সেই অনুযায়ী হচ্ছে। বিদেশ থেকে যুদ্ধবিমান কিনে নিয়ে আসার সময় রাষ্ট্রের তরফে কর্তাব্যক্তি ওখানেই পুজো-আচ্চার কিছু আচার প্রকাশ্যে পালন করে বিমান নিয়ে আসছেন, এই খবর কি নিকট অতীতে আমরা দেখিনি? আজকাল সাধারণ মানুষজনের মধ্যে ধর্ম ও সংস্কারভিত্তিক ভাবালুতা, আবেগ ও উত্তেজনার প্রাবল্য ও ক্রমবর্ধমানতা এই পটভূমিতে অপ্রত্যাশিত নয়।
যুক্তিবাদিতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার দিক ছাড়াও ভারতীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টির অন্য একটা দিকও আছে। ইসরোর উদ্যোগের সঙ্গে ধর্মীয় আচার পালনকে যুক্ত করা কোন সুবিবেচনা থেকে ঘটেছে? রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির সংবিধান অনুযায়ী, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি মেনেই চলার কথা। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান-গবেষণামূলক উদ্যোগে ধর্মীয় প্রথা ও আচারের সংস্রব আসছে কেন? দেশে বহু মানুষ থাকতে পারেন যাঁরা কোনও প্রথাগত ধর্মেই বিশ্বাসী নন। ভারত একটি ‘রিপাবলিক’ বা গণরাজ্য। রাষ্ট্রের উপর সব নাগরিকেরই সমান অধিকার। তাই সর্বজনগ্রাহ্য আচরণই রাষ্ট্রীয় ও সরকার-নিয়ন্ত্রিত প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে স্বীকার্য। ফলে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ মেনেই দেশে সব সরকারি সংস্থাকে চলতে হবে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি অকারণে লিখিত নয়। কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে ঘটা করে বিশেষ ধর্মীয় আচার পালিত হলে লোকচক্ষে রাষ্ট্রের ধর্মতান্ত্রিক একটা রূপ গড়ে ওঠে। ভারত রাষ্ট্রের গঠন কিন্তু ইতিহাসের ধারায় সে ভাবে হয়নি। ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল না, আমাদের সংবিধান-প্রণেতাদেরও লক্ষ্য ছিল না।
ব্যক্তিগত স্তরে কোনও বিজ্ঞানীর প্রকৃত আধ্যাত্মিক কিছু মনোবৃত্তি থাকতে পারে। সেটা তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতির বিষয়। ব্যক্তিগত নিভৃত পরিসরেই তা সীমিত থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রকৃত অধ্যাত্মসাধনা ও বিজ্ঞানসাধনার মধ্যে মৌলিক ঐক্য এটুকুই যে, উভয় ক্ষেত্রেই সাধনার মূলে আছে জ্ঞানের ও সত্যের অন্বেষণ। কিন্তু এর পর তাদের পথ আলাদা ও স্বাধীন। এই স্বাতন্ত্র্যকে সম্মান করতে হবে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই ধর্মের নামে যে ধরনের আবেগসর্বস্বতাকে বিস্তৃত হতে দেখা যাচ্ছে, তা দেশকে ভারসাম্য রেখে সামনের দিকে এগোতে সাহায্য করতে পারবে না।
শতদল ভট্টাচার্য, কলকাতা-৯১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy