Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: কেন এই হাল

বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে শিল্পের এই হাল কেন? এক কথায় বলতে গেলে এই সরকারের নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্য দায়ী, প্রথমত জমি নীতি ভ্রান্ত।

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫ ০৭:১৮
Share
Save

দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘নেতির রাজনীতি কেন’ (১৩-২) প্রবন্ধে শুরুর অংশ পড়ে পাঠকবর্গের মনে হতেই পারে এই আধুনিক শহর বোধ হয় বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। বাস্তব কিন্তু অন্য কথাই বলে। এই শহরের পরিকল্পনা হয়েছিল ১৯৯০ সালে, তৎকালীন বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আমলে। এখানে প্রাক্তন বাম আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেবের নাম বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। এই এলাকায় জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে সব কিছু তাঁদের তত্ত্বাবধানেই হয়।

প্রশ্ন হল, বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে শিল্পের এই হাল কেন? এক কথায় বলতে গেলে এই সরকারের নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্য দায়ী, প্রথমত জমি নীতি ভ্রান্ত। তাই বড় কোনও শিল্পপতি এখানে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাননি। টাটার মতো প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা হয়তো শিল্পপতিদের বিনিয়োগে বিমুখ করে তুলেছে। সিন্ডিকেটরাজ, তোলাবাজি এ রাজ্যের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। সেখানে ‘শিল্পবান্ধব পরিবেশ’ কথাটা বড়ই বেমানান। এখানে বিরোধীদের খুব একটা ভূমিকা আছে বলে মনে হয় না। ইদানীং কালে এমন কোনও তথ্য নেই যে, কোনও শিল্পগোষ্ঠীকে বিরোধীরা বাধা দিয়েছেন। আজ পর্যন্ত যত বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন হয়েছে সমস্ত প্রতিশ্রুতির যোগফল নাকি প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকা, এর মধ্যে বিনিয়োগ হয়েছে কতটা? আসলে বাণিজ্য সম্মেলনে শিল্পপতিদের নিমন্ত্রিত করে আনা যায়। কিন্তু বাস্তবে বিনিয়োগ করানো কঠিন। বাংলার দরকার ভারী শিল্প, যেখানে হাজার হাজার লোক কাজ করবে, বেকারত্ব কমবে, অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। প্রতি বারই বিভিন্ন সংস্থা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বছরের শেষে একটা বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবের ছাপ পড়ে প্রতি ক্ষেত্রে।

এটা ঠিকই যে বিরোধীদের ভূমিকা গঠনমূলক হওয়া উচিত, তাতে রাজ্যের সার্বিক উন্নতি সম্ভব। কিন্তু বর্তমান শাসক যখন বিরোধী ছিলেন, তখন কি তাঁরা কোনও গঠনমূলক বিরোধীর ভূমিকা পালন করেছিলেন? বিধানসভায় ভাঙচুর ছিল নিত্যনৈমিত্তিক খবর। যে কোনও কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পে বাধা দেওয়া, নাম পরিবর্তন, প্রকল্প শুধুমাত্র বাংলায় হতে দেওয়া যাবে না— এই রকম বাধার ঘটনাও ঘটেছে। আশ্চর্যের বিষয়, সদ্যসমাপ্ত বাণিজ্য সম্মেলনে ভুটানের রাজা আমন্ত্রিত ছিলেন। তবে তাঁর প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু আমাদের সম্মেলনে এসে নিজের দেশের জন্য বিনিয়োগের বিষয়কেই প্রাধান্য দিলেন। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনও তাঁর রাজ্যে যাতে শিল্পপতিরা বিনিয়োগ করেন তার অনুরোধ করলেন। তাই আয়োজক রাজ্যের উদ্দেশ্য ঠিক কী, সেটাই বোঝা দুষ্কর হয়ে গেল।

স্বপন চক্রবর্তী, জগৎবল্লভপুর, হাওড়া

উন্নয়নের জন্য

দেবাশিস ভট্টাচার্যের লেখা ‘নেতির রাজনীতি কেন’ উত্তর-সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে আমার এই চিঠি। শাসক দলের কোনও ভাল কাজ বিরোধীদের দ্বারা বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয়েছে বা সে বিষয়ে বিরোধীরা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, এমন ঘটনা বহু কাল নজরে পড়েনি। স্বাধীনতার পর প্রথম দিকে এ রকম কিছু ঘটনার কথা পড়ে জেনেছি। রাজ্যে শাসক ও বিরোধী উভয়েই আদতে জনপ্রতিনিধি। উভয়ের লক্ষ্য রাজ্য তথা রাজ্যবাসীর সার্বিক উন্নয়ন। তার জন্য চাই বিধানসভায় আলোচনা, বিতর্কের সুস্থ পরিবেশ। কিন্তু দীর্ঘ দিন বিধানসভায় সেই পরিবেশ নেই। বিধানসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা অধিবেশনে কত দিন উপস্থিত থাকেন তার তথ্য দেখলেই বিষয়টা অনুমান করা যায়। বিধানসভায় বিরোধীদের বক্তব্য, তাঁদের প্রশ্ন কতখানি গুরুত্ব দিয়ে শোনা হয় তাও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। অথচ, লোকসভা, বিধানসভার অধিবেশন অধিকাংশ সময়েই হই-হট্টগোলের মধ্যে কাটে। কোনও একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রতিবাদের মাধ্যমে অধিবেশন বয়কটের ওজর ওঠে। ফলে না হয় কোনও আলোচনা, বিতর্ক, প্রশ্নোত্তর; না হয় ঠিক সমাধান।

এখনও রাজ্যের জ্বলন্ত সমস্যা কর্মসংস্থান। কিছু দিন আগে ১০ লক্ষ সরকারি চাকরির কথা ঘোষণা হয়েছিল, তার হদিসও মিলল না। ২৬০০০ স্কুল শিক্ষকের চাকরি চলে যাওয়ার পথে, করোনা পরবর্তী সময়ে বহু শ্রমিক কাজ হারিয়ে বাড়িতে বসে আছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যের বাইরে কাজ জুটিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছে। এ ছাড়া রাজ্যে এই মুহূর্তে অসংখ্য শিক্ষিত বেকার। বাজেট প্রস্তাব কর্মসংস্থানের বিষয়ে কোনও দিশা দেখাতে পারেনি। এ বারের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে ৪ লক্ষ ৪০ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দের খবর। বাস্তবে যদি এর অর্ধেকও বিনিয়োগ হয় তবে পশ্চিমবঙ্গের বেকাররা কিছুটা অক্সিজেন পাবেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এর আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি? অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে।

বেশ কিছু জায়গায় অনুদানের রাজনীতি করে, কথায় ভুলিয়ে বেশি দিন রাজত্ব‌ করা যায় না। এ কথা শাসক দলকে এখনই ভাবতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ‌ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। বিরোধীদের পাশে নিয়ে উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করতে পারলে রাজ্য আবার দেশে শ্রেষ্ঠ আসন পাবে।

গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

পুরনো ব্যাধি

‘নেতির রাজনীতি কেন’ শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ইতিহাস বলছে, নেতির রাজনীতি যতই আগ্রাসী হয়েছে, ততই নিম্নগামী হয়েছে বাঙালি জীবনযাপনের মান। এ সব অধোগতিসম্পন্ন নেতির আন্দোলন অতীতে এই বাংলার বুকে যে ক্ষতিসাধন করেছে, তার মূল্য চোকাতে কয়েক দশক অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। এ প্রসঙ্গেই গত শাসকের জমানায় অটোমেশন বন্ধ করা, ইংরেজি তুলে দেওয়া, কম্পিউটার আসতে না দেওয়ার স্মৃতি অনেকের মনে পড়বে। বহু প্রজন্মকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে বিগত শাসকের এই অবিবেচনার ফল ভুগতে হয়েছে। উন্নয়নকে পাত্তা না দিয়ে রাজনীতির যুক্তি দেওয়া এ দেশের নেতাদের পুরনো ব্যাধি। সেই অর্থে কমিউনিস্টরাও সকলে এ দেশে ইতিবাচক রাজনীতি করেছেন কি না, সে প্রশ্ন বজায় থাকবে। আমাদের রাজ্যের বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরাও এর ব্যতিক্রম নন।

সিঙ্গুরে টাটা মোটরসের বিনিয়োগ রাজ্যের শিল্পমহল এবং রাজ্যবাসীর মনে সুবাতাস বইয়ে দিয়েছিল। টাটা কর্তৃপক্ষের সেই সময় বক্তব্য ছিল, শিল্পায়ন চান কি না, তা কিন্তু স্থির করতে হবে রাজ্যবাসীকেই। আর বিরোধী নেত্রীর বক্তব্য ছিল, তাঁরা শিল্পের বিরুদ্ধে নন, তবে শিল্পের জন্য কৃষিজমি নেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এই অনুযোগেই রাজ্য সরকারকে স্পষ্ট ঘোষণা করতে হয়েছিল, নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব হবে না, অধিগ্রহণ করা হবে না কোনও জমিই। কিন্তু তার পরও রাষ্ট্রযন্ত্র প্রয়োগে নন্দীগ্রামকে বিরোধ-মুক্ত করা হয়েছিল।

ভূমিসংস্কারের কারিগর সিপিএম যখন এক সময় শিল্পায়নের জোয়ার আনতে চেয়েছিল; তখন ‘জমি বাঁচাও সংগ্রাম কমিটি’র হাত ধরে বিরোধী রাজনীতি হালে পানি পেয়েছিল। আর চৌত্রিশ বছরের রাজত্বে বলশালী সিপিএমের ভুল-ত্রুটিগুলির ছিদ্র খুঁজে রাজ্যের বিরোধী দল ক্ষমতার গন্ধ পেয়েছিল। তখন রাজ্যের রাজ্যপালের মধ্যস্থতায়ও শাসক-বিরোধী রাজনীতি শিল্পায়নের স্বার্থে কোনও দিশা খুঁজে পায়নি। পরবর্তী সময়ে রাজ্যের শিল্পায়নে যে হাঁড়ির হাল হয়েছিল, তা আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করেছি। এ দেশের কর্দমাক্ত রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে বর্তমান সময়ে শুভবোধের রাজনীতি দেশ জুড়ে প্রায় উধাও হয়েছে। শুভচিন্তক রাজনীতিবিদের সংখ্যাও এখন নগণ্য।

সেই কারণে বিরোধীদের ‘নেতি রাজনীতি’র হাত ধরে ক্ষমতায় আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় বাম-বিজেপির রাজনৈতিক আচরণ যে সদর্থক হবে না, বলা বাহুল্য।

সঞ্জয় রায়, হাওড়া

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mamata Banerjee TMC CPIM

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}