Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: গতি ও আলস্য

হান্টার কমিশনের সুপারিশ বা মেকলে’র উপদেশ অনুসারে নবজাগরণের সময় দেশি ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষায় গুরুত্ব বাড়লে এক শ্রেণির মানুষ খানিক পিছিয়েই ছিলেন। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন।

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ০৭:০৭
Share
Save

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে সেমন্তী ঘোষের লেখা ‘দুয়োরানির গল্প’ (২৮-২) প্রবন্ধটি বিশেষ ভাবনায় সমৃদ্ধ। সম্প্রতি এক বিদ্বজ্জনের বাংলা ভাষার মধ্যে অবাংলার অবাঞ্ছিত ব্যবহার সম্পর্কিত কিছু মন্তব্য বিতর্কের উদ্রেক করে। তিনি বলেছিলেন অকারণ অন্য ভাষার অব্যবহার প্রসঙ্গে। প্রসঙ্গটি নতুন নয়। আসলে ভাষা প্রসঙ্গ এমনই এক জটিল বিষয় যেখানে অবিমিশ্রতা রক্ষা করা কঠিন। মনে পড়ে দুই বড় সাহিত্যিকের কথা। প্রথম জন গৌরকিশোর ঘোষ। তাঁর এক উপন্যাসে এক চরিত্র ভিন্ন গোষ্ঠীর এক মানুষকে বলছেন আমাদের লড়তে হয় অনেকের সঙ্গে। প্রথমত, তোমাদের বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়ত, ইংরেজদের বিরুদ্ধে আর তৃতীয়ত, নিজেদের বিরুদ্ধে। আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মতো। অনেক ধারাই এসে মিশে একটা ধারাকে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করে। চলার পথে গতি দেয়।

হান্টার কমিশনের সুপারিশ বা মেকলে’র উপদেশ অনুসারে নবজাগরণের সময় দেশি ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষায় গুরুত্ব বাড়লে এক শ্রেণির মানুষ খানিক পিছিয়েই ছিলেন। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। কিন্তু এঁরাই পরবর্তী কালে নতুন আবেগে জেগে উঠেছিলেন। সে ইতিহাস ভোলার নয়। বিদ্যাসাগরের পরম মিত্র অক্ষয়কুমার দত্ত দেখিয়েছিলেন ভাষার উৎস সূত্রে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা গোষ্ঠীর সঙ্গে কোথায় সাদৃশ্য। সংস্কৃত কোন আদি জন। উর্দু ‘বেরাদর’ হয়ে গিয়েছে ‘ব্রাদার’। ‘ত্রি’ হয় ‘তৃ’, ‘পয়দল’ হল ‘প্যাডাল’ প্রভৃতি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাঙালির তুলনা করার আগে কিছু বিষয় মাথায় রাখি। প্রশ্ন ওঠে বাংলা ভাষা ব্যবহারে আন্তরিকতা সচেনতা আর প্রয়োগের ক্ষেত্র প্রসারণতার।

আমরা কি ভুলতে পারি উইলিয়াম কেরি থেকে উইলিয়াম রাদিচে থেকে ক্লিনটন বি সিলি বা জো উইন্টারের কথা। তাঁরা তো ইংরেজি ভাষার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রতিও কম শ্রদ্ধাশীল ও কর্মনিষ্ঠ নন! কেন মনে রাখব না আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর নামটাও। এঁরা তো দৃষ্টান্ত, প্রেরণা। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার থেকে সত্যজিৎ রায় কিংবা বিশ্বভারতীর ঘরানার কথা নাহয় না-ই বা ধরলাম। ইংরেজি সাহিত্যের বাঙালি লেখক অমিতাভ ঘোষ তো তাঁর লেখায় গুরু, চ্যালা, সিন্দূর, কুমকুম প্রভৃতি স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করে চলেছেন। আসলে বাংলাকে শ্রেষ্ঠাসনে বসানো নিয়ে আমাদের মধ্যেই রয়ে গিছে চরম আলস্য, দ্বিধা এবং অনেকাংশে হীনম্মন্যতা।

তনুজ প্রামাণিক, হাওড়া

দুর্ভাগ্যজনক

সেমন্তী ঘোষের মাতৃভাষা নিয়ে ‘দুয়োরানির গল্প’ প্রবন্ধ বিষয়ে কিছু কথা। আমাদের প্রাণের মাতৃভাষা বাংলা প্রতি দিন ক্ষয়িষ্ণু এবং দীন হয়ে চলেছে, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এ নিয়ে আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করি।

এই যে হিন্দি ভাষা বা হিন্দি আরোপিত সংস্কৃতি নিয়ে যে এত যুদ্ধ চলছে এখন, সেটাও কি খুব টাটকা একটা বিষয়? মোগল আমল থেকে উর্দু, হিন্দি, ফারসির মতো ভাষা বঙ্গদেশে সরকারি ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা যে সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হিসাবে, ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে মহিমান্বিত করি, তিনি বা তাঁর পরিবারের কেউ কখনও বাংলায় কথা বলেছেন কি না এমন কিন্তু কোনও প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। সুতরাং, এই হিন্দি বা উর্দু আরোপ করার শৃঙ্খলা বহু পুরনো এবং এর বিরুদ্ধে কোনও নির্দিষ্ট অংশের বাঙালিরই মাথা তুলে দাঁড়ানোর ইতিহাস আমি অন্তত পাইনি।

ব্রিটিশ আমলে যখন বাংলা স্বমহিমায় বিদ্যমান ছিল, বাঙালি তার রুচি এবং গুণাবলি সম্পর্কে সচেতন হয়ে পরিশ্রম করে নিজেদের উন্নততর স্তরে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবত, তখন ইংরেজির সঙ্গে সারা দেশ জুড়ে বাংলা পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, নজরুল থেকে আরম্ভ করে, সুনীল, সঞ্জীব, শঙ্খ ঘোষ এমনকি, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় বা নচিকেতা ঘোষের মতো বাণিজ্যিক ধারার ছবির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও আমাদের এই ভাষাকে এক দিন কত সমৃদ্ধ করেছেন! কিন্তু গত ৪০-৫০ বছরে দেশের অগ্রগতির জোয়ারে বঙ্গদেশ যেন দলছুট রাজ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি বাইরের লোকের কাছে সম্মান হারাবে, এটা আশ্চর্য নয়।

এমনই দুর্ভাগা আমরা যে হিন্দি গানের পঙ্‌ক্তি বা শব্দ ছাড়া একটা গোটা বাংলা হিট গান (বাণিজ্যিক) দুর্লভ হয়ে গিয়েছে। বাঙালি আমজনতা সেই গান গ্রহণ করে না। এ বিষয়ে কোনও রাজনৈতিক দলও কথা বলে না। আমাদের আশেপাশে যত অবাঙালি মানুষ থাকেন, তাঁরা তাঁদের মাটির থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও মাতৃভাষাতেই কথা বলেন। অথচ বাংলা থেকে দূরে থাকলে তো বাদই দিন, কলকাতায় থেকেও সারা দিন বাংলায় কথা বলেন এমন বাঙালি ক’জন! আর ‘এলিট’ হলে তো ৭০ শতাংশ ইংরেজি, ২০ শতাংশ হিন্দিতেই কাজ চালিয়ে দেওয়া হয়।

তাবড় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বাবা-মা বাঙালি। অথচ বাংলা বলতে পারেন না তাঁদের অনেকেই। মুখোপাধ্যায় পরিবারের এ প্রজন্মের তিন তারকা রানি, কাজল এবং অয়ন। রানি বাঙালি মা, মাসির কল্যাণে বাংলা বলতে পারলেও কাজল বা অয়ন বাংলা জানেন বলে মনে হয় না। বাবা-মায়ের দায়ও কি রয়ে যায় না এতে!

উত্তর ভারতীয় ভাষাগুলি নিয়ে প্রবন্ধে কিছু আলোচনা রয়েছে। এঁরা নিজেদের পরিমণ্ডলে নিজেদের মাতৃভাষাতেই কথা বলেন। এতে তাঁদের মধ্যে যে গোষ্ঠীবদ্ধতার অনুভূতির প্রমাণ মেলে, বাঙালিদের মধ্যে সেই একতার কতখানিই বা দেখা যায়?

সৌমাভ ভট্ট, কৃষ্ণনগর, নদিয়া

প্রাণের সম্পদ

সেমন্তী ঘোষের লেখা ‘দুয়োরানির গল্প’ পড়ে বাংলা ভাষা নিয়ে মনখারাপের ভারটা আরও বেড়ে গেল। যার জন্য এত কিছু, ২১ ফেব্রুয়ারি, মাতৃভাষা দিবস, সেই বাংলা ভাষাই, পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে অবহেলিত। ভাষা আন্দোলনের পরে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু বাদ দিয়ে বাংলার সরকারি ভাষার স্বীকৃতির জন্য দেশবাসী উত্তাল হয়েছিল। ষাটের দশকের শেষ দিকে আমার ছোটবেলায় প্রত্যন্ত গ্রামেও ২১ ফেব্রুয়ারি সবাই খালি পায়ে চলাচল করতেন, সাইকেল পর্যন্ত চড়তেন না। আমাদের মেয়েদের স্কুলে ও দাদাদের ছেলেদের স্কুলে টেবিলের উপরে বই লম্বালম্বি দাঁড় করিয়ে, ফুল দিয়ে, ভাষা স্মারক তৈরি করে, বাংলা কবিতা পাঠ, গান গাওয়া হত। অনেক রক্ত, যুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত সেই বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ ভূলুণ্ঠিত।

এ-পার বাংলায় হিন্দি আগ্রাসন এবং আন্তর্জাতিক প্রয়োজন বা চাকরিবাকরির দোহাই দিয়ে নব প্রজন্মকে মাতৃভাষা বাংলা শিখতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না। ইংরেজি প্রথম ভাষা, হিন্দি দ্বিতীয় ভাষা আর হেলাফেলা করে বাংলাকে তৃতীয় ভাষা বা ঐচ্ছিক ভাষা হিসাবে নেওয়া হচ্ছে। আমার এক নিকটাত্মীয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছেলে গড়গড় করে ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ে গেল কিন্তু পাশাপাশি বাংলা পত্রিকা পড়তে ঠোক্কর খেতে লাগল। তার মাকে বললাম যে মাতৃভাষা না জানাটা কিন্তু নিজেকে, নিজের ঐতিহ্যকে অবমাননা। তা ছাড়া বাঁধা গতে সন্তানকে আইটি ক্ষেত্র, ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারই বানাতে হবে কেন? বাংলাভাষাতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করলে শিক্ষক, অধ্যাপক, দূতাবাসের দোভাষী, সিনেমার চিত্রনাট্যকার, সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকার ইত্যাদি নানা ধরনের চাকরি পাওয়া সম্ভব। আমরা বাংলায় দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের মতো গুণী সংবাদপাঠক, অজয় বসুর মতো ধারাভাষ্যকার পেয়েছি। তাঁরা তো তাৎক্ষণিক বর্ণনায় বাংলা কথ্যভাষাকে সাহিত্যের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করতেন। বাংলা ভাষার জন্য “মাতৃ-ভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে”— আমরা গর্ব করতেই পারি। গর্ব করে বলি, বাংলা আমার মায়ের ভাষা, আমার প্রাত্যহিক দিনযাপনের ভাষা, স্বপ্ন দেখা, ভালবাসার, প্রাণের ভাষা।

শিখা সেনগুপ্ত,বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Language

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}