তূর্য বাইনের ‘বনিয়াদি শিক্ষায় গোড়ার কাজ’ (১৩-২) প্রবন্ধটির শুরুতে এ বঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে ইতিবাচক তথ্য উঠে এলেও সিংহভাগ জুড়ে ধরা পড়েছে নেতিবাচক চিত্র। রয়ে গিয়েছে গোড়ায় গলদ। প্রধানমন্ত্রীর ইকনমিক অ্যাডভাইজ়রি কাউন্সিল-এর ‘ফাউন্ডেশনাল লিটরেসি ও নিউমেরেসি রিপোর্ট’ অনুযায়ী, ভারতে শিক্ষার মান হতাশাব্যঞ্জক হলেও বড় রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছে সেরার স্বীকৃতি। সর্বোপরি ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে স্কুলছুটের জাতীয় গড় ৩.৭% হলেও এ রাজ্যে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে সেই হার শূন্য। এই শিরোপা গৌরবের।
তবে সম্প্রতি ‘অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট, রুরাল’ (এএসইআর) নামে এক অসরকারি সংস্থার সমীক্ষার যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে তা শুধু হতাশাব্যঞ্জক নয়, উদ্বেগেরও। আজ চতুর্থ শ্রেণির ৫.২ শতাংশ পড়ুয়া বাংলা অক্ষর চেনে না। ১৬.৪ শতাংশের অক্ষর জ্ঞান থাকলেও তারা শব্দ পড়তে পারে না। প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ১৪.৩ শতাংশ ১ থেকে ৯ সংখ্যা চেনে না। সর্বোপরি তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও সংখ্যা চেনে না ৪.৪ শতাংশ পড়ুয়া। অধিকাংশ শিক্ষাবিদের বিশ্বাস, পাশ-ফেল প্রথা উঠে যাওয়ায় পড়ুয়াদের মধ্যে আর শেখার তাগিদ নেই। আগ্রহটাই হারিয়েছে, জানার ইচ্ছে মরে গেছে। বিনা পরীক্ষায় উত্তরণের পাকা ব্যবস্থা থাকলে এমনই চিত্রনাট্য রচিত হয়। দিন দিন বদলে যাওয়া আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলে শিশুমনকে আকৃষ্ট করার মতো পাঠ্যক্রম, অনুকূল পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতির পরিবর্তন ও শিক্ষকদের কর্মশালা আবশ্যক। পাশাপাশি ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, প্রয়োজন ভিত্তিক উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ জরুরি। আজও ছাত্রদরদি শিক্ষকের অভাব নেই। বুনো রামনাথ, উদয়ন পণ্ডিতরা সভ্যতা থেকে হারিয়ে যান না, পরম নিষ্ঠা ও দায়িত্বের সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে তাঁরা আজও সবটাই উজাড় করে দেন।
২০০৯ সালে ‘রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট’ প্রণীত হওয়ার পর সব শিশুকে শিক্ষার আঙিনায় আনার চেষ্টা হলেও অন্ধকার গ্রামের কচিকাঁচারা আজও অন্ধকারই রয়ে গেছে। আইনে উল্লেখ আছে বিনা বেতনে শিক্ষালাভ, বার্ষিক মূল্যায়নের পরিবর্তে নিরবচ্ছিন্ন সামগ্রিক মূল্যায়ন আবশ্যক। কিন্তু বিনামূল্যে বইখাতা পোশাক পরিচ্ছদ শিক্ষার সরঞ্জাম দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়? আজও এক বড় সংখ্যক শিশু বিদ্যালয়ে খেতেই আসে। যাদের জন্য শিক্ষা, তারা অপুষ্টিকে পাথেয় করে খুঁড়িয়ে চললে সভ্যতার অভিমুখও অন্ধকারের দিকেই হবে।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
বদল চাই
তূর্য বাইনের প্রবন্ধে দেশে তথা রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষার মানের যে বেহাল দশা তুলে ধরা হয়েছে, তা যথার্থ ও বাস্তবিক। যে কোনও রাষ্ট্রে প্রাথমিক শিক্ষাই যে উচ্চশিক্ষার ভিত, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। নড়বড়ে প্রাথমিক শিক্ষা কখনও উচ্চশিক্ষার সহায়ক হতে পারে না। আমাদের দেশে যথাযথ পরিচর্যা ও যত্নের অভাবে প্রাথমিক শিক্ষার মান দিন দিন তলানিতে ঠেকছে। সম্প্রতি দেশের প্রাথমিক শিক্ষামানের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ সেরার স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে, যে সূচকগুলির ভিত্তিতে এই রাজ্যকে সেরার শিরোপা দেওয়া হয়েছে সেগুলিতে রূঢ় বাস্তব এবং তুলে ধরা পরিসংখ্যানের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।
প্রবন্ধে যে পরিসংখ্যানগুলি দেওয়া হয়েছে, সেগুলি মোটামুটি সত্যি বলে ধরে নিলেও শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা দেশে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পার করার পরেও প্রাথমিক শিক্ষার দশা অত্যন্ত হতাশাজনক ও উদ্বেগের। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হল এই যে, স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও সংবিধান স্বীকৃত ৬-১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত পড়ুয়ার প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে পঠনপাঠন সুনিশ্চিত করা যায়নি। তার অন্যতম কারণ প্রাথমিক থেকে উচ্চ প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত একটা বড় অংশের পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুটের প্রবণতা। মিড-ডে মিল, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, ইউনিফর্ম বিতরণ প্রভৃতি সুযোগসুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও ‘স্কুলছুট’-এর সমস্যা নির্মূল করা যায়নি এখনও।
প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে শিক্ষার মানের অধোগতি ও স্কুলছুটের কারণ হিসেবে সামঞ্জস্যহীন ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত, শিক্ষা বহির্ভূত কাজে শিক্ষকদের ব্যবহার, প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া ও স্কুলের পরিকাঠামোগত সমস্যার কথা প্রায়শই আলোচিত হয়। শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে বেশ কিছু পদক্ষেপ বিশেষ গুরুত্ব-সহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন। এক, প্রত্যেক বছর শূন্য পদে যোগ্যতাসম্পন্ন ও উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষক যথাসময়ে নিয়োগ করতে হবে। দুই, সহজ, সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে। তিন, বিভিন্ন ধর্মের নির্যাস নিয়ে নীতিমূলক শিক্ষা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যা পড়ুয়াদের আচার-আচরণ, চরিত্র গঠন, সৌজন্যবোধ, মানবিকতা ও সহনশীলতা শেখাতে সহায়ক হবে। চার, শিক্ষাখাতে সরকারি বরাদ্দ পর্যাপ্ত হারে বৃদ্ধি করতে হবে। পাঁচ, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে যাতে যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা সরকারি, আধাসরকারি ও চুক্তিভিত্তিক কাজ করে নিয়মিত উপার্জন সুনিশ্চিত করতে পারে। ছয়, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষা দফতরের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমন্বয় সুদৃঢ় করতে হবে।
সাত, অপ্রয়োজনীয় ছুটি কমিয়ে স্কুলে পঠনপাঠনের দিন বৃদ্ধি করতে হবে। আট, স্কুলপ্রাঙ্গণ রাজনীতিমুক্ত রাখতে হবে। নয়, প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী— এই অজুহাতে শিক্ষা দানে গাফিলতি আড়াল করা যাবে না। পরিশেষে, প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত স্কুলে পঠনপাঠন কেমন হচ্ছে, শিক্ষা দফতরের তরফে তা নিয়মিত নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে।
হারান চন্দ্র মণ্ডল, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
নতুন ভাবনা
তূর্য বাইনের লেখাটি সম্পর্কে কিছু কথা জানাতে চাই। এই রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র তিনি সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। এর সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য কিছু পদক্ষেপ করা যেতে পারে। প্রথমত, প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো উন্নত করতে হবে। শ্রেণিকক্ষগুলি সুন্দর ও পঠনপাঠনের উপযুক্ত হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, শিশু শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কেবল মাতৃভাষা ও ইংরেজিতে ছড়া ও গান শেখাতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের মাতৃভাষা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে হবে। পাঠ্যসূচি ছোট ও আকর্ষণীয় হওয়া উচিত।
তৃতীয়ত, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস ও ভূগোল যুক্ত করা প্রয়োজন। চতুর্থত, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য প্রতি দিন মধ্যাহ্নভোজন (মিড-ডে মিল)-এর আগে তিন পিরিয়ড শিশুরা শিখবে এবং পরের পিরিয়ডগুলিতে শিক্ষকদের সামনে বসে অনুশীলন করবে। বাড়ির কাজ দেওয়া চলবে না। পঞ্চমত, অনুশীলনের কাজ যে করে ফেলতে পারবে তাকে কিছু উপহার দিতে হবে। উপহার হিসেবে রঙিন ছবি, রং পেনসিল, খুব ছোট খেলনা, বেলুন ইত্যাদি দিলে ভাল হয়। এতে শিশুদের শেখার আগ্রহ বাড়বে। কোনও খাবার জিনিস দেওয়া উচিত নয়। ষষ্ঠত, পাঠ্যবই ছাড়াও শিশুদের বাংলা ও ইংরেজি গল্পের বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতে হবে। শুনে মুখস্থ করে সেই গল্প শিশুদের দিয়ে বলানোর চেষ্টা করতে হবে। বলতে শিখলে শিশুরা দ্রুত ভাষা আয়ত্ত করতে পারবে।
এই ভাবে এগোলে রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষার প্রভূত উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা এবং শিশুশিক্ষার মানও অনেকটাই বাড়বে। তখন হয়তো অভিভাবকরাও বেসরকারি বিদ্যালয় থেকে সন্তানদের এনে সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে চাইবেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা না আনতে পারলে আমাদের রাজ্যই পিছিয়ে পড়বে। সেটা কি কোনও ভাবেই কাম্য?
সুশান্ত কুমার ঘোষ, হাওড়া
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)