চিরদীপ মজুমদারের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত, তবু ভোট পান’ (১৮-২) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। প্রবন্ধ অনুসারে, সরকারি সুযোগ-সুবিধা বা গণদ্রব্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা বা দল সহায়ক হলে ভোটাররা তাঁকে ভোট দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। ভোটাররা বরং অনেক বেশি মনোযোগী পাড়ার রাস্তার হাল-হকিকত, বাতিস্তম্ভের আলো, রেশনের জোগান, হাতে নগদ টাকা কতটা মিলছে, এ-সব সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির উপর। তাই বিভিন্ন রাজ্যে জনমোহিনী রেউড়ির ছড়াছড়ি। কিন্তু ভারতে দুর্নীতির এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে, যেখানে এই ব্যাখ্যা পুরোপুরি ঠিক নয়। যেমন, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের কিছু আগে রাজ্য সরকারের তদানীন্তন কিছু মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কিছু নেতা, কর্মী, বিধায়ক ও সাংসদকে ঘুষ নিতে দেখা গিয়েছিল। নারদ কাণ্ডের ফুটেজ প্রকাশ্যে আসার পর উপায়ান্তর না দেখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, আগে জানলে এই নেতাদের ভোটে দাঁড় করাতেন না। তা সত্ত্বেও দল তাঁদেরই ভোটে দাঁড় করিয়েছিল এবং অভিযুক্তরা সকলেই বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হয়েছিলেন। নারদ কাণ্ডের প্রভাব পড়েনি সেই নির্বাচনে। এমন নয় যে, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের সুবাদে মানুষ দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিল তৃণমূলকে। ‘লক্ষীর ভান্ডার’ প্রকল্প, ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পের মতো নগদ হস্তান্তরভিত্তিক অনেক প্রকল্প তখনও চালুই হয়নি। ‘দুয়ারে সরকার’ তখনও এসে পৌঁছয়নি মানুষের দুয়ারে। সর্বোপরি অভিযুক্তদের এক জন তো এখন বিরোধী দলের এক উল্লেখযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য মুখ, যিনি আবার মুখ্যমন্ত্রীকে পরাজিত করেছিলেন বিধানসভা নির্বাচনে। এর অর্থ, শুধু ‘ডেলিভারি মেকানিজ়ম’-এ বা রেউড়ির উপর ভরসা রেখে সবটা হচ্ছে না। তার বাইরেও কিছু আছে। হয়তো অপরাধ প্রবণতা একটি সহজাত প্রবৃত্তি, যাকে শিক্ষা ও আইনের শাসন অবদমিত করে রাখে মাত্র।
তা ছাড়া এ-রাজ্যে সিবিআই তদন্তের সাফল্য তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। দুর্নীতির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও একে একে রথী-মহারথীরা ছাড়া পাচ্ছেন বা জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। কারণ, সিবিআই সময়মতো চার্জশিট দিতে পারছে না। স্বাভাবিক ভাবেই এ-সব দেখেশুনে ক্লান্ত ও হতাশ মানুষ ভয়ে বা ভক্তিতে দুর্নীতির সঙ্গে আপস করে চলার আদবকায়দা শিখে নিচ্ছেন। এমনকি শাস্তি নেই বলে নিজেরাও অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়তে প্রলুব্ধ হচ্ছেন।
অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
আপস
চিরদীপ মজুমদার তাঁর ‘দুর্নীতিগ্রস্ত, তবু ভোট পান’ প্রবন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দুর্নীতিমুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ ভবিষ্যতে আর থাকবে কি না, যেখানে আজ সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির কামড় চেপে বসেছে। সেই কারণে মানুষ এমন আশঙ্কা বা চিন্তাকে কোনও ভাবেই সরিয়ে ফেলতে পারছেন না। যাঁরা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বা শাসনব্যবস্থার পথ দেখাবেন, তাঁরাই যদি দুর্নীতিমূলক কাজের প্রেরণা হয়ে দাঁড়ান, তা হলে ভবিষ্যতে প্রবন্ধকারের আশঙ্কা সত্যি হবেই। এটা সত্য যে, ভাল ‘ডেলিভারি মেকানিজ়ম’ (বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাসিক অনুদান প্রকল্পগুলো) দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা বা দলগুলো দুর্নীতির সঙ্গে মানুষের আপস করে নেওয়ার মানসিকতা ধীরে ধীরে তৈরি করে দিচ্ছেন। আর তা না হলে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতিতে একের পর এক আমলা, নেতা ও মন্ত্রীরা যখন অভিযুক্ত হচ্ছেন, তখন তাঁদেরই দল নির্বাচনে অভাবনীয় ভাল ফল করছে। এমনটাও সম্ভব।
আমাদের এই দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই সে সম্ভাবনার রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজ্যে রাজ্যে মহিলাদের হাতে তুলে দেওয়া নগদ মাসিক অনুদান প্রকল্পের প্রতিযোগিতা চলছে। যদিও সে প্রকল্পগুলোর টাকা বর্তমান জীবন বাঁচিয়ে রাখার জন্য নগণ্যমাত্র, তা সত্ত্বেও মহিলা-ভোটাররা প্রকল্প চালু করা দল বা সরকারকে ভোট দিতে দু’বার ভাবছেন না।
রাজনৈতিক দলগুলি দেখছে যে প্রচারের কাজে সময় ব্যয় না করে অনুদান প্রকল্পগুলোতে টাকা ছড়ালে আখেরে নির্বাচনে সুবিধা মিলছে। সেই কারণে মহিলাদের মাসিক অনুদানকে ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ বলে যারা বা যে দল কটাক্ষ করেছিল, তারাও এখন সেই সংস্কৃতিতে ডুব দিয়েছে। গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের দেওয়া বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে এই নগদ টাকা যতই অনুদান বলে চালানো হোক না কেন, আসলে এর পিছনে যে রাজনৈতিক সুবিধা তোলার অভিসন্ধি, তা নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
আমরা সকলেই দেখছি বা বুঝছি গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলো: শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসা, এমনকি বিভিন্ন স্তরে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির ছোঁয়া। আর দেশে বিভিন্ন স্তরে যে দুর্নীতির মাত্রা যথেষ্ট, তা তো প্রবন্ধকার ২০২৩-এ সমীক্ষায় প্রকাশিত তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন। আমরা দুর্নীতির কথা জেনেও সময়মতো ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থীর পক্ষে ভোটও দিয়ে আসছি। পরিসংখ্যান বলছে যে, ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে নোটা-তে ভোট পড়েছিল যথাক্রমে ৬০,০২,২৯৪ (১.০৮%), ৬৫,২৩,৯৭৫ (১.০৬%) ও ৬৩,৪৭,৫০৯ (০.৯৯%)। অর্থাৎ, ক্রমশ নোটা-তে ভোটের হার কমেছে। দুর্নীতির মাত্রা ধীরে ধীরে এত বাড়ছে যে, মানুষ ভেবে নিয়েছেন দুর্নীতিকে সঙ্গে নিয়েই তাঁদের চলতে হবে। অন্যথায় ‘তোমারটা তুমি কেমন করে পাও দেখি’ এমন শাসানি বারে বারে হজম করতেই হবে।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
সম্পর্কহীন
এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরীক্ষার্থীদের বই-খাতা ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে উল্লাস করার খবর পড়ে লজ্জা লাগছে। আমাদের সময়ে স্কুলের বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর, বই-খাতা খুব যত্ন সহকারে রেখে দিতাম, যাতে অন্যরা পুরনো বই ব্যবহার করতে পারে। অথচ, এই শিক্ষার্থীরা ব্যতিক্রম। তারা যে জাতির মেরুদণ্ড, সমাজ গঠনে তাদের ভূমিকা অন্যদের চেয়ে বেশি, এ কথা তারা আর ভাবছে না। আসলে, মোবাইল ব্যবহারে প্রচণ্ড আসক্তির জন্য পড়ুয়াদের একাংশের বই-খাতার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছে। অভিভাবকদেরও ছেলে-মেয়েদের প্রতি নজরদারি আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। সর্বোপরি, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যত পাশ-ফেল না থাকায় পড়ুয়াদের কাছে পড়াশোনার গুরুত্ব খুবই কম। অতীতে ফেল করা পড়ুয়াদের পাশের দাবিতে স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, জিনিসপত্র ভাঙচুর, পথ অবরোধ ইত্যাদি দেখা গেছে। কিন্তু এই চিত্র আগে দেখা গেছে বলে মনে পড়ছে না।
অপূর্বলাল নস্কর, ভান্ডারদহ, হাওড়া
দোলের রং
স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর লেখা ‘দোলের আশ্চর্য দরবেশ’ (রবিবাসরীয়, ৯-৩) চমৎকার লেখা। আমরা পুরুলিয়া জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকতাম। সময়টা ষাটের দশকের মাঝামাঝি। গ্ৰামের পাশে শিলাবতী নদীর তীরে শাল, পলাশ, শিমুল, হরীতকীর জঙ্গল ছিল। আমরা সকলে মিলে পলাশ ফুলের ডাল ছিঁড়ে এনে ফুলগুলিকে আলাদা করে ছাড়িয়ে শিল নোড়া দিয়ে ছেঁচে একটি বালতিতে রেখে জল মিশিয়ে রং বানাতাম। গ্ৰামের দোকান থেকে পিচকারি ও আবিরের জোগাড় হয়ে যেত। বেলা এগারোটার পর রং ও পিচকারি নিয়ে সারা গ্ৰাম জুড়ে হুল্লোড় পড়ে যেত। খেলা শেষে সবাই মিলে গ্ৰামের বিশাল দিঘিতে স্নান করতে যেতাম। ফিরে এসে পাঞ্জাবি পরে আবির নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুরুজনদের পায়ে আবির ছুঁইয়ে প্রণাম করতাম। সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়িতে লুচি, ঘুগনি, চপ, পকোড়া, মালপোয়া বানানো হত।
স্মৃতি শেখর মিত্র, আসানসোল, পশ্চিম বর্ধমান
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)