যখন কোনও গুণীর কলম, অন্য এক গুণিজনের সান্নিধ্যের স্মৃতিকথা শোনায়, তখন তার ভিতর থাকে অফুরন্ত আবেগ ও শ্রদ্ধা। তারই প্রতিফলন গুলজ়ারের প্রবন্ধ ‘সে যে গান শুনিয়েছিল’-য় (১৭-১১)। সলিল চৌধুরী প্রথম দিকে কবি না হয়ে উঠলে পরে সফল সঙ্গীতকার হয়ে উঠতেন কি না, সন্দেহ প্রকাশ করেন তাঁর কবিতার অনুরাগী পাঠকেরা। শিল্পীর স্বীকারোক্তি থেকেই স্পষ্ট, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্ৰহণ তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। তিনি জানিয়েছেন, শুধু গণনাট্য নয়, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র— সব আন্দোলনের শরিক হতে পারাতেই তাঁর সঙ্গীতজীবনের ভিত্তি নিহিত। এতে সুরে নতুন মূর্ছনা যোগ হয়েছে। মার্ক্সবাদী চেতনা মানসিকতার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সমাজের ক্ষয়রোগটিকে চিহ্নিত করে নিরাময়ের নিদান দিয়েছেন লেখনীর মাধ্যমে।
কবিতা নিয়ে বিলাস তিনি পছন্দ করতেন না। তাই বলেছেন, “আমার সময় নেই/ আজগুবি গল্প ফেঁদে/ সিম্বলিক কবিত্ব সাধার/ অতএব ব্রাদার/ আমাকে মার্জনা কোরো।” নির্মল আবেগ ও সহজ শব্দবন্ধ তাঁর কবিতা বা গান লেখার মূল শক্তি। তাই তাঁকে স্বভাবকবি বলা যায়। তবে অনেকেই বলেন, আকাশছোঁয়া সাঙ্গীতিক আধিপত্যের মনসবদার সলিল চৌধুরীর কাছে হার মেনেছেন রাজনৈতিক নাট্যকার ও যুগযন্ত্রণার আলেখ্য রচয়িতা সলিল চৌধুরী। তবে তাঁর কবিতা, গান, সুরের ভুবন প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সাহস ও শক্তি জোগাবে, অন্যায়ের প্রতিবাদে উৎসাহিত করবে। আলোর পথযাত্রী এই শিল্পীর জন্মশতবর্ষে আমাদের সামগ্রিক জীবন ও পরিবেশকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিলে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হবে।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
গানের জাদুকর
সলিল চৌধুরীর শতবর্ষের প্রাক্কালে গুলজ়ার রচিত ‘সে যে গান শুনিয়েছিল’ (১৭-১১) প্রবন্ধটি পরম প্রাপ্তি। নজরুল-পরবর্তী যুগে সলিল চৌধুরী ছিলেন এক বহুমুখী সাংস্কৃতিক প্রতিভা। শুধু গান লেখা, সুর দেওয়া নয়, সলিল ছিলেন গণনাট্য সঙ্ঘের এক অগ্রপথিক। পাশাপাশি লিখেছেন নাটক কবিতা প্রবন্ধও। কয়্যার সঙ্গীতের প্রসারে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। গল্পও লিখেছেন। এই সমাজসচেতন মানুষটির সুরে যেমন জীবনযুদ্ধ জায়গা পেয়েছে, তেমনই এসেছে প্রেম। সুরে মিশেছে দেশ, প্রদেশ, বিদেশ এবং এই মিলমিশেই এসেছে তাঁর মৌলিকতা। নানা মত নানা ধর্মের পারস্পরিক সম্প্রীতির প্রচার ও প্রসার করে গিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিতে। এক সময় বম্বে থেকে হিন্দি সিনেমা-সহ নানা ভাষার আঞ্চলিক গানে সুর সৃষ্টি করেছেন।
অনেকেই তাঁকে সুরের গুরু মনে করেন। বাংলা গানে হেমন্ত-সলিল জুটি বা লতা-সলিলের গান শ্রোতাদের কাছে চিরকাল প্রিয় থাকবে। প্রবন্ধে গুলজ়ার জানিয়েছেন, তিনি দেখেছেন টেবিল টেনিস খেলা মানুষটা পর ক্ষণেই কেমন করে পিয়ানো নিয়ে সুর তুলতে মগ্ন হয়ে পড়লেন। ঠিক এমনটাই ছিল সলিলের ‘সৃষ্টিশীল খ্যাপামি’। যাকে বলা হয়ে থাকে, ‘মেথড ইন ম্যাডনেস’। তাঁর সুর করা চির-বিখ্যাত ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’ গান প্রসঙ্গে জানা যায়, এক রাত্রিতে শ্যামল মিত্রের বাড়িতে থাকাকালীন নাকি হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে ‘ডাকিনী যোগিনী এল শত নাগিনী’ অংশটির সুর করতে লেগে পড়েন। গানটির এটি দ্বিতীয় অংশ। তার আগে পর্যন্ত প্রথম অংশেরই সুরটা তৈরি হয়েছিল। বাকিটা হয়ে ওঠেনি। পরে হৈমন্তী শুক্লও সলিলের চরিত্রের এই বিশেষ দিকের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘ভালবাসি বলেই ভালবাসি বলি না’ গানটি একটানা তাঁকে দেননি। দিয়েছেন ধাপে ধাপে।
সাধারণ শ্রোতা হিসাবে যেটুকু কানে পড়েছে, সলিল চৌধুরীর গানে আরও একটা উল্লেখযোগ্য দিক হল তাঁর ছন্দের ব্যবহার। এ বিষয়ে তাঁকে বাংলা গানের সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলা চলে। তাঁর সুরে যথেষ্ট ছন্দোবদ্ধতা লক্ষণীয়। সুরে বিদেশি সুরের প্রভাবও বেশ মধুর। আর শুধু সুরে নয়, প্রিলিউড বা ইন্টারলিউড অংশও বিভিন্ন গানে সাধারণ কানকে ছুঁয়ে যায়। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘এই ঝিরঝির বাতাসে’ বা লতা মঙ্গেশকরের ‘ও ঝর ঝর ঝর্না’-তে যেমন প্রিলিউডে বিদেশি সুর ব্যবহৃত হয়েছে তেমনই ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’-তে আঞ্চলিক সুরকে কাজে লাগিয়েছেন। ‘পথে এ বার নামো সাথী’ গানে মার্চপাস্টের সুরকে কাজে লাগিয়ে হৃদয়স্পর্শী সৃষ্টি করেছেন।
তিনি বম্বে গিয়ে অনেকের সঙ্গে কয়্যার ও আইপিটিএ আন্দোলনে যোগদান করেন। সাঙ্গীতিক প্রতিভা হিসাবে তিনি ছিলেন সততই পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক বাদ্যযন্ত্র সহকারে উপস্থাপনায় বিশ্বাসী। বহু রকম বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে তিনি ছিলেন পারদর্শী। মধুমতীর ‘সুহানা সফর অউর ইয়ে মৌসম হসিন’ গানটি এ আর রহমানের খুবই প্রিয়। বাংলা এবং হিন্দিতে প্রায় সব শিল্পীই তাঁর সুরে গান গেয়েছেন। অনেক সফল হিন্দি ছবির গানে তিনি সুর রচনা করেছেন। খুবই দুঃখের বিষয়, সে কালের বাংলা চলচ্চিত্রে সলিল চৌধুরীকে কিন্তু যথাযোগ্য ভাবে কাজে লাগানো যায়নি।
তনুজ প্রামাণিক, হাওড়া
মুক্তির উল্লাসে
সলিল চৌধুরীর রোম্যান্টিক গানেও পাশ্চাত্য ও ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সমান মিশ্রণ বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। আনন্দ-এ ‘জ়িন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি’ আর রজনীগন্ধা-য় ‘কই বার ইয়ুঁ ভি দেখা হ্যায়’ হিন্দি চলচ্চিত্রের ‘পজ়িশনাল’ এবং ‘টাইমিং সং’ হিসাবে ইতিহাসে থাকবে। বিনোদন জগতে মগ্ন সলিলের সঙ্গে বামপন্থার যোগ প্রসঙ্গে বলা যায়, জনগণকে মানসিক আনন্দে ভরিয়ে দেওয়াও বিরাট মাপের নেতারই পরিচয়। বিনোদন সামাজিক চেতনারও বিকাশ ঘটায়। গণসঙ্গীত হল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ অত্যাচার অনাচারের বিরুদ্ধে গণচেতনাকে উদ্বুদ্ধ করার গান। সেই গণসঙ্গীতকে সঙ্গীতের মূল ধারায় নিয়ে গেলে শুধু রসবিচারেই কালজয়ী কিছু অনবদ্য সৃষ্টি আমাদের স্তম্ভিত করে। কিন্তু সে সবের আলোচনায় শ্রেণিসংগ্রামের কথা বাদ দেওয়া যায় না।
শোনা যায়, ‘গাঁয়ের বধূ’ বা ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ সৃষ্টি প্রসঙ্গে মতভেদের জন্য শেষ পর্যন্ত সলিলের সঙ্গে গণনাট্যের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি নিজের মতো রূপকথা রচনা করতে লাগলেন। হয়তো ভালই হল। না হলে মুক্তির উল্লাসের এই সলিল চৌধুরীকে আমরা হয়তো পেতাম না।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৭
আলোর পথযাত্রী
‘সে যে গান শুনিয়েছিল’ (১৭-১১) শীর্ষক উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কথা ও সুরের জাদুকর সলিল চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সঙ্গীত আকাশের অন্যতম নক্ষত্র রূপে সমাদৃত। সাংস্কৃতিক ইতিহাস বা সামাজিক বিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে তাঁর রচনা। হিন্দি গান, আধুনিক বাংলা গানে কম্পোজ়ার হিসাবে তিনি চিরস্মরণীয়। অন্য ভারতীয় ভাষায় বিশেষত মালয়ালম ভাষার ছবির সুরেও অসংখ্য মণিমুক্তো ছড়িয়েছেন।
কিন্তু এই সাফল্য যতখানি সঙ্গীতবোদ্ধাদের কাছে মূল্যবান, বিনোদনের রঙিন জগতে ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়তো নয়। জীবনে যত পুরস্কার পেয়েছেন, তা সরকারি স্তরের বা বাংলার কোনও সংগঠনের স্বীকৃতি। মাত্র এক বার, ১৯৫৮ সালে,মধুমতী সিনেমার গানের জন্য পেয়েছিলেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদী মিছিলে তাঁর গান শুধু গান ছিল না, নতুন শতকের তরুণ দল তাকে চেতনা জাগরণের বীজমন্ত্র করল। আজও তিনি আমাদের জন্য জেগে আছেন আলোর পথযাত্রী হয়ে।
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy