Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Zero

সম্পাদক সমীপেষু: হৃদয়ের জাগরণ

ভালবাসা কি কখনও শূন্যের প্রতিশব্দ হতে পারে? প্রবন্ধকার লন টেনিস খেলার উদাহরণ সহযোগে দেখিয়েছেন— হ্যাঁ, হতে পারে। ঠিকই তো।

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৪ ০৭:০৬
Share: Save:

ঈশানী দত্ত রায় ‘শূন্য থেকে শুরু’ (২৬-৭) শীর্ষক প্রবন্ধে ‘শূন্য’-এর বিচারে মননশীল হতে বলেছেন। সংবেদনশীলতার সঙ্গে শূন্যকে দেখতে বলেছেন। এই বিশ্বজগতের সব কিছুই পরিমাপযুক্ত। ‘শূন্য-মূল্যায়িত’ জীবনের প্রাপ্তির দার্শনিকতাকে চিহ্নিত করেছে এই প্রবন্ধ। এই ‘শূন্য’কে মাপতে গেলে বিশ্বাসকে জ্ঞানে রূপান্তরিত করতে হবে। সত্য ও যুক্তির মিশেল ঘটাতে হবে। তবেই দহন-দংশন-পীড়ন-পরাজয়জনিত শূন্যতা থেকে মুক্তি পেতে “শূন্য পাওয়ার অধিকার আমার আছে”— এ কথা বলে অনুভব ও ইচ্ছা দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব আমরা। শূন্য-মুক্তির ইচ্ছাই ‘শূন্য’-র সদর্থক রূপ। শূন্য যে-হেতু অনুভূত দুঃখবোধক সংখ্যা নয়, বিবিধ দুঃখজনিত পরিত্রাণের জন্য লড়াই, প্রস্তুতির ‘কাউন্ট ডাউন’, তাই হয়তো ‘শূন্য থেকে শুরু’ বাক্যবন্ধের প্রচলন হয়েছে। ‘শূন্য’ পাওয়া দুঃখের সঙ্গে দুঃখমুক্তির ইচ্ছাটিও এই ‘শূন্য’-ই।

ভালবাসা কি কখনও শূন্যের প্রতিশব্দ হতে পারে? প্রবন্ধকার লন টেনিস খেলার উদাহরণ সহযোগে দেখিয়েছেন— হ্যাঁ, হতে পারে। ঠিকই তো। আমরা যাকে ভালবাসি, তাকে জয় করতে চাই, আপনার করে পেতে চাই। একেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “অনন্তকে অনুভব করারই অন্য নাম ভালোবাসা।” আর বিজ্ঞান তো এই অনন্ত-অসীমকে সংখ্যা দিয়েই প্রকাশ করতে পারেনি। শূন্যের মুখটা যখন নিজের দিকে থাকে, তখন সেটাই ‘লাভ’ বা ভালবাসা। ভালবাসার এই গাণিতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় নিহিত যৌক্তিক ভিত্তিটা হল, ‘হৃত হৃদয়’-এর পুনর্জাগরণ। শরীর ও মনের যন্ত্রণা সমগোত্রভুক্ত নয়। “ভারতীয় দর্শনের ত্রিবিধ দুঃখ ও হ্বিটগেনস্টাইনের জাগতিক দুর্দশা— প্রত্যেকটিই আলাদা আলাদা রকমের দুর্ভোগ”— এ কথা অরিন্দম চক্রবর্তীর আলোচনায় সবিস্তারে পাই। তাই ‘শূন্য’ বিশ্লেষণ নিতান্তই অন্তরবোধের বিষয়। নয়তো সব কিছুই শূন্য (বৃথা) মনে হবে।

পার্থপ্রতিম কুন্ডু, কলকাতা-৫৬

শূন্যের পরিধি

‘শূন্য থেকে শুরু’ শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। জনশূন্য শিলাইদহের প্রকৃতি অবলোকন করে কবির কলম বলে উঠেছিল, “...পূর্ব দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নীচে অনন্ত পাণ্ডুরতা, আকাশ শূন্য এবং ধরণীও শূন্য, নীচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূন্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূন্যতা।” অভিধানের আক্ষরিক অর্থ অনুসারে, রিক্ততার সূচক কিংবা অস্তিত্বহীনতার চিহ্নস্বরূপ জীবন জুড়ে ‘শূন্য’ শব্দের অভিঘাত অসীম। শৈশবের ‘গোল্লা’ অর্থাৎ গোল আঁকতে গিয়ে অপটু হাতে তোবড়ানো বৃত্ত এঁকে আঁকার মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি খাওয়া। আর সারাটা জীবন জুড়ে একটা জেদ চেপে যাওয়া, গোল্লাটা আমাকে ঠিক ভাবে আঁকতেই হবে। শূন্য দিয়ে এ ভাবেই আমাদের জীবনের শুরু। তার পর পথ চলতে চলতে বৃত্তটা বড় হতেই থাকে। সবচেয়ে মজার বিষয়, ‘গোল্লা’রূপী বৃত্তের ঘুরেফিরে সেই একই বিন্দুতে মিলিত হওয়া। গোল (কমলালেবুর মতো) পৃথিবীটাও তো সেই শূন্যেরই প্রতীক। সেখানে কত শত সুকৃত-বিকৃত মানুষকে ভরে দেওয়া হয়েছে। কত মত-পথের তর্ক-বিতর্কে ভরা বিস্তৃত চেতনার পরিসর। শূন্যের পরিধি জোড়া আনন্দ, হাসি, কান্না, বেদনা, পরশ্রীকাতরতা-স্মৃতিকাতরতার রোমন্থন। সব কিছু দিয়ে ভরা একটা বড় ‘শূন্য’।

কবির শিলাইদহের শূন্য ধরণীর অবলোকনে কিছু দিন আগে প্রদর্শনীকক্ষে দেখা এক বিশালাকার ক্যানভাসে শূন্যতার বেদনা অনুভব করেছিলাম। ক্যাডমিয়াম ইয়েলো-র প্রেক্ষাপটে আঁকা এক বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তরের বুকে এক টুকরো জলাশয় ঘিরে গ্রামের মহিলারা আকুল। দূরদূরান্ত থেকে মরুভূমির বুকে জল নিতে আসা অতি ক্ষুদ্র আকৃতির মানুষগুলো যেন চিত্রপট জুড়ে এক অদ্ভুত শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। আবার আষাঢ়ের অঝোর ধারাপাতে রথের মেলায় ঝুড়ি-ভর্তি মাটির পুতুল বেচতে বসা শৈশব কিংবা কোঁচড় ভরা বেলফুলের মালা যখন বিকিকিনির হাটে শূন্য হয়ে যায়, তখন আনন্দের ভুবনেও তো শূন্যতার পূর্ণতা প্রাপ্তি!

‘সব শূন্য হয়ে যায়’ কবিতায় কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “সব শূন্য হয়ে যায় জনতার স্বেদাক্ত আশ্লেষে,/ সব পূর্ণ হয়ে ওঠে আতপতাপিত দীপ্তিভরে,/ সব শূন্য হয়ে যায় সব পূর্ণ হয়ে ওঠে শেষে—/ সব পূর্ণ হয়ে ওঠে শেষে।”

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

সৃষ্টির সূত্র

ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধটি ভালবাসা দিয়ে শুরু। অনেকটা শূন্যতা পরিক্রমা করে, আবার ভালবাসায় ফিরে এল আশ্চর্য এক পূর্ণতায়। বর্তমান বিশ্বের ঘটনাক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যবান প্রবন্ধটিতে পাঠক খুঁজে পেতেই পারেন এক সিম্ফনি। পাইথাগোরাসের ‘দ্য মিউজ়িক অব দ্য স্ফিয়ার্স’ মহাবিশ্বের মহাশূন্য থেকে বিশ্বে অনুরণিত হতে, মাধ্যম হতে পারে ভালবাসা। সেই অনুরণন সঞ্চারিত হতে পারে নাকি মানবমন থেকে মনে?

প্রশ্নটা খুব জরুরি। এখন এই শূন্যগর্ভ সময়ে আরও জরুরি। এই জরুরি কাজটাই করেছেন প্রবন্ধকার। স্বরে-নিঃস্বরে রেখে গিয়েছেন অনেক প্রশ্ন। তাঁর প্রবন্ধ পড়ে আমরা কী ভাবব, যখন কবিকে বলতে হয়, “পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন”, তখন মুমূর্ষু পৃথিবীকে রোগশয্যায় অপেক্ষায় থাকতে হয় একটি ‘কমলালেবু’-র ভালবাসার।

শূন্য কিন্তু কখনও একরৈখিক হয় না। শূন্য গোলাকৃতি। তাই কি শূন্যতা ফিরে ফিরে আসে? শূন্য থেকে পূর্ণ, তা থেকে আবার শূন্য? গণিতের ইতিহাসে ‘শূন্য’ মনে পড়ায়, আর্যভট্ট, মিশর ও ব্যাবিলনের প্রাচীন পৃথিবী। কিন্তু শূন্যের ইতিহাস প্রাচীনতর। তা স্থান পেয়েছে সৃষ্টিতত্ত্বের গভীরে। আলেকজ়ান্ডার ও এক ভারতীয় দার্শনিকের কথোপকথনের সময়ে, আলেকজ়ান্ডারের প্রশ্নের উত্তরে দার্শনিক বলেন, তাঁর কাজ “শূন্যতা অনুভব করা।” দার্শনিক কি সৃষ্টির আদি শর্ত বুঝতে চাইছিলেন?

বৃহদারণ্যক উপনিষদের শ্লোক বলে, সৃষ্টির আগে কোনও কিছুই ছিল না। সে এক না-দিন, না-রাত্রি, না-মৃত্যু, না-জীবন, অসীম শূন্যতা, অবিদ্যমানতা। বিজ্ঞান বলছে, তা হলে কী থেকে হল সৃষ্টি? উপনিষদ বলছে, পূর্ণ অবিদ্যমানতায় বিদ্যমান ছিল ‘অদ্বৈত প্রজ্ঞা’— সেখানেই ছিল শুরুর সূত্র। অদ্বৈত থেকে দ্বৈত হওয়াই হল সৃষ্টির মূল কথা।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, “আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে আসবে যদি শূন্য হাতে”— হাত শূন্য থাকলে তবেই তো ধরা যায় হাত। সৃষ্টি হয় জীবন। আবার জীবনানন্দ যখন বলেন, “সব কাজ তুচ্ছ হয়— পণ্ড মনে হয়,/ ...শূন্য মনে হয়,/ শূন্য মনে হয়”— তখন সে এক ‘বোধ’।

এই বিজন ঘরের শূন্যতা, এই শূন্য মনে হওয়ার বোধ; কিন্তু “শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে” কি না, তা মেপেও দেখে না। মেপে দেখা একটি গাণিতিক প্রক্রিয়া। আধুনিক কোয়ান্টাম বিজ্ঞান ও দর্শনের চিন্তা ও চেতনা, নির্ধারণবাদ পরিত্যাগ করে পাড়ি দিয়েছে সম্ভাব্যতার খোঁজে। এমন এক সম্ভাব্যতা, যা আমাদের শূন্য থেকে পূর্ণতার পথ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনার দিগন্ত দর্শন করায়। সম্ভাবনা মাপা যায় না।

অদ্বৈত থেকে দ্বৈত এবং আবার অদ্বৈতে ফেরা— এ কথা জীবনসত্য। একে আধ্যাত্মিক বলে পুজো করা বা ভাববাদী বলে বর্জন করার থেকে মানবিক ও মনস্তাত্ত্বিক বলে গ্রহণ করলে হয়তো সঙ্গীহারা অসীম শূন্যে শোনা যাবে, “এই লভিনু সঙ্গ তব...”।

অনিরুদ্ধ রাহা, কলকাতা-১০

লম্বা লাইন

মেট্রো স্টেশনে স্মার্টকার্ড রিচার্জের জন্য মেশিন বসানো হয়েছে। যাঁরা সেখানে টাকা দিয়ে কার্ড রিচার্জ করাতে যান, তাঁদের মহা ঝামেলা। নোটে সামান্যতম ভাঁজ থাকলেও মেশিন তা গ্রহণ করতে চায় না। ফলে লাইন দীর্ঘতর হয়।

পামেলা সাহা, কলকাতা-৩২

অন্য বিষয়গুলি:

love Human Psychology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy