শিক্ষালয়গুলি তৈরি হয়েছে পঠনপাঠনের জন্য।
ছাত্রদের শিক্ষক পাঠদান করবেন, এটাই মূল কথা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয় শিক্ষায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণের জন্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে, সেগুলি পরিচালনার দায়ভার স্কুল কর্তৃপক্ষের উপর চাপিয়েছে। প্রধান শিক্ষক তাঁর সহ-শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের মাধ্যমে এই কাজগুলি করতে বাধ্য হন। এই কাজগুলিকে তুলতে গেলে সত্যিই বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষকদের সংগঠন শিক্ষা দফতরের শীর্ষ কর্তাদের চিঠি লিখে বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন।
‘শিক্ষকের কাজ’ (৭-৯) সম্পাদকীয়তে উল্লিখিত বিষয় ছাড়াও অনেক কাজ শিক্ষকদের করতে হয় প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে। এখন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের কাজের যা বহর, তাতে মনে হয় কর্পোরেট অফিসকেও হার মানায়। উচ্চশিক্ষা দফতর বা ডিআই অফিস, কোনও কিছু চেয়ে দু’দিনের মধ্যে জমা দিতে নির্দেশ দেয়। তখন প্রধান শিক্ষক সহ-শিক্ষকদের শরণাপন্ন হন। নয়তো কাজগুলি তোলা সম্ভব নয়। তার জন্য শিক্ষকদের কিছু ক্লাস অফ রেখে কাজ তুলতে হয়। আর এটা বছরে এক বার দু’বার নয়, মাঝেমধ্যেই হয়। ফলে ছাত্ররা পঠনপাঠন থেকে বঞ্চিত হয়। বছরে তফসিলি জাতি/ জনজাতি তালিকা, ওবিসি এ তালিকা, ভর্তির সময় সাহায্য করা, নির্বাচনী কাজে যাওয়া, মহকুমা শাসকের অফিস, ব্লক অফিস, পুরসভার বিভিন্ন কাজে বিদ্যালয়গুলিকে মিটিং-এ উপস্থিত থাকতে হয় এবং তাদের বিভিন্ন সরকারি প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণ করতে হয়। স্কুলের পঠনপাঠন ছাড়াও একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, বিভিন্ন দিবস উদ্যাপন।
সম্পাদকীয়তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তা হল, শিক্ষকদের নির্বাচনী কাজে না লাগানো, যা দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীরা দাবি জানিয়ে আসছেন। এ ছাড়া নির্বাচন বা অন্য কোনও রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কাজে স্কুল ভবনের ব্যবহার অযৌক্তিক। এখন সাইকেল বিতরণের জন্য স্কুল ভবনের একাধিক ক্লাসরুম নিয়ে নেওয়া হয়। এবং এক মাসের উপর এই সাইকেল প্রকল্প চলে। এতেও কিন্তু স্কুলের পঠনপাঠন ও শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়।
শিক্ষা আধিকারিকদের বাস্তবের মাটিতে পা রেখে পরিকল্পনা করা উচিত। কারণ, শিক্ষালয়গুলি তৈরি হয়েছে পঠনপাঠনের জন্য। এটাই মুখ্য হওয়া উচিত, বাকি সব গৌণ।
জয়ন্ত কুমার দেবনাথ, রানাঘাট, নদিয়া
শিক্ষার লক্ষ্য
‘শিক্ষকের কাজ’ সম্পাদকীয়টি বর্তমান সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক। এক জন শিক্ষক বা শিক্ষিকার প্রধান কাজ এবং ধর্মই হল শিক্ষাদান। কিন্তু বর্তমানে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক প্রকল্প চলে স্কুলে। বড় স্কুলে অশিক্ষক কর্মীদের দিয়ে করানো হয়, কিন্তু ছোট এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলিতে শিক্ষকদেরই যাবতীয় কাজ করতে হয়। শিক্ষাদানের দায়িত্বকে সরিয়ে রেখে যদি সবুজ সাথী সাইকেল গুনতে, এবং কন্যাশ্রী ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বানানোর কাজে মন দিতে হয়, তা হলে কি এই সমস্ত প্রকল্প সার্থক হবে? স্কুল-সম্পর্কিত প্রকল্পগুলি চালু করার সঙ্গে সঙ্গে, সেগুলির কোনটি কোন আধিকারিকের দ্বারা পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার শিক্ষা দফতরের। দরকার পড়লে নতুন অস্থায়ী দফতর তৈরি করতে হবে এই সমস্ত কাজের জন্যে। স্কুলের সমস্ত দায়িত্ব শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর চাপানোর মানসিকতার অবসান ঘটাতে হবে। একটি প্রগতিশীল দেশে কোনও রকম ভাবেই শিক্ষাকে ব্যাহত হতে দেওয়া চলে না।
দীপেন্দু দাস , রানাঘাট, নদিয়া
স্কুলের মর্যাদা
সম্পাদকীয় ‘শিক্ষকের কাজ’ পাঠ করে শিক্ষক হিসেবে তো বটেই, সার্বিক ভাবেও সহমত পোষণ করছি। শিক্ষকতা ও স্কুল সামলানোর বাইরে সতেরোটি প্রকল্পের দায় শিক্ষকদের সামলাতে হয়। ফলে শিক্ষকতা ও স্কুল সামলানোর গুরুদায়িত্ব বিঘ্নিত হচ্ছে। শুধু প্রধান শিক্ষক নন, স্কুলের সহকারী শিক্ষকরাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। মোটের উপর শিক্ষা বিষয়টি গৌণ হয়ে যাচ্ছে। এর বিকল্প কী? একবিংশের ভারতে দাঁড়িয়ে এই অবস্থান মেনে নেওয়া যায় না। আবার, ‘স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা সম্পর্কিত সব প্রকল্পই শিক্ষকের দায়িত্ব’— এই অবস্থানও অন্যায্য এবং অবাস্তব। আরও বলা হয়েছে— সরকার বা সরকারপোষিত স্কুলের শিক্ষক ‘সরকারি কর্মচারী’ নন। তাই ভোটার তালিকা তৈরি, নির্বাচন সংক্রান্ত কাজে শিক্ষকদের নিয়োগ, সর্বোপরি পঠনপাঠনে বিঘ্ন ঘটিয়ে রাজনৈতিক প্রশাসনিক কাজে স্কুলভবনের ব্যবহার— এর কোনওটিই শিক্ষার আদর্শের সঙ্গে যায় না। তবে মিড-ডে মিল প্রকল্পের সঙ্গে পড়ুয়াদের উপস্থিতি এবং পড়াশোনার উন্নতির সম্পর্ক আছে বলে এই প্রকল্পের তদারকির দায়িত্ব শিক্ষকদেরই থাকা উচিত। পাঠ্যবই বিতরণও তাঁদেরই কাজ। এই সব ক’টি কথাই একশো ভাগ সত্যি। জামা, ব্যাগ, সাইকেল বিতরণের দায়িত্ব শিক্ষকরা নেবেন কেন? সেগুলো পঞ্চায়েতগুলোর মাধ্যমে দেওয়া হোক।
তবে প্রকল্পগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রে কার কী প্রাপ্য, সেগুলি শিক্ষকরাই উপলব্ধি করতে পারেন। তাই প্রকল্পের কাজগুলো সরকার স্কুলে পঞ্চায়েত কর্মী বা পুরকর্মী পাঠিয়ে সম্পন্ন করুক। সরকার কি এখনও ভাববে না, শিক্ষক সরকারি ‘কেরানি’ নন, ছাত্রকল্যাণের রূপকার?
মহ. ফিরোজ হোসেন, লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
বেআইনি
শিক্ষকদের কী কী কাজে ব্যবহার করা যাবে, তার সুস্পষ্ট আইন থাকলেও শাসক দল তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। আর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক সমাজ প্রতিবাদ না করায় তাঁদের টেবিলে সতেরোটি প্রকল্পের ফাইল জমা হচ্ছে। ২০০৯ সালের শিশুদের বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী, কোনও ‘অ-শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে’ শিক্ষকদের নিযুক্ত করা যাবে না।
তবে সেই সঙ্গে তিনটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ব্যবহার করা যাবে। যেমন— জনগণনার কাজে, দুর্যোগের সময় ত্রাণের কাজে আর নির্বাচনের কাজে। কিন্তু সেই সঙ্গে আইন এই কথাটিও মনে করিয়ে দেয়— ‘শিক্ষকদের পাঠদানের দিন’ বা ‘পাঠদানের সময়’ নিযুক্ত করা যাবে না, তবে ‘ছুটির দিনে’ এবং ‘অ-শিক্ষণকালীন সময়ে’ ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই আইন মানা হয় কি? বিদ্যালয় চলাকালীনও শিক্ষকদের গ্রাম/শহর ঘুরে ঘুরে ‘ভোটের কাজ’ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কেন্দ্রের শাসক দল নতুন শিক্ষানীতির মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সঙ্ঘের আদর্শে রূপায়িত করার উদ্যোগ করেছে। আর রাজ্যের শাসক দল বিদ্যালয়গুলিকে ‘প্রকল্প সেন্টার’ তৈরি করে শিক্ষকদের ব্যতিব্যস্ত রাখছে। ফলে, পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা আর মৌলিক অধিকার থাকছে না। স্কুলগুলিকে প্রকল্প সেন্টার বানানোর সুদূরপ্রসারী কুফল কিন্তু ফলতে শুরু করেছে এই রাজ্যের শিক্ষায়, যা আগামীতে পশ্চিমবঙ্গকে একটি বিষবৃক্ষে পরিণত করবে। ইতিমধ্যেই যার আভাস দেখা দিতে শুরু করেছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী কলেজের চৌকাঠ পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে না। ২০১৮ সালে শুধুমাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩১টি ডিগ্রি কলেজের চল্লিশ হাজার আসন ফাঁকা ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে ঐকান্তিক অনুরোধ— ‘দাও ফিরে সে শিক্ষাঙ্গন, লও এ প্রকল্প’।
চণ্ডাল বিশ্বাস, চাকদহ, নদিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy