Advertisement
০১ ডিসেম্বর ২০২৪
Joy Goswami

সম্পাদক সমীপেষু: না পাওয়ার বেদনা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে বিপুল রচনাকর্ম সেখানে জয় গোস্বামী পরীক্ষা-নিরীক্ষা যা-ই করুন না কেন, পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ কি আসতে পারেন কখনও!

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:৫৫
Share: Save:

অভীক মজুমদার ‘অণু থেকে অতিকায়’ (৯-১১) প্রবন্ধে এক জায়গায় লিখেছেন, “রবীন্দ্রোত্তর কালে আর কোন কবি এত ধরনের আঙ্গিক-কাঠামোর নিরবচ্ছিন্ন প্রয়োগে নিজেকে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন?” এই জিজ্ঞাসায় ধন্দ লাগে। তুলনার একটা পরিসীমা বোধ হয় থাকা উচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে বিপুল রচনাকর্ম সেখানে জয় গোস্বামী পরীক্ষা-নিরীক্ষা যা-ই করুন না কেন, পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ কি আসতে পারেন কখনও!

তা ছাড়া আলোচ্য কবি বগটুই থেকে কামদুনি, এমনকি সুদূর দিল্লির নির্ভয়ার নারকীয় কাণ্ড নিয়ে কবিতায় সরব হয়েছেন, কিন্তু আর জি কর কাণ্ডে তিনি নীরব থেকেছেন। তাঁর আত্মদহন অন্তত সেই সময় প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। কখনও কখনও আত্মধিক্কার মলিন হলেও তা ভবিষ্যতে কবিকে পুনরাবিষ্কার করতে সাহায্য করে। কবিকে বাঙালি যত রকমের সম্মান ছিল দু’হাত ভরে উজাড় করে দিয়েছে। সুতরাং তা নিয়ে হয়তো অপ্রাপ্তি, অভিমান কবির থাকতে পারে না। যা পারে, তা হল কবির নতুন কবিতা না পাওয়ার আক্ষেপ। শুধু পাঠকের প্রত্যাশার মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, নিজের জন্যই নতুন কবিতা আসুক, পাঠকের তো এটাই চাওয়া।

শ্যামলজিৎ সাহা, চুঁচুড়া, হুগলি

হিরণ্ময় নীরবতা

‘অণু থেকে অতিকায়’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। কবি জয় গোস্বামী লিখেছেন, “সৌন্দর্যকে আমার জীবনে এনে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গানের মধ্যে ধরা আছে আমার প্রেমের ধারণা। প্রথম তারুণ্যে, যখন কোনও নারী আসেনি জীবনে, তাঁর যে গান শুনতে শুনতে প্রস্তুত হয়ে উঠতাম না-আসা ভালবাসার জন্য, অপেক্ষা করতাম— আজ সেই একই গান শুনতে শুনতে দূরে চলে যাওয়া ভালবাসাকে দেখতে পাই।... আমার মা বাবা ভাইয়ের সঙ্গে শৈশবে, আমাদের পরিবারের এক জন হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমার বাবা বসাতেন গান কবিতার আসর, শ্রোতা ও দোহার ছিলাম আমি আর আমার ভাই। আর এখন বাড়িতে, আমাদের একটি সদস্য আছে তার নাম গিতো। গীতবিতান।” (‘নিজের রবীন্দ্রনাথ’, জয় গোস্বামী। দেশ, ২-৫-২০০৪)

কবি প্রাত্যহিক জীবনের স্মৃতিকথা ভাগ করে নিতে গিয়ে বলেছেন, “১৯৬২ সালের জুলাই মাস ছিল সেটা। সারাদিন বৃষ্টি হয়ে সন্ধেবেলা ধরে এসেছে। আকাশস্লেট রঙের কালো থেকে একটু উজ্জ্বল। সূর্য নেই। আমার মা কবিতা পড়ছিল সঞ্চয়িতা থেকে উচ্চারণ করে করে। আমার মায়ের কিন্তু কবিতা-টবিতা পড়ার ঝোঁক একেবারেই ছিল না। সারা দিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হত তাকে। গল্পের বই পড়ত। কবিতা কখনও নয়। তবে সেদিন মা পড়ছিল কেন?...”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির জীবন জুড়ে অনুভবের চরণধূলিতে কবিকে ঋদ্ধ করেছেন। দেশ-এ (১১-৩-১৯৯৫) প্রকাশিত ‘নির্বাক কবিতা ও উচ্চারিত ছবি’ শীর্ষক প্রবন্ধে মনসিজ মজুমদার লিখেছেন, “...কাব্য যে শব্দে গাঁথা সৌধ— ‘শিল্প রচে বাক্যের গাঁথুনি’— এ কথা অনেক কাল থেকে স্বীকৃত। যদিও আধুনিক ‘গাঁথুনিতত্ত্ব’ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, কাগজে লিপিবদ্ধ হবার পর কাব্যকৃতিকে মনে করা হচ্ছে সতত স্বরাট, কবির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই, কবি-নির্দিষ্ট কোনও একক অর্থ নেই, এমনকি কবিতার বাইরের জগতের সঙ্গে তার কোনও সংযোগ নেই। ফর্মালিস্টদের থেকে কাব্যের এই নন্দনভাবনা শুরু হয়েছে।”

কবি জীবন জুড়ে অনুভবের আখরে শব্দে গাঁথা এক-একটি সৌধ রচনায় মগ্ন থাকেন। বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্ররাজির অন্যতম একটি জ্যোতিষ্কের নাম জয় গোস্বামী। শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘দেখার দৃষ্টি’ প্রবন্ধে (২০১১) লিখেছেন, “আমি কি তাঁরই অবস্থান থেকে, তাঁরই অবস্থানে নিজেকে রেখে, তাঁর দিকে তাকাবার কথা ভেবেছি? আর তা যদি না ভাবি তাহলে আমার সেই দেখা একটা খণ্ডিত দেখা, সেই মানুষটিকে আংশিক ভাবে দেখা, এমনকী, হয়তো-বা ভুল-দেখাও।”

প্রাত্যহিক কাজের ভিড়ের মধ্যে বা অভ্যাসের মধ্যে থেকে এমনই সব ভুল-দেখাতেই সময় চলে যায়। এ ভুল-দেখা কোনও ব্যষ্টিতেই আটকে থাকে না, স্বভাবতই তা গড়িয়ে যায় সমষ্টি পর্যন্ত। অন্যকে বা অন্যদের দেখবার সময়ে আমরা বড় বেশি তাকে নিজের দিক থেকে দেখি, নিজেরই অভিজ্ঞতা থেকে, নিজেরই স্বার্থবৃত্ত থেকে নিজেকে অল্পমাত্রাতেও সরিয়ে নেওয়ার জন্য যে মানসিক সময়টুকুর দরকার, তার খুব অভাব আমাদের জীবনে।...

কবির দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজের জীবনের ছায়া রেখাপাত করে। ধিক্কারে, ক্রোধে, বেদনায়, হাহাকারে, আত্মদহনে, প্রতিরোধে, ঘৃণায় এবং আশ্বাসে। অণু থেকে অতিকায় হয়ে ওঠেন কবি। ভারতে পারমাণবিক বোমার নিষ্করুণ পরিহাসে কবির অনুভব মুক্তি খোঁজে। ‘মা নিষাদ’ কবিতায় কবি লিখেছেন, “অস্ত্র মাটিতে, অস্ত্র আকাশগামী/ দিগন্ত রাঙা অস্ত্রের মহিমায়/ রাঙা অস্ত্রের কিরণ পড়েছে জলে/ গ্রন্থসাহেব নদীজলে ভেসে যায়।”

‘হরিণের জন্য একক’ কবিতায় কবি আত্মসমালোচনায় মেতে ওঠেন— “সোনার হরিণ এখন নিজেই এসে আমার গোয়ালে ঢুকে ব’সে আছে/ ঘাসপাতা খাচ্ছে/ আমি আর দৌড়ব কার পেছনে?/ একলাইন কবিতা পেতে একবছর এগারো মাস লেগে যায়/ একটা বাচ্চা পেটে এসে, জন্মে, হাত-পা নেড়ে হাঁটতে শিখে গেল,/ আধো আধো ভাষা বলছে— আর আমার?/ আজও ডিকশনারিকে ডিকশনারি বলার সাহস হ’ল না/ শচীনদেবকে শচীনদেব/ কেবল হ্যাঁ, দিয়ে দেব, দিচ্ছি, ব’লে/ রাবিশ, ওঁচলা, আবর্জনা বেলচা ক’রে তুলে তুলে জমা করছি/ গ্রন্থের পর গ্রন্থে...”

প্রতিবাদী কবি জীবনের দীর্ঘ পরিক্রমায় ইন্দিরা গান্ধী হত্যা, নকশালবাড়ি আন্দোলন থেকে নেতাই, নন্দীগ্রাম, কামদুনি, হাঁসখালি, বিলকিস বানো দেখেছেন। আবার এই ২০২৪-এর শারদ প্রাক্কালে এসে দেখলেন আর জি করে মর্মান্তিক মৃত্যু। কলকাতায় এক কিশোর বন্ধুর জন্মদিনে অন্য বন্ধুর পেটে ভাঙা কাচের বোতল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সাংবাদিক কবিকে কিশোর মনের অন্ধকার দিকগুলি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে কবি বলেছিলেন, বর্তমান প্রজন্মের অন্তরমহল তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনিই ২০২৪ সালে জানিয়ে দেন, আপাতত স্থগিত রইল তাঁর রচনা প্রকাশ। তবে, ‘অনুশীলন’ চলবে।

আমার মনে হয়, এই সময় বঙ্গভূমের পরিবর্তিত রূপের আচরণে বাষ্পরুদ্ধ কবি অন্তরালকেই বেছে নিয়েছেন। বর্তমান সমাজের হতাশজনক আচরণে ব্যথিত কবি স্বেচ্ছা নির্বাসনের ব্রত গ্রহণ করেছেন। তাই বাঙালির অন্যতম অতন্দ্র কবির প্রতি দায়বদ্ধতার নিরিখে সমাজের সূক্ষ্ম অনুভূতি জুড়ে তাঁরই কবিতার অনুরণনই হতে পারে তাঁর প্রতি আন্তরিক সমবেদনার শরিক হয়ে ওঠা। বাঙালির অনন্য এক কবি শঙ্খ ঘোষকে এক সময় শাসক দলেরই দোর্দণ্ডপ্রতাপ এক নেতা তীব্র কুকথা শুনিয়েছিলেন— রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে মর্মে তাঁর বাক্য সে দিন কবিকে ব্যঙ্গকবিতা লিখতে প্রণোদিত করেছিল বলে। তাই রাজনৈতিক পরিবেশের অসহিষ্ণুতার কথা মাথায় রেখেই হয়তো কবি অদ্ভুত আঁধার ঘনিয়ে আসা এই সমাজে নিজেকে প্রকাশ না করে অনুশীলনের পাতাতেই আবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত তো দুর্মর আশাবাদেই আস্থা রাখতে হয়।

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

বিপদের বান্ধব

‘দৈন্যদশা’ (১৯-১১) সম্পাদকীয়তে এই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশার কথা এসেছে। ‘কম্পোজ়িট গ্রান্ট’-এর টাকা না আসায় সরকারি বিদ্যালয়গুলির পঠনপাঠন ব্যবস্থা শিকেয় উঠেছে! এই বিদ্যালয়গুলি কিন্তু ‘নস্টালজিক’ মনোভাবাপন্ন প্রাক্তনীদের দ্বারস্থ হতে পারে। অভিজ্ঞতা বলছে, অস্তিত্ব ও আর্থিক সঙ্কট থেকে রেহাই পেতে অনেক বিদ্যালয়ই সাম্প্রতিক কালে তাদের ‘প্রাক্তনী সংগঠন’-এর সাহায্যপ্রার্থী হয়েছে।

অমরেশ পাল, ব্যান্ডেল, হুগলি

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy