Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
Threat Culture

সম্পাদক সমীপেষু: দৈনন্দিন শাসানি

হুমকিকে হাতিয়ার করেছে যুগে যুগে ক্ষমতাসীন শাসক। কিন্তু শাসক তো চিরন্তন নয়। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখনীতে ধরা পড়ে সেই সত্য— “রাজা আসে যায় আসে আর যায়/ শুধু পোষাকের রং বদলায়/ শুধু মুখোশের ঢং বদলায়।”

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:০৯
Share: Save:

রত্নাবলী রায়ের ‘মনের উপর ভয়ের আঘাত’ (১৭-১০) প্রবন্ধে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের প্রসঙ্গে ‘থ্রেট কালচার’ শব্দবন্ধটি উঠে এসেছে। ভয় দেখানোর সংস্কৃতি, হুমকি প্রথা বা ‘থ্রেট কালচার’— যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন, মানুষের ন্যায্য অধিকারকে খারিজ করার এক মোক্ষম হাতিয়ার এটি। বাস্তবিক, আজ স্বাস্থ্য বিভাগের গণ্ডি ছাপিয়ে তার কালো হাত পৌঁছেছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে বিনোদন সর্বত্র। তবে উল্লেখ্য, এই হুমকি প্রথা বা ভয় দেখানোর সংস্কৃতি সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই ছিল। সেই দশম-দ্বাদশ শতাব্দী চর্যাপদের যুগেও তার চিহ্ন দেখি। সেনযুগে ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের হাতে বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়কে শুধু হুমকি নয়, হেনস্থাও সইতে হয়। সে কারণে তাঁরা ছদ্মনামে পদ রচনা করেছেন। সেনযুগের শেষ লগ্নে তুর্কি আক্রমণ ঘটে যাওয়ায় অন্ত্যজ হিন্দুদের ধর্মান্তরিত হতে হয়। মধ্যযুগ জুড়ে শাসকের শাসানিতে বাক্-স্বাধীনতা হারিয়েছিল সাধারণ মানুষ। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে লোভাতুর ভাঁড়ু দত্তকে আমরা দেখেছি। আর সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে— শাসকের কথা, শাসকের আস্ফালন। এই ছত্রছায়ায় যারা থাকে, তারাও হুমকি প্রদর্শনে কম যায় না। হুমকিতে মাথা নত না করলে ডেকে পাঠানো, বাড়ির সদস্যদের রাস্তাঘাটে নাকাল করা এখন দৈনন্দিন ঘটনা। বিচার-সালিশের নামে ভীতি প্রদর্শন আর শারীরিক নির্যাতন চলছে। এমনকি ঘরের মেয়ে-মায়েদেরও এর থেকে পরিত্রাণ নেই। ক্ষমতার অশ্লীল আস্ফালন সর্বত্র। ফলে হুমকির শিকার সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মানসিক ভাবে শুধু ধ্বস্ত নয়, মনোরোগীতে পরিণত হতে পারে। ভারতের ইতিহাসে দেখা যায়, এই হুমকির শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি দলিত সম্প্রদায় আর সংখ্যালঘু মানুষ।

হুমকিকে হাতিয়ার করেছে যুগে যুগে ক্ষমতাসীন শাসক। কিন্তু শাসক তো চিরন্তন নয়। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখনীতে ধরা পড়ে সেই সত্য— “রাজা আসে যায় আসে আর যায়/ শুধু পোষাকের রং বদলায়/ শুধু মুখোশের ঢং বদলায়।” একে এড়ানোর উপায় কি নেই? ক্ষমতাসীন মানুষদের মনের চলাচলটা সর্বজনীন করে তুলতে হবে। কেবল শিক্ষিত হলে হবে না, শিক্ষার প্রকৃত আলো পেতে হবে। হৃদয়ে সন্ধ্যা নামলে সেখানে আলো জ্বালিয়ে রাখুন, তা হলেই অবসান ঘটবে ভয় দেখানোর সংস্কৃতির। কতিপয় ব্যক্তি গোটা পৃথিবীটাকে গিলে খেতে চায়, সেই ইচ্ছা থেকেই হুমকি প্রথার জন্ম। জনসাধারণের জন্য তা থেকে মুক্তি আনতেই হবে।

সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪

ভয়ের জীবন

রত্নাবলী রায় যথার্থই বলেছেন যে, ‘থ্রেট কালচার’ বা হুমকি প্রথার ব্যাপ্তি সর্বত্র, এমনকি জাঁকিয়ে বসেছে আমাদের মনের মধ্যেও। কর্মসূত্রে আমি বিগত ২৬ বছর ধরে প্রবাসী বাঙালি। যদিও শহর-ঘেঁষা মফস্‌সল অঞ্চলে কেটেছে আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের কিছুটা সময়। আমার স্ত্রীয়েরও বৈবাহিক জীবনের প্রথম দশটি বছর এই মফস্‌সল শহরেই কেটেছে। তাই পাড়ার সমস্ত লোকই আমাদের প্রায় পরিচিত।

৭১ বছরে উপনীত বসতবাড়িতে অনুষ্ঠিত দুর্গাপুজোতে এ বারও গিয়েছিলাম। দশমীতে নিজেদের পুকুরে ভাসানের পর অনেক রাতে ফিরছিলাম বসতবাড়ি থেকে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়িতে। সামনে আমার স্ত্রী, দিদি, পিছনে আমি, জামাইবাবু। গলি, তস্য-গলি পেরিয়ে বাড়ির কাছে প্রায়ান্ধকার মোড়ের কাছে পৌঁছতেই, হুট করে এক মোটরসাইকেল আরোহী, বয়স কুড়ি-বাইশ হবে, স্ত্রী-দিদির সামনে ব্রেক কষে অশালীন মন্তব্য করে এবং কুপ্রস্তাব দেয়। তাৎক্ষণিক ঘটনাতে স্ত্রী একটু ঘাবড়ে গেলেও প্রতিবাদ করে বলে ওঠেন, “আপনি কি আমাকে চেনেন? এ রকম আজেবাজে কথা বলছেন কেন?” ছেলেটি কিছু প্রত্যুত্তর দিতে গিয়েছিল, আমি এ বার পিছন থেকে এগিয়ে আসি। সে অন্ধকারের জন্য আমাদের দেখতে পায়নি। “তুমি আমার ছেলের থেকেও ছোট। ঝামেলা কোরো না”, বলে স্ত্রী এবং দিদিকে এগিয়ে যেতে বলি। এই ঘটনাটি আমি পাড়ার কমিটিকে জানাতে পারতাম। কিন্তু জানাইনি, কারণ একটি ভয়বোধ কাজ করেছিল। কয়েক দিনের জন্য আমার জন্মস্থানে এসেও ভয় পেয়ে আলটপকা ঝামেলা এড়াতে চেয়েছিলাম। জেনেবুঝেই অন্যায় করলাম। এখন থাকি বরোদাতে। এই শহরেও কিছু অঘটন ঘটেছে। তা সত্ত্বেও আমার স্ত্রী নিশ্চিন্তে তার বান্ধবীদের নিয়ে রাত একটা-দুটোতেও ঘুরে বেড়ায়, নিজের গাড়ি নিয়ে।

আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে ভাই জানায়— এক জন স্থানীয় প্রোমোটারের লোকজন বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হুমকি দিচ্ছে। পৈতৃক বাড়িটি বেদখল হয়ে যেতে পারে। আমি তখন আবু ধাবিতে থাকি, ভাইও কর্মসূত্রে রৌরকেলা। আমার উপস্থিতিতেই পৈতৃক বাড়িটি একটু-একটু করে তৈরি হয়েছিল। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে। তবু বাড়ি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে তাকে ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়িতে পরিণত করা হল। একই কারণে, দাদুর বানানো আদিবাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটে পরিণত করা হল। এই প্রচ্ছন্ন হুমকি কিন্তু নতুন নয়। ভয়ের রাজ্যে আমরা বাস করেছি সেই কংগ্রেস আমল থেকে নকশাল আন্দোলনের সময় পর্যন্ত। এর পর বাম আমলের সময় যে ভয় দেখানো, গুন্ডারাজ শুরু হয়; সেটি এখন পরিণত হয়েছে নৈরাজ্যে। রাজ্য সরকার এবং পুলিশবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদতে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে দিয়ে যথেচ্ছাচারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

তবে সম্প্রতি আর জি কর কাণ্ডের পর ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করলেও, এখনও পর্যন্ত এটি সীমাবদ্ধ রয়েছে শহরের মধ্যেই; গ্রামাঞ্চলে এখনও এই হুমকি প্রথা বিরাজমান। যার প্রত্যক্ষদর্শী আমি স্বয়ং। তাই সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন পুষ্ট এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে গেলে, আমার মতো অনেকেরই প্রয়োজন ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।

সুপ্রিয় দেবরায়, বরোদা, গুজরাত

আলোকদ্যুতি

রত্নাবলী রায়ের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই চিঠি। ‘থ্রেট কালচার’ শব্দবন্ধটি সম্ভবত আর জি করের তরুণী ডাক্তারের মর্মান্তিক পরিণতির পর বিশেষ ভাবে ব্যবহারিক প্রয়োগে স্থান করে নিয়েছে। যেখানেই একচেটিয়া ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়, সেখানেই দেখা যায় ক্ষমতার সীমাহীন আস্ফালন। তার কেন্দ্রই হল থ্রেট কালচার বা হুমকি সংস্কৃতির উৎপত্তিস্থল। বীরভূমের এক জেলা সভাপতি যখন পুলিশের ডিআইজি-র মুখের উপর আঙুল তুলে বলেন— আধ ঘণ্টা সময় দিলাম, এর মধ্যে বিরোধী শিবিরের সকলকে গ্রেফতার না করলে তিনি সব ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবেন, সেটা কি হুমকি প্রথা নয়? সন্দেশখালির ‘বেতাজ বাদশা’ শেখ শাহজাহান যখন সাধারণ মানুষের চাষের জমি কেড়ে নিয়ে, তাতে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকিয়ে মাছের ভেড়ি তৈরি করেন, অথবা মহিলাদের শাসক দলের গভীর রাতের মিটিং-এ যেতে বাধ্য করেন, তখন কি মনে হয় না— এটা কেমন প্রশাসন! এই হুমকির প্রথাকে কাজে লাগিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান কতখানি অত্যাচারী হয়ে উঠতে পারে, আর জি কর কাণ্ড তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এই ত্রাসের সংস্কৃতি কেউ মেনে নেন, আবার কেউ পারেন না। যাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তাঁদের কেউ কেউ নিজেকেই শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। হুমকি সংস্কৃতি এমন আত্মঘাতী ভয়কে মূলধন করে দাপিয়ে বেড়ায় দাঁত-নখ বিকশিত করে। আর জি কর কাণ্ডের পর প্রতিবাদে প্রতিরোধে এগিয়ে আসা মানুষের আন্দোলন আশা জাগায়, ভরসা দেয়। এই জনজাগরণই মেঘের আড়ালে সেই আলোকদ্যুতি, যেটা শেষ করে দিতে পারে এই ভয়ের সংস্কৃতি ও স্পর্ধিত আস্ফালনকে।

দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy