ঠিক যেন আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্প। মূল্যবান সোনার জিনিসপত্র ধীরে ধীরে নিজের বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলেন ওই শ্রমিক। সব সম্পদ একাই ভোগ করার মতলব এঁটেছিলেন তিনি। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যে, সেটি কলম্বিয়ার অজানা আদিবাসী সংস্কৃতির একটি সমাধি। এদের হাইপোজ়িয়াম বলা হত। সাধারণত এগুলি সমাধিস্থল বা উপাসনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত প্রাচীন সভ্যতায়।
ঘটনাটি ১৯৯২ সালের। কলম্বিয়ার কাউকা উপত্যকার পালমিরা অঞ্চলে অবস্থিত হ্যাসিন্ডা মালাগানায় এক আখের খামারে। ১৯৯২ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সোনা সন্ধানকারীদের একাধিক দল হ্যাসিন্ডা মালাগানার আখের খেতে এসে পৌঁছোয়। সংবাদপত্রের বিবরণ অনুসারে, সোনা ও গুপ্তধন লুটেরাদের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার।
পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও সোনা লুণ্ঠন ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে। বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় প্রশাসন। তাঁদের চোখের সামনে দিয়ে হাইপোজ়িয়ামটি নির্মম ভাবে এবং সম্পূর্ণ রূপে লুট করা হয়। সেই ঘটনায় এক জন খুনও হয়েছিলেন বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর। গুপ্তধন অনুসন্ধানকারীরা অসংখ্য নিদর্শন নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল শত শত সমাধি।
এক একটি স্বর্ণনির্মিত মূর্তি বা পাতের ওজন ছিল কমপক্ষে ১৬০ কেজি। আবার কয়েকটি সূত্র বলছে, খাঁটি সোনার নিদর্শনগুলির ওজন ১৪০ কেজি থেকে ১৮০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। ১৯৯২ সালের শেষের দিকে বোগোটার জাদুঘরে অপরিচিত নকশায় তৈরি সোনার জিনিসপত্রের এক চিত্তাকর্ষক ভান্ডার তৈরি হয়। এই নিদর্শনগুলির উৎস ছিল মালাগানার এই বহুচর্চিত আখের খেতের নীচে থাকা হাইপোজ়িয়ামটি।
১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে কর্তৃপক্ষ মালাগানায় লুটপাটের বিষয়ে সতর্ক হয়। মার্চ মাস থেকে ‘ইনস্টিটিউটো ভ্যালেকাউকানো ডি ইনভেস্টিগেসিওনেস সিয়েন্টিফিকাস’ এবং ‘ইনস্টিটিউটো কলম্বিয়ানো ডি অ্যান্ট্রোপোলজিয়া’-এর প্রত্নতাত্ত্বিকেরা যুগ্ম ভাবে স্থানটি খনন করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই কাজও ব্যাহত হয় লুটেরাদের জন্য।
প্রধান কবরস্থানের সমাধি থেকে চুরি যাওয়া নিদর্শনগুলি যতটা সম্ভব খুঁজে বার করে পুনরুদ্ধার করার জন্য একটি অভিযান শুরু করেন হ্যাসিন্ডা মালাগানার জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। এই প্রচেষ্টার ফলে ১৫০টিরও বেশি মূল্যবান জিনিসপত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল। সোনার জিনিসপত্রগুলি দেখতে অসাধারণ। যাঁরা এগুলি তৈরি করেছিলেন তাঁদের সম্পর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায়নি সমাধিগুলি ধ্বংস করে ফেলার ফলে।
জাদুঘরে সংরক্ষিত নিদর্শনগুলির মধ্যে রয়েছে একটি বিশেষ সোনার যন্ত্র। প্রাচীন কলম্বিয়ার পুরুষেরা তাঁদের মুখের লোম অপসারণের জন্য এই যন্ত্রটি ব্যবহার করতেন বলে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন। সোনার তৈরি যন্ত্রটি হয়তো আচার-অনুষ্ঠান বা অনুষ্ঠানের সময়ও ব্যবহার করা হত। এই ধরনের যন্ত্রের একাধিক সংস্করণ প্রতি দিন ব্যবহার করা হত।
স্বতন্ত্র মূর্তিনির্মাণ শৈলীর অধিকারী মালাগানার অধিবাসীরা সূক্ষ্ম সেরামিকের কাজে পারদর্শী ছিলেন বলে মনে করা হয়। সেই শিল্প নিদর্শনগুলির বেশির ভাগই সাদা বা টেরাকোটা রঙের। তাঁরা বড় বোতল, পাত্র এবং বাদ্যযন্ত্র, ওকারিনা তৈরি করতেন। লুটপাটের প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রতিবেদন এবং জাদুঘরে থাকা অবশিষ্ট নিদর্শনগুলি বিবেচনা করে গবেষকেরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তাঁদের সোনা ও রুপোর কাজ স্পষ্টতই অসাধারণ ছিল।
মালাগানায় ৩ মিটার গভীর একটি আয়তক্ষেত্রাকার সমাধি আবিষ্কার করেন প্রত্নতাত্ত্বিকদলটি। সমাধিক্ষেত্রের মেঝেয় মৃতদেহটি সোজা করে রাখা ছিল। মুখে ছিল তিনটি বড় সোনার পাতার মুখোশ। সেগুলি একটি অন্যটির উপরে রাখা ছিল। ঘাড়ের অংশে নলাকার সোনার পুঁতি ও একটি ছোট সোনার পাখি ছিল। সমাধিতে পাওয়া গিয়েছে রঙিন পাথরের পুঁতির মালা, খোদাই করা পান্না।
বোগোটার ‘মিউজিও দেল ওরো’ জানিয়েছে যে, ১৯৯২ সালের শেষের দিকে মালাগানা থেকে লুট হওয়া কিছু সোনার জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল। প্রায় ১৫০ টুকরো মালাগানা সোনা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। প্রায় ৫০ কোটি পেসো (তৎকালীন মূল্য তিন লক্ষ ডলার) খরচ করে লুণ্ঠনকারীদের থেকে নিদর্শনগুলি সংরক্ষণ করা হয়। উদ্ধার করা নিদর্শন এবং গবেষকদের তথ্যের ভিত্তিতে হাইপোজ়িয়াম থেকে ২৯টি মালাগানা সমাধি পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং প্রেক্ষাপট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy