‘যাদবপুরে ধুন্ধুমার’ (২-৩) প্রতিবেদনটি পড়ে শিউরে উঠলাম। অভিযোগ উঠেছে, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী যিনি সমগ্র ছাত্রসমাজের অভিভাবক, তিনি এক জন শিক্ষার্থীকে গাড়ি-চাপা দিয়ে চলে যাচ্ছেন! আসলে শিক্ষামন্ত্রী বা নাট্যব্যক্তিত্ব যা-ই হোন, তিনি তো শাসকই, তাঁর ‘শিক্ষা’ দেওয়ার কায়দা বা আঙ্গিক তো তাঁর দলের মতোই হতে হবে!
এই ঘটনা একটি শিক্ষা তো বটেই! অনেকেই এক কালে বিস্মৃত হয়েছিলেন যে, এ রাজ্যের শাসক দল হল একটি দক্ষিণপন্থী ও স্বৈরাচারী রাজনৈতিক শক্তি, যারা পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারক-বাহক। আর স্বৈরাচার থেকে ফ্যাসিবাদের ব্যবধানই বা কতটুকু? দমনপীড়ন আর দখলদারির প্রবৃত্তিই তো শাসকে শাসকে জোটবন্ধন ঘটিয়ে চলে। আর, স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেই তো ফ্যাসিবাদের প্রবণতা নিহিত থাকে। গত সাত দশকের ইতিহাসে বার বার দেখা গিয়েছে যে ‘গণতন্ত্র’ নামক মুখোশটি ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে এসে এ দেশের বহু শাসকই নিজেদের স্বৈরাচারী চরিত্র দেখিয়েছেন, আর আজও সেই ধারা অপরিবর্তিত আছে। সাধারণ মানুষের সমস্ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে দমন করে তাঁদের শোষণ ও লুণ্ঠন করাই তো এঁদের অন্যতম লক্ষ্য। সে দিনের লখিমপুর খেরির কৃষক হোক বা আজকের যাদবপুরের ছাত্র, প্রতিবাদ করলে দমনপীড়ন অত্যাচারের মুখে পড়তেই হবে। তথাকথিত ‘গ্রেটার ইভিল’ হিন্দুত্ব-ফ্যাসিস্টদের মতোই অন্যান্য স্বৈরাচারী দলও এই শোষক সমাজব্যবস্থার ধারক ও বাহক, তারা অত্যাচারী শাসকশ্রেণিরই একটি প্রতিনিধি। তাই এরাও এ দেশের ছাত্র-যুব-জনতার শত্রুতা করেই চলেছে। এ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তো শাসকেরই প্রতিনিধি, তাই তিনিও প্রতিবাদী শিক্ষার্থীকে পীড়নের কথাই ভাববেন। এতে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই!
অঞ্জনা চৌধুরী, দাউদপুর, পূর্ব মেদিনীপুর
লজ্জাজনক
‘যাদবপুরে ধুন্ধুমার’ প্রতিবেদনে বর্ণিত সাম্প্রতিক ঘটনা সত্তরের দশকের স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। রাজ্যের এত নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এত বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য আমাদের কাছে লজ্জার। আন্দোলন-প্রতিবাদের অনেক গণতান্ত্রিক পথ আছে। কিন্তু কাউকে ঘিরে ধরে, শারীরিক আক্রমণ সমর্থনযোগ্য নয়। যে ভাবে শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি ঘিরে ধরে ক্ষিপ্ত আচরণ করা হচ্ছিল তাতে ১৯৭০-এর ডিসেম্বর মাসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারত।
সমস্ত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হওয়া উচিত, এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা দরকার, সে সম্বন্ধেও কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু তার জন্য হিংসার আশ্রয় নেওয়াকে কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। সত্তরের দশকে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছিল না, ছিল না হাতে হাতে ক্যামেরা, ছিল না এত সহজে ভিডিয়ো তোলার সুবিধা, কিন্তু বর্তমান সময়ে তো আছে। ফলে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও প্রকৃত ঘটনার বেশ কিছু অংশ সাধারণ মানুষের গোচরে আসে।
অনেকেই বলছেন ছাত্র-ছাত্রীদের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেওয়া কখনওই কোনও মন্ত্রীর কাজ হতে পারে না। তাঁর উচিত ছিল গাড়ি থেকে নেমে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলা, কিন্তু টিভিতে দেখে মনে হল ওই মুহূর্তে গাড়ি থেকে নামলে তাঁর বিপদ হতে পারত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চিরকালই মেধাবী ও প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য দরজা খুলে রেখেছে। তাঁদের প্রগতিশীল ভাবধারা, মুক্তচিন্তা সমাজকে পথ দেখায়। তাঁদের মেধার কারণে সারা বিশ্ব তাঁদের সমাদর করে। তাঁরা সারা দেশের গর্ব, কিন্তু তাঁদের এ কী রূপ দেখা গেল!
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার মান এখন তলানিতে ঠেকেছে। যে ক’টা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও টিমটিম করে রাজ্যের মুখে আলো ফেলে, যাদবপুর তার মধ্যে অন্যতম। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শাসক-বিরোধী দ্বন্দ্বে যদি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়, তবে তা হবে নিজের পায়ে কুড়ুল মারার সমান। এই ঘটনা নতুন করে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার জরাজীর্ণ দশা আর এক বার চোখের সামনে তুলে ধরল। যাদবপুর-সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্য নেই। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যপালের অনধিকার হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা দফতর ও রাজ্যপালের বিরোধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মৃত্যুশয্যা থেকে বাঁচিয়ে তুলতে গেলে সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও সরকারকে এগিয়ে এসে হাল ধরতে হবে।
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
এ তাঁর ব্যর্থতা
যাদবপুর থেকে প্রেসিডেন্সি, বর্ধমান থেকে কল্যাণী— সব জায়গায় এক নীতি চলছে। শিক্ষকদের অপমান করা, প্রতিবাদী ছাত্রদের দমন-পীড়ন চলছে নিরলস ভাবে। শিক্ষামন্ত্রী এ সব রুখতে ব্যর্থ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা সেটাই প্রমাণ করল। যাদবপুরের উপাচার্যকে শাসক দলের পছন্দের লোক দিয়ে বদলানোর চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ। ছাত্র আন্দোলন দমনের জন্য সরকারি মদতে বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে আনার কথা শোনা যাচ্ছে। সবই শিক্ষাঙ্গন দখলের রাজনীতি। অধ্যাপকদের অসম্মান প্রদর্শনের নানা ঘটনার সাক্ষী হয়েছে রাজ্যবাসী। শাসক দলের বিরুদ্ধে কথা বললেই বদলি বা চাকরি হারানোর ভয়। যোগ্যতা নয়, রাজনৈতিক আনুগত্যই এখন শিক্ষকদের পদোন্নতির মাপকাঠি।
রাজ্যে শিক্ষার মান একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। সরকারি স্কুলগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ যে ছাত্ররা বেসরকারি স্কুলে চলে যাচ্ছে। বহু স্কুলে বিজ্ঞান, গণিত বা ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক নেই। শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় শিক্ষকদের উপর অতিরিক্ত চাপ রয়েছে, যার ফলে শিক্ষার মানও নামছে। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপর রাজনৈতিক দমনপীড়ন চলছে, যার ফলে গবেষণায় মনোযোগ দিতে পারছেন না অনেকেই। বহু প্রতিভাবান শিক্ষক ও গবেষক পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে অন্য রাজ্যে বা বিদেশে চলে যাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নষ্ট করা হয়েছে। শাসক দলের ইচ্ছামতো উপাচার্য নিয়োগ করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়ছে। বিশ্বমানের শিক্ষা দূরের কথা, এখন পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জাতীয় স্তরে র্যাঙ্কিং-ও খারাপ হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলে শক্তিপ্রদর্শন, শাসক দলের দখলদারি, গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার মান নেমে যাওয়া, শিক্ষকদের দমন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ— এত কিছুর পরও শিক্ষামন্ত্রী যদি নিজেকে সফল মনে করেন, তা হলে তা রাজ্যের পক্ষে চরম দুর্ভাগ্যজনক।
প্রতাপ চন্দ্র দাস, সরকারপাড়া, নদিয়া
ট্রেনযাত্রা
ভারতীয় রেল ইতিহাসের নানা উত্থানপতনের সাক্ষী। শৈশবে প্রথম রেল দেখার অভিজ্ঞতা সকলেরই স্মৃতিতে বিশেষ জায়গা করে নেয়। আবার দেশভাগের তিক্ততার সাক্ষী থেকেছে এই রেলগাড়ি। আজও নিশ্চিন্ত মনে এবং স্বল্প খরচে যাত্রা করার জন্য ট্রেনকেই বেছে নেন দেশবাসী। কিন্তু বর্তমানে সেই ট্রেনযাত্রাই জনসাধারণের কাছে হয়ে উঠেছে চরম বিভীষিকা। কারণ রেল-দুর্ঘটনা এখন রুটিন হয়ে গিয়েছে।
যাত্রী-সুরক্ষার জন্য উন্নততর পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তা ছাড়া নজর দেওয়া উচিত অবৈধ বা বিনা টিকিটের যাত্রীদের দিকেও। এঁদের অন্যায়ের কারণে বৈধ যাত্রীও অনেক সময়ে বিড়ম্বনার মুখোমুখি হন। আজও ভারতীয় রেল সারা দেশের মানুষের কাছে বড় গর্বের বিষয়। কেন্দ্র ও প্রতিটি রাজ্যের সরকার এবং তার সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও কিছু কর্তব্য রয়েছে ভারতীয় রেলের প্রতি। প্রশাসন ও মানুষের সহযোগিতাতেই রেলের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখা সম্ভব।
সৌমিক ঘটক, বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)