‘অতঃপর’ (২৩-১০) সম্পাদকীয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবোচিত। জনমনে এখন একটি প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে, এর পর কী? আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে দেশব্যাপী প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল একটি দাবিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি আন্দোলন, সমগ্র নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ, অনশন কর্মসূচির দৃঢ়তা এবং প্রশাসনের অনড় অবস্থান রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সামগ্রিক ভাবে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হল দুর্নীতি। নবান্নে আলোচনায় দু’-চারটি বিষয়ের আশু সমাধান হলেও, দুর্নীতির প্রতিরোধে বিশেষ কিছু উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। উপরন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সহিষ্ণুতার অভাব, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগকে গুরুত্ব না দেওয়া, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাধান্য না দেওয়ার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকারের অবস্থান কী!
বয়সে তরুণ, অনভিজ্ঞ ডাক্তারবাবুদের আন্দোলন অরাজনৈতিক হলেও মুখ্যমন্ত্রীর অভিজ্ঞ, কৌশলপূর্ণ রাজনীতির চাতুর্যে তাঁদের পিছিয়ে আসতে হয়েছে। আবেগ, উন্মাদনা, কৃচ্ছ্রসাধন করে শক্তিশালী শাসকের বিরুদ্ধে যে বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া যায় না, তা ডাক্তারবাবুরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন। তাঁরা এটাও বুঝেছেন যে, এই সরকার দুর্নীতির সঙ্গে আপস করে টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর। তাই সর্বব্যাপী দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হলে দরকার সচেতন, স্বচ্ছ, রাজনৈতিক গণ-আন্দোলন। ভয়হীন, প্রতিবাদী মানুষকে ভিত্তি করে ভবিষ্যতের দিকে ডাক্তারবাবুদের এগিয়ে যেতে হবে।
সারনাথ হাজরা, হাওড়া
চাই ঐক্য
“রাজনৈতিক বুদ্ধি ছাড়া প্রতিস্পর্ধা সার্থক হতে পারে না”— ‘অতঃপর’ সম্পাদকীয়তে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের পর এক অমোঘ উপসংহার। প্রবন্ধে শেষে ভবিষ্যতের সংগ্রামের দিশা ও পথ সযত্নে পরিবেশিত হয়েছে। চিকিৎসক সমাজ ও বৃহত্তর সচেতন নাগরিক সমাজ তা সম্যক উপলব্ধি করলে সমাজের অবশ্যই কল্যাণ হবে। অনেক কুৎসা, অনিশ্চয়তা, অত্যাচার, নিপীড়ন যেমন এই আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করেছে, তেমনই সুশীল সমাজের সাহচর্য ও অভূতপূর্ব জনসমর্থন মিলেছে। এই আন্দোলনে নারীরা ছিলেন প্রধান ভূমিকায়। রাজনীতির সঙ্কীর্ণ বৃত্তের উপরে উঠতে পেরেছে এই আন্দোলন। ঘটনার অব্যবহিত পরেই শাসকের স্পর্ধা, সত্য ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার বুদ্ধিহীন অপচেষ্টা দেখা গিয়েছে। ভোটে জেতার শাসকসুলভ দম্ভ আস্ফালন যত দেখা গিয়েছে, অভয়ার বিচারের দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের লড়াই ততই আরও দৃঢ়বদ্ধ ও বলশালী হয়েছে। যুক্ত হয়েছে সমগ্র চিকিৎসক সমাজের প্রতিবাদী স্বর। যে নাগরিক সমাজ আপাতদৃষ্টিতে উদাসীন, তার মধ্যেই দেখা গিয়েছে অভূতপূর্ব প্রতিরোধ, প্রতিবাদের সুনামি।
তবুও অভয়ার বিচার আজও অধরা। আর জি কর কাণ্ড ও তার পরবর্তী ঘটনা দেখে মনে হয় যেন শাসক তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা থেকে সরে এসেছেন, স্বৈরতন্ত্রের পথ দেখাচ্ছেন। ঘাতক, ধর্ষক, তোলাবাজদের বরাভয় দিচ্ছেন। আর জি করের যে ছাত্র-চিকিৎসকরা বাহুবলী দুষ্কৃতী বলে বহিষ্কৃত, তাদের ‘ঘর ওয়াপসি’-তে যেন শাসক সর্বাধিক খুশি! এ ক্ষেত্রে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গেল, কিন্তু গণতান্ত্রিক, ভয়মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত হল কই?
‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ এখনও অধরা। অভয়ার খুনি, ষড়যন্ত্রকারীদের সকলকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। মেডিক্যাল শিক্ষার হিমালয়-সম দুর্নীতি, স্বাস্থ্যের দুরবস্থা, এ বিষয়গুলি নিয়ে যদি সরকারকে চেপে ধরতে হয়, সংশোধনী ব্যবস্থা করতে বাধ্য করতে হয়, তা হলে চিকিৎসক-জনসাধারণ ঐক্য সুদৃঢ় করে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর যাঁরা ভুক্তভোগী, রোগী ও তাঁর পরিজন, তাঁদেরও এই জনস্বাস্থ্য রক্ষা আন্দোলনের শরিক করে নিতে হবে। কোনও আদালত, পুলিশ, আধিকারিক মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার সহায়ক হতে পারেন না। শাসক যখন জন-আন্দোলন সংহারী ও লুটেরা, তোলাবাজ, খুনি, ধর্ষক, সমাজবিরোধীদের রক্ষাকারী, তখন সচেতন, সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন দরকার। যথার্থ রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় প্রভাবিত ও পরিচালিত জনতার আন্দোলন, এবং আদালতই পারে দুর্বিনীত শাসকের সঠিক স্থান নির্ধারণে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে।
বিনয় ভূষণ বসু, কলকাতা-১২
জনজাগৃতি
বিগত দু’মাসের অধিক সময় ধরে রাজ্যে জনপথে, জনপদে যে অ-পূর্ব নানা ঘটনা ঘটে চলেছিল, সেগুলি প্রথা বহির্ভূত। এগুলি নিয়ম ভেঙেছে এবং ব্যতিক্রম গড়েছে। ‘অতঃপর’ বিচার-বিশ্লেষণের আলো ফেলেছে আন্দোলনের ও শাসকের অন্ধকার দিকে। এখন প্রয়োজন সংশয়ীর প্রশ্নের প্রতি প্রশ্রয় দেওয়ার, এবং অপ্রিয় সত্যকে গ্রহণ করার ইচ্ছা। তেমন কিছু অপ্রিয় সত্যের উত্থাপন করা হয়েছে দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ ‘দেখার অনেক বাকি’-তে (২৪-১০)। সে দিনের প্রশাসক, আজকের বিরোধী দল, এ সব কৃতকর্মের উত্তর এড়িয়ে গিয়েছে বলেই তাদের এখনকার গভীর চলা গোপন থাকে। অপ্রকাশ্যে আন্দোলনে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলে। একই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য এই সরকারের অতলস্পর্শী দুর্নীতি। বাম আমলে সরকারি চাকরিতে অনুগতদের নিয়োগ করার যে প্রথা তৈরি হয়েছিল, যা ‘অনিলায়ন’ বলে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, তা থেকে মুক্তির অভিপ্রায়েই রাজ্যের মানুষ সরকারকে বদল করেছিল ২০১১ সালে। তাই, পুরনো সরকারের কুকর্মকে মনে করানোর যুক্তি পাওয়া কঠিন।
এক তরুণী চিকিৎসকের হত্যার অভিঘাতে যে আলোড়ন শুরু হয়, তাতে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। এর ফলে অনেক বাঁধাধরা তত্ত্ব যেমন পড়েছে প্রশ্নের মুখে, তেমনই অনেক সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, চলমান রাজনীতির প্রতি সাধারণের অনাস্থা উত্তরোত্তর বাড়ছে। তা জেনেও শাসকের আধিপত্য বিঘ্নিত হয় না। কারণ, দল-বহির্ভূত কোনও অহিংস, ধারাবাহিক জন-উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না সমাজে। মৌরসিপাট্টার এই নিশ্চয়তা নাগরিক আন্দোলনের ধাক্কায় বেসামাল। সমাজজীবনের নানা ক্ষেত্রে দুরবস্থার জন্য চলমান রাজনীতিকে দায়ী করা, সঙ্কটমোচনে সমস্ত রাজনৈতিক দলে অনাস্থা— এগুলি বর্তমান জনবিক্ষোভের বৈশিষ্ট্য। এই অনাস্থা ফের আস্থায় ফিরবে কি না, সময়ই বলবে।
দ্বিতীয়ত, অবস্থান, ধর্না, বিক্ষোভ, ঘেরাও-ভিত্তিক সংঘর্ষের রাজনীতির বাইরেও যে আন্দোলনের পদ্ধতি, প্রকরণ থাকতে পারে, ক্যাডার, দলীয় সমর্থকদের বাইরে থাকা মানুষ যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অদলীয় কার্যক্রমে যোগ দিতে পারেন, এবং তার উদ্যাপন যে রাত-বিরেতেও হতে পারে, তার বেনজির দৃষ্টান্ত রাখছে এই আলোড়ন। রাজনৈতিক দল চাইলে শিখতে পারে, অনুপ্রবেশের চেষ্টা না করে।
তৃতীয়ত, অপরাধচক্রে এমন ব্যক্তিরাও রয়েছেন, যাঁদের শিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে উচ্চ-আদর্শসম্পন্ন, সর্বজন-মান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এমন ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকেও কী করে এই ধরনের স্বার্থসর্বস্ব মানুষেরা আত্মপ্রকাশ করছেন, তা ভাবনার বিষয়! শেষে বলতে চাই, গত দু’মাসের নাগরিক আন্দোলনের প্রকৃত প্রাপ্তি ছক-ভাঙা নতুন ধারণা ও আন্দোলনের নতুন প্রকরণের প্রকাশ। সাধারণের আত্মশক্তির জাগৃতি ও সংযমের উদ্বোধন। এই জাগৃতিকে স্থায়িত্ব দিতে চাইলে এ বার বিক্ষোভ নির্মাণ সম্প্রসারিত করতে হবে। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে প্রয়োজন অঙ্গীকার গ্রহণ, ও তাকে স্থির লক্ষ্যে পরিণত করা। শুধু বিরোধিতায় সেখানে মোক্ষ সম্ভব নয়। এই শহর থেকে আরও অনেক দূরে, প্রান্তজনের সখ্যে সেই সেতু রচনা করতে হবে।
মানস দেব, কলকাতা-৩৬
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy