বহু জায়গায় মানুষ নিজেরাই গুন্ডা, ভোট লুটেরাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যের সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটে যে অভূতপূর্ব হিংসা, সন্ত্রাস, রক্তপাত হল, তাতে মানুষ স্তম্ভিত ও লজ্জায় অধোমুখ। নির্বাচনকে এই রকম প্রহসন ও উপহাসের বিষয় করে তোলার দায় অবশ্যই রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের। পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটি যাতে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয় এবং সব প্রার্থী ও ভোটদাতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, সেই লক্ষ্যে প্রতিটি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবিতে হাই কোর্টে অনেক মামলা হয়েছে। হাই কোর্ট নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও, ভোটের দিন কার্যত কোথাও তাদের দেখা মেলেনি। বহু জায়গায় মানুষ নিজেরাই গুন্ডা, ভোট লুটেরাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ফলে আক্রমণ প্রতি-আক্রমণে শাসক-বিরোধী উভয় দলের কর্মীই হতাহত হয়েছেন। গ্রামবাংলার ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ-হেন বেনজির হিংসা, সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার এই ঘৃণ্য কৌশল ভবিষ্যতে রাজ্যের শাসক দলকে অনেক বড় ক্ষতির মুখে দাঁড় করাবে।
এ বারের ভোটের সঙ্গে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের একটা বড় ভেদ হল, ২০১৮-য় শাসক দলের দুষ্কৃতীরা অবাধে একতরফা সন্ত্রাস করে পার পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ বার মানুষ সাহস করে ভোট লুটেরাদের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বিশেষত মহিলারা ছিলেন অকুতোভয়। মানুষের এই অপমান, ক্ষোভ আগামী ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ভোটবাক্সে যদি শাসকের বিরুদ্ধে যায়, তবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
এর সঙ্গে আর একটা বিষয় অবশ্যই উঠে আসবে— কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতা থেকে বিজেপিকে হটানোর জন্য বিরোধী জোট গঠনের প্রস্তুতি। মোদী সরকারের আমলে দেশের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক ব্যবস্থা বিপদের মুখে। অতএব গণতন্ত্রকে বাঁচাতে সব গণতন্ত্রে আস্থাশীল দলের জোট বাঁধা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে কিছু দিন আগে পটনায় দেশের ১৫টি বিরোধী দলের কনক্লেভ-এ এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো, যিনি এই বিরোধী জোট গঠনের অন্যতম পুরোধা, বলেছিলেন, মোদী সরকার ২০২৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরলে দেশে আর নির্বাচন হবে না। অতএব গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে বিরোধীদের একজোট হতেই হবে। কিন্তু তিনিই যখন রাজ্যের ক্ষমতায় থাকার জন্য মরিয়া হয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করেন, তখন তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। এই প্রশ্নে জোট গঠন প্রক্রিয়ায় বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেসের কর্তৃত্ব অনেকাংশে খর্ব হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যা নেত্রীর উচ্চাশাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। তৃণমূল দলের ভাবমূর্তি অন্যান্য দল, বিশেষত কংগ্রেস ও বামপন্থীদের পক্ষে সমস্যার সৃষ্টি করবে। ভবিষ্যতে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তোলা যথেষ্ট কষ্টকর হবে।
এতে লাভ হবে বিজেপির। এমনিতেই বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রস নিয়োগ দুর্নীতি-সহ বিবিধ আর্থিক দুর্নীতি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে জনসমর্থন। আর তাতেই ভীত হয়ে তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে যে মরিয়া হয়ে উঠছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ এই পঞ্চায়েত ভোট। ভুললে চলবে না, মিথ্যার উপর ভর করে মানুষকে বোকা বানানোর কৌশল দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
দেবকী রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়, উত্তরপাড়া, হুগলি
শকুনের ডানায়
বাংলায় শকুনের ডানায় ভর করে ভোট আসে। এই বছর পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার পর থেকেই যে হানাহানির সূত্রপাত হয়েছিল, সেটা চরমে উঠল ভোটের দিন। স্রেফ অন্য দল করার ‘অপরাধ’-এ এক দল আর এক দলের কর্মীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিকেশ করল তাঁদের। রক্তে লাল হয়ে গেল মাটি। বুথে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন বাইরে থেকে আসা ভোটকর্মীরা। রাজ্যে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ চলতে লাগল একটার পর একটা মৃতদেহ মাড়িয়ে। স্রেফ ‘বডি’ হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পরিচিতি নির্ধারিত হল তাঁদের সদ্য ছেড়ে যাওয়া পার্থিব দলের নাম দিয়ে। খেলার স্কোরের মতো পলকে-পলকে পরিবর্তন হতে লাগল আহত-মৃতের সংখ্যা।
যাঁরা মারলেন আর যাঁরা মরলেন, তাঁরা সকলেই অতি সাধারণ কর্মী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নেতাদের পিছন পিছন ঘুর ঘুর করে এলাকায় সম্ভ্রম আদায় করার বিনিময়ে দাদার রাজনৈতিক জোর বাড়ানোর কাজ করেন তাঁরা। তাঁরাই মারেন, মরেন। নেতা মরেন না, সে বড় থেকে ছোট, যে স্তরের নেতাই হোন না কেন। রাজনৈতিক জীবনে তাঁরা অমরত্ব বরের অধিকারী। মারামারি বা বিক্ষোভের সময় পাহারাদারের দল এঁদের ঠিক অকুস্থল থেকে বার করে নিয়ে যান। জিঘাংসা নিয়ে ‘প্রতিরোধ’-এ নেমে পড়েন হতভাগ্যরা। মরলে খবর হন। তাঁর স্ত্রী-মায়ের কান্না সাংবাদিকতার বিষয় হয়ে ওঠে। এর মাঝখান দিয়ে ভেসে যায় এক-একটা পরিবার। এই ক্ষতির পিছনে নির্বাচন কমিশন, সরকারের বিভিন্ন স্তরের নেতারা কম দায়ী নন।
পশ্চিমবঙ্গের ভোট বরাবরের মতো এখনও এক দিনের ম্যাচ। আদালত, রাজ্যপাল, কেন্দ্রীয় সরকার ম্যাচ জেতাবে না। খেলায় পারদর্শী না হলে ভোটের দিন থেকে ছিঁচকাঁদুনে শিশুর মতো নাকিকান্না কেঁদে যাওয়াই ভবিতব্য।
পার্থ নন্দী, শেওড়াফুলি, হুগলি
হিংসার বীজ
পঞ্চায়েত ভোটের যে ভয়াবহ চিত্র টিভির পর্দায় প্রত্যক্ষ করলাম, তাতে আমরা বাংলায় আছি, না আফ্রিকার সোমালিয়ায়, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। পাশের বাড়ির লোক, যাঁর সঙ্গে আগামী কাল সকালেই দেখা হবে তাঁর প্রতি এত হিংসা কেন। এর প্রতিফলন— এক দিনে ১৮ জনের মৃত্যু ও আহত প্রায় ৩০০ জন। বেসরকারি মতে অবশ্য আরও বেশি। এ ছাড়া আছে ভোট পূর্ববর্তী হিংসা ও ভোট পরবর্তী খতিয়ান।
নেতানেত্রীরা সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে এই হিংসার বীজ মানুষের মনে বপন করে গিয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়াবহ বেকারত্বের কারণে সরকারের উপর নির্ভরতা। নিরক্ষরতা, জাতপাত আর প্রশাসনের চরম ঔদাসীন্য অনুঘটকের কাজ করেছে। একটাই রুপোলি রেখা— রাজ্যপালের সংবেদনশীল ভূমিকা। সময়ের দাবি এখনই সমস্ত দলকে এক মঞ্চে এসে হিংসার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে হবে। সমাজের সামনের সারির মানুষ, তিনি ডাক্তার হন বা ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বুদ্ধিজীবী, সবাইকে জেলায় জেলায় রাস্তায় নেমে মিছিল করতে হবে। পুলিশকে রাজনীতির কারাগার থেকে মুক্তি দিতে হবে। পঞ্চায়েত ভোটের এই সন্ত্রাসের খবর ছড়িয়েছে প্রবাসেও। তাই সম্প্রতি এক প্রবাসী বন্ধুর মেসেজ পেলাম ‘সন্ত্রাসে এগিয়ে বাংলা’।
রণজিৎ মুখোপাধ্যায়, মুড়াগাছা, নদিয়া
ব্যালট কেন
নানা টালবাহানার মধ্যে অনেক দেরিতে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন হল। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যত রকমের অপকৌশল ছিল তা এই নির্বাচনে প্রয়োগ করা হয়েছে পেশিশক্তির মাধ্যমে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ধাপে ধাপে আধুনিক হয়েছি আমরা। বিজ্ঞানের কল্যাণে বিদ্যুৎ, মোটরগাড়ি, মোবাইল ফোন— কত কী সুবিধা পেয়েছি। গত ৫০ বছরে চিকিৎসা ব্যবস্থা যা উন্নতি করেছে, তা এক কথায় চমকপ্রদ! তা হলে পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য ব্যালট পেপারে ভোট করার সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হল? যেখানে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ভোটারের ভোট দেওয়ার ব্যাপার আছে, সেখানে আধুনিক মেশিনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। শুধু তা-ই নয়, এক স্থানের ভোট অন্য কোনও জায়গায় কড়া পুলিশি ব্যবস্থায় করা যেতে পারে কি? হোমসেন্টার হলে যে হাঙ্গামার আশঙ্কা বাড়ে, তা এতে অনেকখানি কমানো যেতে পারে।
অরুণ কুমার সেন, কলকাতা-১৯
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy