—ফাইল চিত্র।
ভারতীয় সংখ্যাগুরু জনমনে বিজেপির দুর্বার সম্প্রসারণ বস্তুত এক সাংস্কৃতিক উত্থান— প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘দেশ জুড়ে মন্দির’ (১৮-১) শীর্ষক প্রবন্ধের এই বিশ্লেষণ বিজেপির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যকে আলোকিত করেছে। যে কোনও ধর্মেই ধার্মিক অপেক্ষা ধর্মভীরু মানুষ বেশি। এই সংখ্যাধিক্যের মনকে লক্ষ্য করে যে দল রাজনৈতিক কর্মসূচি নেয়, তার এক প্রচ্ছন্ন গ্রাহ্যতা, মান্যতা থাকে। বিজেপি-রাজনীতির রণকৌশলে আছে দু’টি দিক, সংঘর্ষ ও নির্মাণ। ‘ব্র্যান্ড মোদী’ ঢক্কানিনাদে যা প্রচ্ছন্ন রাখা হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মতাদর্শ অনুসারী শাখা সংগঠনের মাধ্যমে সারা দেশে বনবাসী, জনজাতি, মহিলা, ছাত্র ও অন্যান্য বর্গে নিরন্তর সামাজিক কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন দলীয় ব্রতীদের লেগে থাকা। এটা নির্মাণের দিক। সঙ্গে থাকে গোমাতা, এনআরসি, সিএএ, সিভিল কোড নিয়ে সংঘর্ষের অভিমুখ। মোদী, শাহ, আদিত্যনাথ যতটা দৃশ্যমান, অদৃশ্যে আছে ধারাবাহিক নেপথ্য কর্মযজ্ঞ। তাকে উপেক্ষা করে, বা প্রতিস্পর্ধী কর্মসূচি না নিয়ে, বিজেপিকে শুধু কথা দিয়ে আক্রমণ করে বা রাজনৈতিক জোট তৈরি করে পর্যুদস্ত করা সুকঠিন। ‘ইন্ডিয়া’ জোটটি পরস্পর-নির্ভরশীল। নিছক একা এঁটে না উঠতে পেরে, একটি অমিত শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকিয়ে যেন তেন প্রকারেণ বাজিমাতের কৌশল। সুসংগঠিত একটি দলের সঙ্গে ঢিলেঢালা, চূড়ান্ত স্বার্থপর একটি ঘোঁটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
বিজেপি রাজনীতির বিপরীতে যাঁরা আছেন, তাঁদের কোনও নির্মাণমূলক কর্মসূচি নেই। মানুষকে স্বাবলম্বী করার কর্মসূচির কথা রবীন্দ্রনাথ উত্থাপন করেছিলেন, ও অনুশীলন করেছিলেন। ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, বিদ্যা, স্বাস্থ্য ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ অধিকাংশের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উপায় সর্বসাধারণের হাতে থাকা চাই। অর্থাৎ সরকার পক্ষ, কর্তৃপক্ষ, মালিকপক্ষের হাতের বাইরে সর্বসাধারণের হাতেও থাকবে উপায়। সমাধান হবে গণ-উদ্যোগে, যা বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি অনুশীলন-যোগ্য মনে করলে, প্রতিপালক সমাজে আজ থাকত চিকিৎসালয়, শিক্ষাসত্র, অন্নসত্র, সমবায় ব্যাঙ্ক, যৌথ খামার। এই জনস্পর্শী কর্মসূচি দাঁড়াতে পারত ধর্মীয় কর্মসূচির বিরুদ্ধে। যা না থাকায়, কেউ দিল্লিতে ‘সুন্দরকাণ্ড’ পালন করছেন, কেউ এখানে অন্য কোনও মন্দির বানাচ্ছেন। সেই জন্যই রাহুল গান্ধীর পৈতে ধারণ বা শিব ভক্তির ঘোষণা— এ সবই প্রতিপক্ষের দেখানো পথে চলা, হোঁচট খেতে, বা মুখ থুবড়ে পড়তে।
মানস দেব, কলকাতা-৩৬
শুধু বিভাজন
প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। আমরা এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। গোটা দেশ জুড়ে যখন হাসপাতাল ও বিদ্যালয় নির্মাণের প্রয়োজন, তখন মন্দির ও মসজিদ নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশে ১০০০ মানুষ পিছু ০.৫টি হাসপাতালের বেড আছে। ন্যূনতম প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো আমাদের গ্রামীণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নেই। ২০২৩ সালের শিক্ষা সংক্রান্ত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দেশের গ্রামাঞ্চলের ১৪-১৮ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীদের ২৫% নিজের মাতৃভাষায় লেখা পাঠ্যবই পড়তে হোঁচট খায়। গ্রামের এই বয়সের ৫০ শতাংশ ছেলেমেয়ে সাধারণ ভাগের অঙ্ক করতে গিয়ে আটকে যায়। অথচ, আমাদের রাজ্য ও দেশে হাজার হাজার সরকারি বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের এই বেহাল অবস্থার পরিবর্তন করার পরিবর্তে অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা, ও তার সঙ্গে দেশ জুড়ে নানান দেব-দেবীর মন্দির নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে। আসলে শাসক চান, জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো মন্দির আর মসজিদের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকুক। ঠিক এই পদ্ধতিতেই ব্রিটিশরা দু’শো বছর ধরে আমাদের দেশকে শাসন করেছেন।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
অপরাধ নয়?
‘ধর্ম নয়, রাজনীতি’ (১৬-১) সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিভাজনের রাজনীতির সুর চড়বেই। তাকে প্রতিহত করতে হবে। এত দিনে স্পষ্ট যে, ভারতীয় রাজনীতি থেকে ধর্মের মুদ্রাদোষ যাওয়ার নয়।
প্রশ্ন হল, ধর্মভিত্তিক বিভাজনকারী রাজনীতি যখন দারিদ্র, ক্ষুধা, অপুষ্টি, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বাসস্থানের অব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, এমন সমস্ত মৌলিক সমস্যার মূলোৎপাটন করতে পারে না, তখন পুরো বিষয়টিকে শুধুমাত্র ‘ধর্মের মুদ্রাদোষ’ হিসাবে চিহ্নিত করাটা সব দিক দিয়ে কতটা সমীচীন? এ ক্ষেত্রে এমন ধর্মান্ধ আচরণকে সরাসরি নীতিহীনতা ও অন্যায় হিসাবে কি প্রতিপন্ন করা যায় না?
মন্দিরকে কেন্দ্র করে ‘হিন্দুরাজ’-এর ধ্বনি তোলা জাতীয়তাবাদী মেরুকরণের রাজনীতি, যা শোষণ-বিধ্বস্ত জনসাধারণের দৃষ্টির অভিমুখকে ঘুরিয়ে দেয়। বর্তমানে এ দেশে গরিবের শোষণ, তাঁদের প্রতি বৈষম্যের মাত্রা বে়ড়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষুধা সূচকে ২০১৪ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ৫৫। ২০২৩ সালে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারত ১১১তম স্থান পেয়েছে, যা ‘গুরুতর’ ক্ষুধার মাত্রাকে নির্দেশ করে। ক্ষমতায় আসার আগে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বছরে ২ কোটি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’-র তথ্য অনুসারে, গ্রামীণ এলাকায় বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণে ২০২৩-এর অক্টোবরে ভারতের বেকারত্বের হার দু’বছরের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। আর একটি অসরকারি সমীক্ষায় পাই, ১৫-৩৪ বছর বয়সি ৩৬% ভারতীয়ের কাছে বেকারত্বই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের সমীক্ষা বলছে, এ দেশে প্রতি ১০০ জন স্নাতকের মধ্যে ১৩ জনই বেকার।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্ট অনুসারে, মোদী সরকারের আমলে (২০১৪-২০২২) কৃষিক্ষেত্রে ঘটেছে ১,০০,৪৭৪টি আত্মহত্যা। প্রতি দিন গড়ে ৩০ জন কৃষক ও দিনমজুর আত্মহত্যার পথকে বেছে নেন প্রধানত ঋণের ভারের জন্য। ভারতে শিশুশ্রমিকের সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমাগত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুসারে, ভারতে ৫-১৪ বছরের প্রায় ১ কোটিরও বেশি শ্রমজীবী শিশু রয়েছে। ইউনিসেফ-এর তথ্য অনুসারে, গোটা বিশ্বের ১৬ শতাংশ শিশুশ্রমিক ভারতের। ২০১৫ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্প’ শুরু হলেও, আজও দেশের বহু মানুষের বাসস্থান খোলা রাস্তার ধারে, রেল স্টেশনে বা ঝুপড়িতে।
এনসিআরবি-র রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ২০২১ সালে প্রতি ঘণ্টায় ভারতে দলিতদের বিরুদ্ধে ছ’টি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে। ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দলিতদের বিরুদ্ধে ৫০,২৯১টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছিল। ২০২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০,৯০০। দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চেহারাও প্রকট। অসরকারি সংস্থা ‘অক্সফ্যাম’-এর রিপোর্ট অনুসারে, মাত্র ১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে ভারতের ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ। খাদ্য, জ্বালানি, চিকিৎসা খরচ-সহ সব কিছুর মূল্যবৃদ্ধির ফলে সমাজের দরিদ্র লোক প্রবল যন্ত্রণার মুখে।
এমন ক্রান্তিকালে, মন্দিরকে জড়িয়ে হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় বাতাবরণে রাজনৈতিক ভাবে রাষ্ট্রীয় বিকাশের সার্বিক জয়যাত্রাকে মেলে ধরাটা কোনও কল্যাণকামী রাষ্ট্রের কাছে কতটা কাম্য? গণতন্ত্রে ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ অবশ্যই একটি জরুরি বিষয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় দেশের দীর্ঘ কালের এমন কঠিন ব্যাধিকে যদি রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতা কায়েমের স্বার্থে ব্যবহার করে, ধর্মকে তুরুপের তাস হিসাবে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো কাজে লাগাতে থাকে, তবে কি একে সরাসরি কঠিন অপরাধ হিসাবে অভিহিত করা যায় না?
পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy