ঈশানী দত্ত রায়-এর সুললিত গদ্যে রচিত ‘শুধু রূপকথা আর চুপ কথা’ (১৮-৭) আমাকে স্মরণ করায় ফ্রাঙ্কো-বিরোধী স্পেনীয় নাট্যকার হোসে রুইবাল-রচিত মানুষ ও মাছি নাটকের কথা। স্বৈরাচারী শাসক এক কাচের গম্বুজে বাস করে। তার শাসনের ধারাবাহিকতা অটুট রাখার জন্যে সে তার মতো অবয়বের এক যুবককে চাবুক মেরে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিচ্ছে, যাতে অপরিবর্তনীয় নিয়মকানুন বজায় রেখে দেশ শাসন করতে পারে। কেমন ভাবে অর্ধ-মানব অর্ধ-সারমেয় দাস সেবা করে যাবে অনন্তকাল, তা-ও সে দেখে। কিন্তু এক দিন হঠাৎ একটি মাছি গম্বুজে প্রবেশ করায় ওরা স্তম্ভিত এবং ভীত হয়ে পড়ে এবং গম্বুজ ভেঙে পড়ে ওদের মাথার উপর।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার নাটক বেরনার্দা আলবার বাড়ি, যেখানে সব চরিত্র নারী। মায়ের দাপটে কেউ টুঁ শব্দ করতে পারে না। এক মেয়ের আত্মহত্যা ঘটে গেলে মায়ের আদেশ ‘বাড়ির বাইরে যাবে না এ সংবাদ’। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর গোষ্ঠীপিতার শরৎকাল-এ শাসক মাকে বলে যে, দেশের মতো সুখভোগ্য সম্পদ আর হয় না এবং যুগের পর যুগ এক রকম শাসন চলতে থাকে। শাসকের মৃত্যুর সংবাদে মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে গিয়েছে, কারণ ওরা মরে না। তাই যখন এমন সংবাদ সত্যি হয়, তারা আনন্দ করতে পারে না। শাসকের ডামি শাসন অব্যাহত রাখে।
নামে গণতন্ত্র, কাজে স্বৈরতন্ত্র— এই হচ্ছে দরিদ্র দেশের অভিজ্ঞান। শাসকের ইতিহাসে লেখা থাকবে না ‘চুপকথা’ কিন্তু সাহিত্য, এক দিন সব বুজরুকি ফাঁস করে দেবে। তাই স্পেনের কবি ফেলিপে লেওন বলেন— (ফ্রাঙ্কো), তোমার সব আছে, সম্পদ, ট্যাঙ্ক, সেনা, কিন্তু আমি তোমাকে বোবা করে দিতে পারি।
ল্যাটিন আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত লেখক মেক্সিকোর কার্লোস ফুয়েন্তেস প্রায় সব উপন্যাসে শাসক এবং তাঁবেদারদের স্বেচ্ছাচারিতার কথাই বলেন।
তরুণ কুমার ঘটক, কলকাতা-৭৫
হীরক রাজ্য
‘শুধু রূপকথা আর চুপ কথা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পড়ার সময় মনের পর্দায় ভেসে আসে প্রায় ৪২ বছর আগে নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রটি। প্রবন্ধের প্রত্যেকটি পঙ্ক্তির অন্তরালে লুকিয়ে আছে যেন চলচ্চিত্রটির ছড়াগুলি। ‘সংশোধনাগারে রেখে দেওয়া’ কিংবা ‘দেশ জুড়ে মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের বড় বড় যন্ত্র’ বাক্যগুলি হীরক রাজের গবেষক দ্বারা আবিষ্কৃত মগজ ধোলাইয়ের যন্ত্র এবং ‘যন্তরমন্তর’ ঘরটির সঙ্গে সাদৃশ্য ভীষণ ভাবে যেন মনে করিয়ে দেয়।
সত্যজিৎ রায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক অনবদ্য গল্প হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। চলচ্চিত্রটি যেন আজকের সমাজেরই একটি চিত্র। হীরক রাজা মগজ ধোলাইয়ের জন্য সভাকবিকে তিনটি মন্ত্র লিখতে বলেন— কৃষকের মন্ত্র, শ্রমিকের মন্ত্র এবং শিক্ষকের মন্ত্র। হীরক রাজা মনে করেন, রাজার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা সাধারণ মানুষের একটি রোগ। তাই কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, সবার জন্য মন্ত্র তৈরি হয়, যার শেষ কথা, ‘হীরকের রাজা ভগবান’। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস যেন সাধারণ মানুষের না হয়। পরিশেষে, উদয়ন পণ্ডিতের নেতৃত্বে রাজার মূর্তি দড়ি দিয়ে টেনে নীচে নামানোর কাজ শুরু হয়। স্লোগান দেওয়া হয়, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’।
চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর কৌশলের কথা তুলে ধরেছেন। একটা বিপ্লব শুধুমাত্র এক জন ব্যক্তি চাইলেই সম্ভব নয়। প্রয়োজন নেতৃত্ব, প্রয়োজন সকলের অংশগ্রহণ এবং প্রকৃত শিক্ষা। আজকের সমাজে ভীষণ ভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে গুপী-বাঘার সঙ্গে এক জন উদয়ন পণ্ডিতের উপস্থিতির।
সুপ্রিয় দেবরায়, বরোদা, গুজরাত
মোহবশে
ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধটি আজকের সময়ের স্পষ্ট ছবি। ‘তুমি তখন চলেছিলে তোমার স্বর্ণরথে’-র রাজা ঠিকই আছেন, তাঁর শাসনকাল প্রলম্বিত করার জন্য নানা ফিকিরও আছে। কিন্তু প্রজা ভোলানোর জন্য যে সোনার গাছে রুপোর পাতা হিরের ফলের মোহাবেশ তৈরি করা হয়, বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। কারখানার মজুর, শ্রমিক, অফিসে কর্মচারীরা এতই কম মাইনে পান যে, মূল্যবৃদ্ধির আগুনে ছ্যাঁকা লেগে যাচ্ছে। পেট্রল, ডিজ়েল, রান্নার গ্যাসের দাম সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। আচমকা নোটবন্দির ঘোষণার মতোই করোনাকালে হুজুরের হঠাৎ হুকুমে রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেল কলকারখানা, রেলগাড়িতে যাতায়াত। হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক নিরুপায় হয়ে রেললাইন ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে, ষোলো জন ওই রেললাইনেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হুজুরের রেল তাঁদের পিষে দিল। ছড়িয়ে রইল তাঁদের বাঁচার শেষ রসদ কয়েকখানা পোড়া রুটি। অথচ, রাজন্যবর্গ ও পারিষদদের সম্পদ সেই সময়েই বেড়ে কয়েক শতকোটি হল। দুঃখ ভোলানোর জন্য রামরাজত্বের স্বপ্ন দেখানো হল— এই দেখো, নবনির্মিত বারাণসীর শিবমন্দির, অযোধ্যার সোনার রামমন্দিরের সরযূ পারে হাজার দিয়া জ্বলে। কিন্তু তাতে দলিতের ঘরের হাঁড়িতে ভাত চড়ে না, তাঁদের হয়ে বলার জন্য বৃদ্ধ ফাদারের কারাগারের অন্ধকূপে মৃত্যু হয়। নারীর সম্মান এখানে উচ্চবর্গের ইচ্ছাধীন। ন্যায় চাইতে গেলে সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের মতো জেলে তিলে তিলে নিঃশেষ হতে হবে। সাধারণের হয়ে কথা বলতে গেলে তিস্তা শেতলবাদ বা মহম্মদ জ়ুবেরের মতো জেলে পোরা হবে।
‘ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন গোলযোগ সইতে পারেন না’। ধর্না, বিক্ষোভ চলবে না। এ যদি জরুরি অবস্থা না হয়, তবে জরুরি অবস্থা কাকে বলে?
শিখা সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১
মিথ্যার নির্মাণ
সত্যকে নানা ভাবে প্রকাশ করা যায়। ঈশানী দত্ত রায় তাঁর প্রবন্ধে স্যাটায়ারের মাধ্যমে ভারত (প্রবন্ধে নামের উল্লেখ নেই) নামক এক সুবিশাল দেশের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা ও আনুষঙ্গিক কাণ্ডকারখানার আসল চিত্রটা তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাঁর ভাষায়, এ দেশের রাজা সত্যবাদী, তবে তা নিজের নির্মিত সত্য। এই ‘নির্মিত সত্য’গুলো আমরা একটু নাড়াচাড়া করে দেখি। নতুন সংসদ ভবনের মাথায় বসানো হয়েছে ৬.৫ মিটার লম্বা ও ৯,৫০০ কিলোগ্ৰামের নতুন অশোক স্তম্ভ। পুরনো সিংহদের দেখে মনে হত দুর্বল আর ভিতু ধরনের। নতুনদের দেখলে মনে হয় দারুণ তেজি, চোখে-মুখে ক্রোধ ঠিকরে বেরোচ্ছে। ‘বেয়াড়া’-রা একে ফ্যাসিস্ট মানসিকতার প্রতিফলন বলছে। রাজা কিন্তু এগিয়েই চলেছেন। তাই বাহুবল দিয়ে বাক্যবলকে ঠেকাতে চাইছেন। রাজা বোঝেন যে, শব্দ ব্রহ্ম, শব্দ মহাবলশালী আয়ুধ। তাই সংসদীয় বিতর্ককে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে সংসদে নিষিদ্ধ শব্দের সংখ্যা বাড়িয়ে এখনও পর্যন্ত ৩২৯টি (১৫১টি ইংরেজি ও ১৭৮টি হিন্দি) করা হয়েছে। বেয়াড়ারা বলছে, বাড়তে বাড়তে এমন এক সময় আসবে, যখন শুধু ‘প্রভু’ শব্দটাই চালু থাকবে! শিশুরা ‘রূপকথা’ শুনে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে, বড়দের ঘুম পাড়াতে গেলে ‘চুপ কথা’। ‘চোপ, সংসদ চলছে!’ শুনিয়ে কাজটি করতে হয়। রাজা সেটি ভাল বোঝেন। ‘বেয়াড়া’ মানুষগুলো যাতে বিদ্রোহী না হতে পারে, তার জন্য রাজা এই সব ব্যবস্থাই করছেন।
অশোক বসু, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy