সেই সময় শিক্ষকদের বেতন ছিল অত্যন্ত কম।
স্বাগতম দাসের ‘সেই সব মাস্টারমশাই’ (১০-৯) শীর্ষক প্রবন্ধটি স্মৃতির দুয়ার খুলে দিল। প্রায় ৪৮ বছর আগে শেষ হয়েছে আমার স্কুলবেলা। একটি গ্রামের বাংলা মাধ্যম কো-এডুকেশন স্কুলে যাঁদের গুরু হিসেবে পেয়েছিলাম, তাঁরাই গড়ে দিয়েছিলেন আমার ভবিষ্যৎ। বাংলা শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে অঙ্ক কিংবা বিজ্ঞানের শিক্ষক সাবলীল ভাবে বাংলা পড়িয়ে দিতেন। আবার অঙ্ক বা বিজ্ঞানের শিক্ষক ছুটিতে থাকলে ইতিহাস, ভূগোলের শিক্ষক বিষয়টি সুন্দর ভাবে বোঝাতেন। সততা, নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, আদর্শ, ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্নেহ-ভালবাসা ছিল তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সেই সময় শিক্ষকদের বেতন ছিল অত্যন্ত কম। ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া বেতন থেকে তাঁদের বেতন হত। অনেক গরিব ছাত্রছাত্রী অর্ধেক বেতন বা বিনা বেতনে পড়ত। শিক্ষকরা এই জন্য আরও কম বেতন পেতেন। তখন এখনকার মতো টিউশনের চল ছিল না। স্কুলের লেখাপড়াই যথেষ্ট ছিল। এ ছাড়াও কেউ কোনও বিষয়ে বুঝতে চাইলে শিক্ষক মহাশয়দের দ্বার অবারিত ছিল। নানা উদাহরণ সহযোগে কঠিন বিষয়কে ছাত্রছাত্রীদের কাছে সহজ ও বোধগম্য করে তুলতেন। বৃষ্টির দিনে গল্প বলতেন, পড়ানোর সময় উপযোগী কবিতার লাইন উদ্ধৃত করতেন। দু’দিনের বেশি স্কুলে না গেলে বাড়িতে খবর পাঠাতেন। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁরা যে আমাদের পাশে শুধু থাকতেন তা-ই নয়, অংশগ্রহণও করতেন। পড়াশোনা ও চাকরির জন্য দীর্ঘ দিন গ্রামছাড়া হলেও নিয়মিত যোগাযোগ আছে, গ্রামে গেলে এখনও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বড় তৃপ্তি পাই। স্মৃতিচারণ ও কুশল আদানপ্রদান করি। তাঁদের কিছু ক্ষণের সান্নিধ্যে ফিরে যাই স্কুলবেলায়। একরাশ সুখানুভূতি নিয়ে ফিরে আসি।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
সহজ রসায়ন
স্বাগতম দাসের লেখা ‘সেই সব মাস্টারমশাই’ লেখাটি অনেক কথা মনে করিয়ে দিল। মনে পড়ে গেল রসায়নের সেই শিক্ষকের কথা, যিনি অত্যন্ত একঘেয়ে বলে খ্যাত কেমিস্ট্রির রাসায়নিক বন্ধন অধ্যায়টি পড়াতে গিয়ে, দুই বন্ধুর সম্পর্কের উপমা টেনে খুব সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সমযোজী এবং আয়নিক বন্ধনের পার্থক্য। এক সময় মনে হচ্ছিল, কোনও বাংলার শিক্ষক বাংলা সাহিত্য এবং তাতে কোনও গল্পে দুই বন্ধুর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করছেন। এটাই হয়তো শিক্ষার সেই মূল সূত্র, যেখানে বিষয়ের বেড়া ভেঙে যায়। হয়তো এতটাই সহজ করে দৈনন্দিন জীবনের উদাহরণ তুলে বোঝানো হয়েছিল বলেই, কোনও দিন তা ভোলা সম্ভব হয়নি। শিক্ষক তো সত্যি বলতে তাঁরাই, যাঁদের প্রতিটি বিষয়ে বোঝানোর মধ্যে থাকত একটি গল্প এবং সেই গল্প কোথাও না কোথাও ছাত্রদের ভিতরে ঢুকে যেত। এ ভাবেই ছাত্ররা শিখত, বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াত। আর তাই এখনও যখন এই শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা হয়, তখন হঠাৎ একরাশ ছোটবেলা এসে ঘিরে ধরে। অজানতে হাত চলে যায় তাঁদের পায়ে।
সুমন চক্রবর্তী, কলকাতা-৬৫
মানচিত্র
কোথায় পড়েছিলাম মনে নেই, এক শহরতলির ভূগোলের মাস্টারমশাইয়ের কথা এবং তাঁর পড়ানোর টেকনিক। মাস্টারমশাই ক্লাসে যাচ্ছেন, হাতে আছে একখানা খনিজ সম্পদের দিশা দেখানো ভারতের মানচিত্র। ক্লাসে ঢুকে মানচিত্রখানা টেবিলের উপর রেখে ছাত্রদের সামনে উপস্থিত— “কী রে অপু ভাত খেয়ে এসেছিস?” “না স্যর, ভাত খাওয়া হয়নি। মা বলেছে টিফিনে এসে ভাত খেয়ে যাবি।” “কী রে সুবীর তোর?” “হ্যাঁ স্যর, ভাত খেয়ে এসেছি। মা কাঠ জোগাড় করে ভাত করে দিয়েছে।” “আর সন্দীপ তোর?” “হ্যাঁ স্যর, মা তোলা উনুনে ভাত করে দিয়েছে।”
মাস্টারমশাই পড়ানোর লিঙ্ক পেয়ে গেছেন। “হ্যাঁ রে, কয়লার উনুনে কয়লা কোথায় পেলি?” ছাত্র উত্তর দিল, “কেন স্যর? কয়লা তো হরিমুদির দোকানে পাওয়া যায়।” কিন্তু হরিমুদি কোথা থেকে কয়লা পায়? এক ছাত্র হাত তুলে বলল, “ইস্টিশনের পাশে বিরাট কয়লার টাল আছে। সেখান থেকেই সব দোকানিরা কয়লা নিয়ে আসে।” এ বারে মাস্টারমশাইয়ের প্রশ্ন, সেই কয়লার টালে কোথা থেকে কয়লা আসে? সবাই চুপ। এ বার মাস্টারমশাই মানচিত্রখানা ব্ল্যাকবোর্ডের উপর মেলে ধরেন। একটা বেত নিয়ে পয়েন্ট করে দেখান ভারতের কয়লার অঞ্চলগুলো। নাম উঠে আসে ঝরিয়া, রানিগঞ্জ, আসানসোল, দুর্গাপুর ইত্যাদি নাম। পড়ানোর মধ্যে জীবনধারা, ভূগোল সব একাকার হয়ে যায়।
সঞ্জয় চৌধুরী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
অব্যাহতি কেন
শিক্ষকের কাজ (৭-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয় শিক্ষকদের ভূমিকা ও কাজ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমানে পাঠদান করা শিক্ষকদের একমাত্র দায়িত্ব হতে পারে না। এ কথা ঠিক যে, স্কুলগুলির উপর নিত্যনতুন কাজের চাপ বাড়ছে। কিন্তু কাজগুলি ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থবিযুক্ত নয়। যে কাজ বা প্রকল্পগুলি স্কুল থেকে পরিচালিত হলে ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ সার্বিক ভাবে রক্ষা করা যাবে, সেই কাজগুলি থেকে স্কুল মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না। শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্যের দিকটি যেমন উপেক্ষা করা যায় না, তেমনই শিক্ষাশ্রী, কন্যাশ্রী প্রভৃতি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার জন্য স্কুলের তদারকি করার দায়িত্ব এড়ানো যায় না। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, এই সকল কাজে প্রধান শিক্ষক বা অন্য শিক্ষকদের নিযুক্তি তাঁদের সময় ও মনোযোগ দুই-ই নষ্ট করে। এই সমস্ত কাজের জন্য স্কুলগুলিতে আরও করণিকের পদ তৈরি হোক। অন্য দিকে, স্কুলসম্পৃক্ত সামাজিক প্রকল্পগুলির জন্য নোডাল শিক্ষকের ব্যবস্থা করে প্রধান শিক্ষকের কাজের ভার খানিকটা লাঘব করা যেতে পারে। বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প স্কুল থেকে পরিচালিত হলে সেগুলির টানে স্কুলছুট হওয়া আটকানো যায়। অন্য দিকে, জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ রক্ষা সহজ হয়। তাই স্কুলগুলির অফিস কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি আবশ্যক। কিন্তু সমস্ত সামাজিক প্রকল্প থেকে শিক্ষকদের অব্যাহতি চাওয়া শিক্ষার বৃহত্তর উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করবে।
অভিজিৎ কাপাস , রাজনগর, পশ্চিম মেদিনীপুর
ঘৃণার স্মৃতি
‘প্রকৃত চেহারা’ (১০-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয় পড়ে ২০০৮ সালের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। এক বার আমার মোবাইলটি হারিয়ে যাওয়ায় নিয়মমাফিক বারাসত থানায় যেতে হয়েছিল ডায়েরি করতে। আমার ডায়েরি যিনি জমা নেবেন, তিনি টেবিলে ছিলেন না। তাই অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় এক জন মাঝবয়সি মহিলা থানায় এলেন। পোশাক দেখে নিম্নবিত্তই মনে হল। চোখেমুখে স্পষ্ট উৎকণ্ঠার ছাপ, সম্ভবত কান্নাকাটি করেছেন। তিনি বললেন, সাত দিন তাঁর স্বামী বাড়ি ফেরেননি। দু’টি টেবিলে ঘোরার পর এক জন বাবু বললেন “আমাকে খুলে বল।” সব শোনার পর নানা রকম অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করতে লাগলেন তিনি। যেমন— “তোদের প্রেম করে বিয়ে, না দেখাশোনা করে?” “বর তোকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসে কি?” শেষে বললেন, “বিয়ে করার সময় আমাকে বলে করেছিলি যে, এখন তোর স্বামীকে খুঁজতে বেরোব?” বাকি টেবিলের সকলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, অনেকে তাঁর কৌতুকবোধের বাহবাও দিল। আমার সে দিন সহায়সম্বলহীন অসহায় মহিলাটিকে এক ঘর অপরিচিত লোকের সামনে হেনস্থা হতে দেখে খুব খারাপ লেগেছিল। সঙ্গে জন্মেছিল টেবিলে বসা উর্দিধারী মানুষটির প্রতি একরাশ ঘৃণা। আজ এই পুরনো স্মৃতি আবার মনে পড়ল।
অর্কদীপ মুখোপাধ্যায়, দত্তপুকুর, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy