বিশ্বভারতীর জনসংযোগ আধিকারিক অনির্বাণ সরকার ‘স্বার্থান্বেষী’ শিরোনামে (সম্পাদক সমীপেষু, ২২-১০) যে চিঠি লিখেছেন, তাতে তথ্যবিকৃতি ঘটেছে। প্রথমত, চরিত্রপূজা পুস্তিকা থেকে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিটি আশ্রমিকদের বিরুদ্ধে নয়। ১৩০২ সনে বিদ্যাসাগরের স্মরণসভায় ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ প্রবন্ধে তৎকালীন বঙ্গসমাজের প্রতি বিদ্যাসাগরের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। দ্বিতীয়ত, অনির্বাণবাবুর মতে, স্বার্থান্বেষী মানুষরা বিশ্বভারতীকে ধ্বংস করে দেবে, এই আশঙ্কায় গুরুদেব গাঁধীজির কাছে আবেদন করেন প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। প্রকৃত কারণ, গুরুদেব তাঁর অনুপস্থিতিতে বিশ্বভারতীর অর্থ সঙ্কটের কথা আশঙ্কা করে এই অনুরোধ করেন। তৃতীয়ত, প্রাক্তন অধ্যাপকের শান্তিনিকেতন স্মৃতি গ্রন্থ উল্লেখ করে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর চেষ্টা কেন? আমরাও জানি, পৃথিবী পরিবর্তনশীল এবং শান্তিনিকেতন এর বাইরে নয়। কিন্তু পরিবর্তন যাতে শুভ হয়, সেই প্রচেষ্টা সম্মিলিত ভাবে করা উচিত।
পরিশেষে, পেনশনভোগী ছাড়া কোন প্রাক্তনীকে আপনারা বেতন দেন? কোনও প্রাক্তনী বা আবাসিক যদি সুসজ্জিত দালানবাড়িতে থাকেন, তাতে গাত্রদাহ কেন? অনির্বাণবাবু প্রাক্তনীদের ‘স্বার্থান্বেযী’ বলেছেন। কিন্তু, কী তাঁদের স্বার্থ, স্পষ্ট করেননি। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বহু প্রাক্তনী আশ্রমিক বিশ্বভারতীকে ভালবাসেন বলেই নানা বিষয়ে নির্দিষ্ট মতামত দিয়েছেন। যেমন, হস্টেল ও আশ্রমের অযত্ন; অবহেলিত এনডাওমেন্ট ফান্ড, অনাবশ্যক উঁচু পাঁচিল ও গেট নির্মাণ। এগুলোই আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত। একে ‘তারস্বরে চিৎকার’ বলা অন্যায়।
গৌতম ঘোষ
প্রাক্তনী, শান্তিনিকেতন, সীমান্ত পল্লি
মিলনক্ষেত্র হোক
আমরা বিশ্বভারতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিভাগে পড়াশোনা করেছি, অধ্যাপনা করেছি বা কর্মসূত্রে জড়িত ছিলাম। আমাদের যোগসূত্র হল জীবনে ও মননে একটি ‘অর্থপ্রাপ্তি’। আক্ষরিক অর্থে আমরা ‘স্বার্থপর’— প্রত্যেকে ‘স্বক্ষেত্র’-এ এই পরমার্থটিকে সযত্নে রক্ষা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। এই দায়বদ্ধতা স্বীকার করে নিয়েছি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের জন্য। ১৯৩৪ সালে প্রাক্তনীদের উদ্দেশে বলেছেন, “বহু বিদ্রূপ নিন্দা মাথায় করে এখন আমার জীবনের শেষ ভাগ উপস্থিত। এখন যদি এ (বিশ্বভারতী) একটা জীবন্মৃত পদার্থে পরিণত হয়, এর প্রাণশক্তি না থাকে, তবে ব্যর্থ হলুম। ...বিরুদ্ধতাকেও আমি স্বীকার করি— তোমাদের কাছে আমি শুধু এইটুকু চাই যে অকৃত্রিম মমতার সঙ্গে একে তোমরা গ্রহণ করো।” প্রাক্তনীদের প্রতি গুরুদেবের এই বিশ্বাস আমাদের পাথেয়। আমরা প্রাক্তনীরা তাই আজও একই সঙ্গে কৃতজ্ঞ, দায়বদ্ধ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আবার বিচলিত ও উদ্বিগ্ন।
আমরা বিশ্বভারতীর প্রাক্তনীদের পক্ষ থেকে সম্মিলিত ভাবে এই সংবাদপত্রে একটি চিঠি পেশ করি (‘রণক্ষেত্র নয়’, ১৬-১০)। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধার অভাব, ছাত্রাবাস ও আশ্রমের অযত্ন, ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলির ধ্বংস, যত্রতত্র পাঁচিল তোলার ফলে যাতায়াতের অসুবিধা, ইত্যাদি নানা সমস্যা সবার কাছে তুলে ধরা। সেই সঙ্গে বিশ্বভারতী প্রশাসনের পাঁচিল গড়ার জন্য ও সশস্ত্র রক্ষিবাহিনী নিয়োগের জন্য অহেতুক ব্যয় ও প্রাক্তনীদের কাছে উপাসনা মন্দির সংস্কারের জন্য অর্থ সাহায্যের দাবি আমাদের কাছে অবাস্তব ও অসমীচীন মনে হয়।
সেই চিঠির জবাব দেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ আমাদের ‘স্বার্থান্বেষী’ তকমা দিয়ে (২২-১০)। আমরা প্রাক্তনীরা বিশ্বভারতীর শুভানুধ্যায়ী। তাই সমালোচনা করা বা কর্তৃপক্ষকে জানানো কর্তব্য মনে করি। এই দায়িত্ব স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আমাদের উপর অর্পণ করেছেন। বিশ্বভারতী আইনে প্রাক্তনীদের ভূমিকা কী, তা স্মরণীয়। ইউজিসি-র বর্তমান বছরের নির্দেশাবলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন-এর দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা স্পষ্ট জানানো হয়েছে। আমরা চাই, যথাযথ আইনানুগ কাঠামো অনুযায়ী অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন, গুরুদেবের কথায় ‘আশ্রমিক সংঘ’ পুনরুজ্জীবিত হোক।
প্রাক্তনীরা প্রতিষ্ঠানের বিবেক, তাই বিশ্বভারতীর নানা দুর্বলতা সকলের সামনে তুলে ধরা প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের ভালবাসা ও আনুগত্যের প্রকাশ। বিশ্বভারতীর নীতি নির্ধারণে প্রাক্তনীদের নির্বাচিত সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বিশ্বভারতীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। আমরা স্বার্থান্বেষী নই। আমাদের অন্বেষণ হল সুষ্ঠু কর্মপদ্ধতি ও বিবেচনার মধ্য দিয়ে একত্রে, আশ্রমগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে সহযোগিতার পথ তৈরি করা। তাই রণক্ষেত্র নয়, একটি সমষ্টিগত কর্মযজ্ঞ হোক— হয়ে উঠুক সর্বতো ভাবে একটি মিলনক্ষেত্র।
আলো রায়, কল্পিকা মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিয় ঠাকুর, উমা সেন, সুজিত চট্টোপাধ্যায়, চিত্রা সিংহ, সুনন্দ রায়, আনন্দরূপ রায়, জয়িতা চক্রবর্তী, শ্রীলা চট্টোপাধ্যায়, চন্দনা সেন সরকার, তাপস বসু, জনক ঝংকার নারজারী, শর্মিলা রায় পোমো, মালবিকা গুহ, শান্তভানু সেন, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, দেবযানী সেনগুপ্ত, মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
শান্তিনিকেতন, বীরভূম
প্রাক্তনীর দায়িত্ব
বয়ানের উপরে লেখা ‘আবেদন’, নীচে যা লেখা, তাকে আবেদন বলে না (‘প্রাক্তনীদের অর্থ জোগাড় করতে বলল বিশ্বভারতী’, ১৫-১০)। এই ভাষা আদেশের ভাষা। ১৪টি নির্দেশ আছে এই আদেশনামায়। তার শেষটিকে বাকিগুলির ভিত্তি বলা যায়। সেটি বলছে, প্রাক্তনীরা অধিকারের কথা বলেন, দায়িত্ব পালন করেন না। চিঠিতে বলা নেই, এবং অন্য কোনও নথিও জানা নেই, যেখানে প্রাক্তনীরা তাঁদের অধিকারের কথা বলেছেন। যদি বলেও থাকেন, তা হলে সে কথার যৌক্তিকতা বিচার করা উচিত।
বিশ্বভারতী যদি এমন কিছু করে, যা রবীন্দ্র-আদর্শ বা শান্তিনিকেতনের জীবনশৈলীর পরিপন্থী, তার বিরুদ্ধে সরব হওয়া প্রাক্তনীদের দায়িত্ব। তাঁরা জানেন, বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্র ঐতিহ্যের রক্ষাকারী (কাস্টডিয়ান), মালিক নয়। রক্ষাকারী আপত্তিকর কাজ করলে প্রাক্তনীদের দায়িত্ব প্রতিবাদ করা।
এই আদেশনামার বেশ কয়েকটি বিষয় প্রতিবাদযোগ্য। বিশ্বভারতী বা শান্তিনিকেতন কোনও ধর্মীয় মঠ নয়, যে তার কর্তৃপক্ষ সদস্যদের উপর আদেশনামা জারি করতে পারেন উপাসনায় অংশ নেওয়ার জন্য। তেমন ধর্মীয় আধিপত্যের ভাবনার মূলোচ্ছেদ করাটাও প্রাক্তনীদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
কাচের মন্দির সংস্কারের জন্য ৫ লক্ষ টাকা চেয়েছেন কর্তৃপক্ষ। মন্দির কেন সংস্কার করতে হবে? মোট কত টাকা কী বাবদ লাগবে, কর্তৃপক্ষ কি কোনও হিসেব পেশ করেছেন? এই ভাবে টাকা চাওয়া জনপ্রতিষ্ঠানে হতে পারে না। ৬ নম্বর ছত্রে ‘করপাস ফান্ড’-এর কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়েও জনসমক্ষে কোনও তথ্য নেই। দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের জন্য তহবিল তৈরি করতে ৫ লক্ষ টাকা তুলে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। অথচ, এই দুঃস্থ ছাত্র তহবিল সম্পর্কে কোনও তথ্যও জনসমক্ষে নেই।
হতবাক হয়ে গিয়েছি ১১ নম্বর ছত্রটি পড়ে। শ্রদ্ধেয় শান্তিদেব ঘোষের বাড়ি বিশ্বভারতীকে ‘দান’ করতে হবে। বিশ্বভারতী কি শান্তিদেব ঘোষের উত্তরাধিকারীদের কাছে এই আবেদন রেখেছে? যত দূর জানি, রাখেনি। তা হলে প্রাক্তনীরা এ ব্যাপারে কী করতে পারেন? একই ভাবে জমি-হাঙরদের কাছ থেকে বিশ্বভারতীর জমি উদ্ধারে প্রাক্তনীদের দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে। অথচ কোন জমি-হাঙর কত জমি দখল করেছে, তার কোনও তথ্য নেই।
গত দু’দশকেরও বেশি নানা কায়েমি স্বার্থ বিশ্বভারতীর সুনাম ব্যাহত করেছে। বিশ্বভারতীর মূল কাজ পঠন-পাঠনে উৎকর্ষ বিধান। বর্তমান কর্তৃপক্ষের সেই ব্যাপারে কতটা অবদান? এ ব্যাপারে শিক্ষিত জনসমাজ কিছুই জানেন না। যেটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে বিশ্বভারতীর কোনও সুনাম হচ্ছে না।
অশোক কুমার সরকার
কলকাতা-৯৯
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy