— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কুমার রাণার ‘সবচেয়ে অনাশ্চর্য কী’ (১২-২) শীর্ষক প্রবন্ধটির জন্য প্রবন্ধকারকে ধন্যবাদ। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা সংযোজন করতে চাই। বর্তমানে মিড-ডে মিলের এক জন পাচিকা মাসে ১৫০০ টাকা সাম্মানিক পান। এঁরা কেবল সমাজসেবা করবেন, বাকিরা বেতন পাবেন! ক্ষমতাজীবীরা যাঁদের কৌশলে সমাজসেবা করতে বাধ্য করছেন, তাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এঁদের দুঃখের কথা শোনার কেউ নেই। এক জন অদক্ষ মজুরের ন্যূনতম যে মজুরি সরকার নির্ধারণ করে দেয়, তাঁদের সেই মজুরি থেকেও অনেক কম মজুরি দিয়ে চালাকি করে বলা হয় সাম্মানিক।
বহু বিদ্যালয়ে দেখা যায় নির্ধারিত পাচিকার সংখ্যার থেকেও অনেক বেশি জন রান্নার কাজে যুক্ত। স্থানীয় নেতাদের চাপ বা ক্ষোভ সামলাতে পাঁচ জনের পরিবর্তে পঁচিশ জনকে পাচিকা হিসাবে যুক্ত করার বহু নিদর্শন আছে। এ ক্ষেত্রে পালা করে রান্না করেন, আর পাঁচ জনের মজুরির টাকা সকলে মিলে ভাগ করে নেন। এ রকম ক্ষেত্রে তাঁদের আরও করুণ দশা। প্রকৃতপক্ষে সমাজের আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া পরিবারের মায়েরাই এই বেগার শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। আশ্চর্য লাগে যখন দেখি, কোনও ব্যক্তিমালিক নয়, সরকার এই দুর্বল, পিছিয়ে পড়া মানুষদের বেগার খাটায়। মধ্যযুগে হলে ইতিহাসবিদরা নিশ্চয়ই এই ঘটনাকে মধ্যযুগীয় শোষণ বলে চিহ্নিত করতেন। এ ছাড়াও আইসিডিএস কর্মী ও আশাকর্মীদেরও নানা ধরনের প্রশাসনিক কাজের ভার দেওয়া হয় তাঁদের নির্ধারিত কাজের বাইরে। এঁদেরও পারিশ্রমিক সাম্মানিকে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া এঁদের উপর আছে কর্তৃপক্ষের নির্মম চাপ ও অমানবিক আচরণ। সর্বোপরি ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে এঁদের মানসিক চাপে রেখে নানাবিধ কাজ করিয়ে নেওয়া। আছে বাধ্যতামূলক ভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতিতে সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এঁদের অংশগ্রহণ করানোর প্রবণতা। এ ভাবেই চলছে বছরের পর বছর। সরকার যেখানে কাজ না করিয়ে মানুষকে অনুদান হিসাবে হাজার হাজার টাকা দিচ্ছে এবং প্রতি বছর সেই বরাদ্দও বৃদ্ধি করা হচ্ছে, সেখানে এত পরিশ্রম করা মায়েদের জন্য নেই কোনও মানবিক ভাবনা। অথচ এঁরাও ক্ষমতাজীবীদের ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করেন, এঁদেরও ভোটাধিকার আছে। এঁদের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা কবে প্রতিবাদী হবেন?
সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি
নামমাত্র
কুমার রাণার প্রবন্ধ সূত্রে বলি, আমরা ছোট থেকে শুনে আসছি তাজমহল যে হাজার হাজার মানুষের শ্রমে নির্মিত হয়েছে, ইতিহাস তাদের কথা মনে রাখেনি। শোনা যায়, পরবর্তী কালে কাউকে কাউকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল। সত্য-মিথ্যার কথা বাদ দিলে একটা সার কথা অবশ্য ধরা যায়। অনেক মানবদরদি যুগ যুগ ধরে শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের কথা বলে চলেছেন। তাঁদের দুরবস্থা দূর করার পথও কোনও কোনও মনস্বী দেখিয়ে চলেছেন। হীরক রাজার দেশে-র গানটা আমরা তো ভুলিনি। “সোনার ফসল ফলায় যে তার দুইবেলা জোটে না আহার/ হীরার খনির মজুর হয়ে কানাকড়ি নাই...।” তাঁদের সম্পর্কে এই সমাজে তথাকথিত অগ্রসর শ্রেণির মানুষের থাকে এক বিচ্ছিন্নতা আর সীমাহীন অজ্ঞতা। তাঁদের দুটো মাত্র পরিচয়। কাজ করেন ভোট দেন।
রান্নার দিদিদের স্কুলে উপস্থিত হয়ে প্রস্তুতি নিতে হয় খুব সকাল সকাল। একটা স্কুলে তিন থেকে ছ’টা-সাতটা পর্যন্ত গ্রুপ বা সেল্ফ হেল্প গোষ্ঠী থাকে। সংক্ষেপে বলা হয় এসএইচজি। এক-একটা এলাকায় গ্রাম বা ছোট ছোট জায়গা থেকে শুরু করে ব্লক স্তর পর্যন্ত অনেকগুলো গ্রুপ থাকে। প্রতিটা গ্রুপে থাকেন পাঁচ-ছ’জন করে মহিলা সদস্য। এঁদের নামমাত্র মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। এঁরা স্কুলে নিয়মমতো রান্না করেন আর সেই সম্পর্কিত কাজও করেন। ভাতা পান বছরের মধ্যে দশ মাস। পুজো আর গরমের ছুটিতে ছাত্রছাত্রীরা আসে না আর রান্না হয় না বলে দু’-মাসের ভাতা মেলে না। একাধিক গ্রুপ থাকলে মাথাপিছু কত করে ভাতা জোটে শুনলে আশ্চর্য হতে হয়। এই সব গ্রুপ নিয়ে নেতা আর সমাজকর্মীরা পদযাত্রা করেন। মিছিলে হাঁটেন। পান থেকে চুন খসলে বাদ পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। যখন কেউ জাঁক করে বলেন ভাতা দিয়ে বা বাড়িয়ে মানুষকে বাজার করার ক্ষমতা দিচ্ছেন— শুনে কান্না পায়। একটা পরিবারে চার জন সদস্য ধরলে মাথাপিছু কত করে থাকে, বাজারদর হিসাবে তা কতখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ, সহজেই অনুমেয়।
প্রতিমা মণিমালা, হাওড়া
ক্ষমতা ও শ্রম
‘সবচেয়ে অনাশ্চর্য কী’ প্রবন্ধ বিষয়ে বলি, ক্ষমতাজীবী বনাম শ্রমজীবী— এই দুই দলের মধ্যে চলে নিরন্তর টানাপড়েন। প্রথম দল ক্ষমতাসীন হয়ে মজুরি প্রদান করেন, আর দ্বিতীয় দল শ্রমের বিনিময়ে সেই মজুরি গ্রহণ করেন। শ্রম, বেঁচে থাকার জন্য। আর এখানেই প্রশ্ন— শ্রমিকের বাঁচার স্বার্থে তাঁর ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর জন্য যে মজুরি প্রদান করা উচিত, তা কি করা হয়? হয়তো সেই ক্ষেত্রে আইনকানুন লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি কি, ভাবনাচিন্তা করে তার সুরাহা করা হয় কি?
ক্ষমতাজীবীরা যাঁদের বলে বলিয়ান, ভোটের আগে তাঁরা ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে শ্রমজীবীদের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরেন ভোট পাওয়ার আশায়। শ্রমজীবীরা তখন সামনে পেয়ে তাঁদের সব অভাব-অভিযোগের কথা বলেন। আশা, ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা হাতে পেয়ে সেই অভাব পূরণ করবেন। ক্ষমতাসীনের অনুগতরাও হাত জোড় করে ভোট-ভিক্ষা করে তাঁদের আশ্বস্ত করেন। এখানেই আশ্চর্য। আবার, ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাঁরা শ্রমজীবীদের কথা বেমালুম ভুলে যান। এখানেই অনাশ্চর্য।
এই দোদুল্যমান অবস্থা ক্ষমতাজীবীর কাছে শ্রমজীবীদের চিরকালের প্রত্যাশা এবং পরে হতাশা। শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের শ্রমের বিনিময়ে বেঁচে থাকেন। নিরক্ষর শ্রমিক, অর্ধ-শিক্ষিত শ্রমিক, অদক্ষ শ্রমিক, দক্ষ শ্রমিক, কত রকমের মজুরিভিত্তিক নাম। পেশাগত ভাবে তাঁদের পরিচয়। তাঁদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার দায়িত্ব সেই ক্ষমতাবান ব্যক্তির, যিনি ভোট-ভিক্ষা করতে সেই সকল শ্রমিকের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছেন। বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাঁদের সম্মানজনক ভাবে বেঁচে থাকার মজুরিটি মঞ্জুর করার।
প্রবন্ধকার মিড-ডে মিল কর্মীদের পাশাপাশি আইসিডিএস কর্মী, আশাকর্মী এবং অন্য বিভিন্ন নামের প্রকল্পের কর্মীদের কথা বলেছেন, তাঁরা এক কথায় শ্রমজীবী মহিলা। এক দিকে তাঁরা শ্রমজীবী, অন্য দিকে তাঁরা মহিলা। উভয় পরিচয়ই সমাজে উপেক্ষিত এবং বঞ্চিত। উভয়কেই সমাজে তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে লড়াই করে যেতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, এঁরা নিরন্তর নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভালবাসা দিয়েই শ্রম দিয়ে যান, কিন্তু বিনিময়ে তাঁদের প্রয়োজন মেটানোর মতো মূল্য তথা মজুরি পান না। এর ফলেই তাঁরা অন্য সকল বঞ্চিত মানুষের মতো আন্দোলনের পথে নামেন।
এই সকল কর্মী তাঁদের পেশার প্রতি এতটা যত্নবান যে, ক্ষমতাজীবীর এক দল তাঁদের নির্ধারিত তদন্ত কমিটি পাঠালে মিড-ডে মিলের কর্মী-মহিলারা ইউনিফর্ম পরে, হাতে দস্তানা পরে, মাথায় ক্যাপ লাগিয়ে তদন্তকারী দলের সদস্যদের নিকট তাঁদের শ্রমের ফসল উপস্থাপিত করেন। এই সকল ইউনিফর্ম ইত্যাদির জোগান দেন আর এক ক্ষমতাজীবী দল। কিন্তু এই ক্ষমতাজীবীরা ভুলে যান বা উপেক্ষা করেন সেই শ্রমজীবী মহিলাদের আন্তরিকতা ও ভালবাসায় মিশ্রিত শ্রমের বিনিময়ে তাঁদের প্রাপ্য মজুরিটুকু দিতে। আর সেই প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হলে, সেই সকল মহিলা তাঁদের অতি কষ্টে অর্জিত সামান্য পয়সা থেকে খরচ করে সুদূর গ্রাম থেকে এ শহরে আসেন তাঁদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে।
সন্তোষ কুমার দে, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy