প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘মুখ বদলাবে, হাল ফিরবে না’ (১৯-৮) লেখায় বামফ্রন্টের সমালোচনার সব বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য নয়। এ কথা ঠিকই, শাসক দল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও, গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে বামেরা চূড়ান্ত ব্যর্থ। গত এক দশকে শাসক দলের চরম আর্থিক দুর্নীতি, মস্তানরাজ, শিক্ষক নিয়োগ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ব্যর্থতার বিরুদ্ধে সরব হতে পারেনি বামফ্রন্ট। তৃণমূলনেত্রী বিভিন্ন সময়ে বিজেপির সঙ্গে জোটবন্ধন করেছেন। এ রাজ্যে সেই জোটের ফলেই বিজেপির আগমন ও বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু এখন কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে রাজ্যের দলের অহি-নকুল সম্পর্ক। কাজেই ভোটের আগে ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আসলে বামফ্রন্ট নেতৃত্ব ও দলীয় কর্মীরা মানুষের কাছে গিয়ে তাঁদের মনের কথা বোঝার চেষ্টাই করেননি। ফলে, তাঁরা মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। এই পরিসর বিজেপি সম্পূর্ণ ভাবে ব্যবহার করেছে। তবে লেখক বর্ণিত, ‘আগে রাম পরে বাম’ তত্ত্ব কোনও কালেই বাম অভিধানে ছিল না। হতেই পারে ক্ষতিকারক বিজেপি দলের বিরুদ্ধে বামেরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। মানুষ ‘কম ক্ষতিকারক’ তৃণমূলকে আঁকড়ে ধরেছেন। তা ছাড়া ভোট কেনার জন্য মানুষের করের টাকা ক্লাবগুলিকে বিলিয়ে দেওয়া এবং তাঁদের চিরমুখাপেক্ষী থাকার জন্য কিছু জনবাদী প্রকল্পের জনপ্রিয়তা তো ছিলই। লেখক এই প্রবন্ধে শুধু বামফ্রন্টের নেতিবাচক সমালোচনা করেছেন, কোনও দিশা দেখাতে পারেননি। বরং ‘প্রবীণ’ (২০-৮) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে পুরনো ধ্যানধারণা বদলে নবচেতনার উন্মেষ ঘটাতে বলা হয়েছে। শুধু বাহাত্তর বা আশি-ঊর্ধ্বদের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে না-নেওয়া নয়, ‘মানুষ ভুল বুঝেছে, আমরা মানুষকে বোঝাব’— এই আত্মম্ভরিতা সম্পূর্ণ ভাবে ত্যাগ করতে হবে। মানুষের এক জন হয়ে তাঁদের কথা শুনতে হবে। তবেই বৃদ্ধতন্ত্রের প্রকৃত অবসান হবে।
শিখা সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১
চর্বিতচর্বণ
প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘মুখ বদলাবে, হাল ফিরবে না’ শীর্ষক প্রবন্ধটি এখন সমাজমাধ্যমে সিপিএমকে জ্ঞান দেওয়ার যে পর্ব চলছে, তারই চর্বিতচর্বণ মাত্র।
‘মানুষ’কে সিপিএম-ই শুধু বোকা ভাবে বা ভাবত না, সব রাজনৈতিক দলের নেতারা তা-ই ভাবেন। আর মানুষও কি সামগ্রিক ভাবে খুব বৌদ্ধিক চর্চা-নির্ভর সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোট দেন কোনও দিন? তেমন উদাহরণ বাম জমানাতেও ছিল না। বাম আমলে সবাই যেমন ঝাঁকের কই-এর মতো ‘বামাচারী’ হয়ে উঠেছিলেন, এখনও তেমন সবাই ‘দিদিপন্থী’। তবু ক্ষমতা এক দিন না এক দিন হাত বদলাবেই। কালের নিয়মে আজকের শাসকও এক দিন পরাজিত হবেন। তখনও বাংলার মানুষ নতুন রাজার পক্ষই নেবেন। এমনটাই হয়ে এসেছে।
তাই অপ্রাসঙ্গিক সিপিএমের সমালোচনা এখন অপ্রয়োজনীয়। বরং, এখন যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাসঙ্গিক, রাজ্য পরিচালনার ভার যাঁদের হাতে, বা যাঁরা শাসক বা বিরোধীর আসনে বসে আছেন, তাঁদের নেতৃত্বকে সুপরামর্শ দেওয়া ও তাঁদের কর্মনীতির গঠনমূলক সমালোচনা করাই কাম্য।
উদয় বন্দ্যোপাধ্যায়
পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
ভোট কৌশল
সম্প্রতি ভোটে লজ্জাজনক ভাবে হারার পর সিপিএম নেতৃত্ব তার কারণ খুঁজতে গিয়ে কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কিন্তু এত দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটা রাজনৈতিক দলের এই পরিণতির জন্য দলীয় নেতৃত্ব যে কারণই দেখাক, একটা ব্যাপার তাঁরা গ্ৰাহ্যের মধ্যে আনছেন না বা আনতে চাইছেন না। সেটা হল তৃণমূলের ভোট কৌশল। এর জন্য অবশ্য তৃণমূলের চেয়ে ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর (পিকে)-কেই বেশি কৃতিত্ব দিতে হয়। এই কৌশলের মধ্যে প্রধান দু’টি বিষয় হল, নানা জনহিতকর প্রকল্পের সূচনা, এবং বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের অসৎ নেতাদের অপসারণ ও তার জায়গায় নতুন অপেক্ষাকৃত সৎ নেতাদের নিয়োগ। একটা সময়ে তৃণমূল আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রায় সমার্থক ছিল। ‘পিকে স্ট্র্যাটেজি’ চালু হওয়ার পরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব একেবারে নির্মূল না হলেও বহুলাংশে কমে গিয়েছে। আর তৃণমূলের বিভিন্ন জনহিতকর প্রকল্প যে ভাবে চারিদিকে সাড়া ফেলে দিয়েছে, তাতে রাজ্যবাসী আর অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের দিকে চোখ তুলে তাকাতে রাজি নয়। আসলে এই পাবলিক ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রামের মাধ্যমে, যেটাকে সিপিএম ‘ডোল পলিটিক্স’ বলে সমালোচনা করে থাকে, বাংলার মানুষের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। বাংলার সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছেন যে, স্থায়ী সরকারি চাকরির দিন প্রায় শেষ। যেটুকু হবে, তা কতটা মেধার ভিত্তিতে বা টাকা-পয়সা লেনদেনের ভিত্তিতে হবে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও গরিব মানুষ এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। তাঁরা শুধু দেখছেন, এই মুহূর্তে হাতে কী পাচ্ছেন। সবচেয়ে বিপদে পড়েছে পড়াশোনা জানা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কারণ, চাকরি নেই। কিন্তু মোবাইল কালচারে তাঁরাও আন্দোলন-বিমুখ হয়ে গিয়েছেন। তাঁরাও এখন জনহিতকর প্রকল্পের ফর্ম পাওয়ার জন্য এখানে-সেখানে ছুটছেন। সিপিএম যদি ভোটে হারের সঠিক কারণ খুঁজতে চায়, তবে আত্মদর্শন ছাড়াও তৃণমূলের এই ভোট কৌশলের দিকেও নজর দিতে হবে।
অশোক বসু
বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
দ্বিচারিতা
‘মুখ বদলাবে হাল ফিরবে না’ প্রবন্ধের শেষাংশে “জরাগ্রস্ত নেতারা নিজেদেরই ধামাধরা নেতাদের গদিতে বসালে মুখ বদল হবে, হাল শোধরাবে কি?” বলে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সেটাই সিপিএম-এর পতনের মূল কারণ বলে মনে করি। এর সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের স্তাবকতাকে প্রাধান্য দেওয়া, দলে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় গুণগত মান সেই
হারে বৃদ্ধি না পাওয়া— এই কারণগুলোও দায়ী।
১৯৭৮ সালে সালকিয়া প্লেনামে ক্যাডার পার্টি যখন ‘মাস পার্টি’তে রূপান্তরিত হয়েছে, তখন বন্যার স্রোতের মতো দলে সদস্য সংখ্যা সর্বত্র বৃদ্ধি পেয়েছে, গুণগত মানে নয়। তাই ১৯৬৭-১৯৭৭ সালে মাত্র ৩৬০০-৩৬০০০ সদস্য যে সাফল্য এনেছিল, তা ২০১১ সালে লক্ষাধিক সদস্য থাকা সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়েছে। চতুর্দিকে ভোগী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মাঝে দীর্ঘ দিন ত্যাগ না কি ভোগ— এই দ্বিচারিতায় ভুগেছে উপর থেকে নিচুতলার বাম নেতৃত্ব। একই নৌকার যাত্রী সেজে সমাজতন্ত্রী আর বুর্জোয়ারা একাকার হয়ে গিয়েছেন। দীর্ঘ ৬৮ বছর কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে বামপন্থীরা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিলেন। কংগ্রেসিদের আক্রমণে হাজারো বামপন্থী নেতা-নেত্রী-কর্মী শহিদ হয়েছেন। আবার বামপন্থী শাসনেও নাকি পাঁচ হাজার কংগ্রেস কর্মী খুন হয়েছেন। দুই দলেরই কর্মীদের পরিবার স্বজন হারানোর যন্ত্রণা ভোলেনি। এমতাবস্থায় দুই দলের নির্বাচনী জোট করা কি যুক্তিযুক্ত ছিল? ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা সিপিএম-কংগ্রেস নেতৃত্বের ভোটের আগে গলাগলি জনগণ মেনে নেননি। ভোট দেবেন তো আমজনতা। আলিমুদ্দিন, বিধান ভবনের নেতারা নন। এই জনগণই ২০০৯ পর্যন্ত সমস্ত নির্বাচনে পাশে থেকেছেন। আজ তাঁরা বোকা হয়ে গেলেন?
রাশিয়া, চিন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কিউবা-সহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশ চালিয়েছেন বামপন্থী বৃদ্ধরাই। তা হলে আজ এ দেশে শুধু বৃদ্ধরাই দোষী সাব্যস্ত হবেন কেন? অন্ধকারে হাতড়ানোর মতো বিজেমূল স্লোগান, ব্রিগেডে ‘টুম্পা সোনা’ গান, আইএসএফ-কে সাদরে ডেকে আনা বুমেরাং-এর কাজ করেছে। তাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বামপন্থী নেতৃত্বের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। শুধু বৃদ্ধতন্ত্র নয়, দ্বিচারিতা, অহঙ্কার বামপন্থীদের গ্রাস করেছে বলেই মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
মৃত্যুঞ্জয় বসু
কলকাতা-৩০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy