বাজির সূচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব দু’শো বছরেরও আগে। একদা বাজি ব্যবহৃত হত শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইতে ও অশুভ আত্মার দূরীকরণে। দীপাবলির উৎসবে বাজি ব্যবহারের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। মানুষ বাজি নিয়ে মাতামাতি করলেও এর কুফল নিয়ে ভাবিত নয়। বাজির জ্বলনে নাইট্রাস অক্সাইড দীর্ঘ সময় ধরে বায়ুমণ্ডলে থেকে বায়ু দূষিত করে, যা কেবলমাত্র ভারী বৃষ্টি ও প্রবল ঝড়েই পরিশুদ্ধ হয়। শব্দদূষণের জেরে প্রবীণ নাগরিকদের হার্টের সমস্যা বেড়ে যায়। বাজির বর্জ্য দূষণ ছড়ায়। বাজির জেরে বিশাল অগ্নিকাণ্ডের কথা সুবিদিত। গর্ভবতী নারী ও গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির কথাও জানা যায়। দূষিত বায়ুর জন্য কমবেশি সকল নাগরিকের নিশ্বাসে বিস্তর অসুবিধা হয়। গৃহপালিত পশুরাও বাজির শব্দে সন্ত্রস্ত হয়।
বাজিতে ব্যবহৃত তামা হার্টে প্রদাহ তৈরি করে ও ক্যাডমিয়াম রক্তে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা দেয়। জ়িঙ্ক বা দস্তার জন্য বমি ও ধুম জ্বর হতে পারে, সিসা স্নায়ুর ক্ষতি করে। জাতীয় পরিবেশ আদালত ২০২০ সালে দীপাবলির উৎসবে বাজি বিক্রি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সেই সঙ্গে কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ স্বচ্ছ কাঁচামাল থেকে সবুজ বাজি তথা ‘গ্ৰিন ক্র্যাকার’ তৈরি করতে থাকে, যা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দূষণ নিয়ন্ত্রণে, এবং প্রচলিত শব্দ-তীব্রতা ১৬০ থেকে ১১০-এ নামিয়ে আনতে সক্ষম। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও শুধুমাত্র সবুজ বাজি ব্যবহারের কথা বলেছে।
কিন্তু বাজি নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিস্তর ফাঁকফোকর থেকে যায়, যার নজির দীপাবলির রাতেই টের পাওয়া যায়। নির্দেশ পালনের দায়ভার যাঁদের, তাঁরাই পরোক্ষে ইন্ধন জুগিয়ে যান। ফলে, সকল নিষেধাজ্ঞা অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হচ্ছে। শুভবুদ্ধির উদয় হোক। বাজি বিলুপ্ত হোক।
ইন্দ্রনীল বড়ুয়া
কলকাতা-১৫
হাতে-গড়া প্রদীপ
দীপাবলি শুনলেই মনে আসে রঙিন আলো, আতশবাজির কথা। আলোর উৎসব, আলো জ্বালানোর প্রতিযোগিতা। বাড়ি, ঘর, দালান ভরিয়ে তুলতে হবে আলোয়। ইতিমধ্যেই বৈদ্যুতিক আলো জ্বলা শুরু হয়ে গিয়েছে। দোকানে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নানা দেশি-বিদেশি আলোর পসরা। তবুও মন ফিরে যায় ছোটবেলার দিনগুলোতে, যখন বৈদ্যুতিক শৌখিন আলো ছিল না। ছিল মোমের বাতি, আর হাতে তৈরি কাদামাটির প্রদীপ। বেশ ক’দিন আগে থেকে তার প্রস্তুতি চলত। মাঠ বা পুকুরের নরম কাদামাটির ছোট ছোট প্রদীপ, তা শুকিয়ে খটখটে করা হত। বাড়ির বড়রাও হাত লাগাতেন। তাতে কাপড়ের সলতে পাকিয়ে সর্ষে বা রেড়ির তেল দিয়ে জ্বালানো হত।
এ ছাড়া ছিল কেরোসিনের কুপি। বাতিল ছোট আকারের লম্বা, চৌকো টিনের পাত্র দিয়ে বাড়িতেই কুপি তৈরি করা হত সলতে পাকিয়ে। সেটাই হত আকাশপ্রদীপ। উঁচু বাঁশে সেই কুপিতে কেরোসিন ভরে বেঁধে দেওয়া হত, সারা রাত জ্বলত। আর তার লালচে আলো ছড়িয়ে পড়ত অনেকটা জায়গা জুড়ে। আর ছিল ‘ধারে মশায়’। হাতে ধরার মতো পাটকাঠির বান্ডিল, বড়রা ধরিয়ে দিতেন ছোটদের হাতে, সাহায্য করতেন তাতে আগুন জ্বালাতে, আর ছোটরা যত ক্ষণ সেই পাটকাঠির জ্বলন্ত বান্ডিল ধরে রাখতে পারত, তত ক্ষণ পর্যন্ত সারা উঠোন জুড়ে ঘুরে ঘুরে বলে চলত, “ধারে মশায়, ধারে”। মশালের মতো ছড়িয়ে পড়ত সেই আলো। এখনও তার কিছু দেখা যায় মাঝেমধ্যে। আর ছিল ছুঁচোবাজি তৈরি। বাজার থেকে তার কাঁচামাল এনে অনেকটা বিড়ির আদলে বানানো। সেই ছুঁচোবাজি বড্ড পাজি। খড়ের গাদা আর খড়ের চাল ছিল তার বড় প্রিয়। তাই সতর্কতা জরুরি ছিল।
সনৎ ঘোষ
বাগনান, হাওড়া
সর্ষে ও ভূত
আদালতের নির্দেশের আগেই বাজি নিয়ে পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়েছে। ছোট ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের কেনা প্রচুর বাজি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বাজেয়াপ্ত বাজি আদৌ নিষ্ক্রিয় হয় কি? শুনেছি, পুলিশ আবাসন-সহ বেশ কিছু সরকারি আবাসনে পুজোর ক’টা দিন বাজি ব্যবহারের পরিমাণ দৃষ্টিকটু ভাবে বেড়ে যায়। আশা করি, আদালতের নির্দেশ পালনে সবাই সমান ভাবে যত্নবান হবেন।
রাধারমন গঙ্গোপাধ্যায়
বজবজ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
আশায় ছাই
কলকাতা হাই কোর্ট রায় দিয়েছিল, আসন্ন কালীপুজো, দীপাবলি, ছট ও জগদ্ধাত্রী পুজোয় সব রকমের বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ। সেই রায় খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট শুধুমাত্র সবুজ বাজি ব্যবহারে সায় দিয়েছে। শব্দবাজি অবশ্যই নিষিদ্ধ হোক, কিন্তু অন্য বাজিতে নিষেধাজ্ঞা কেন? এমনিতেই বাজি বিক্রি ও পোড়ানো অনেক কমে গিয়েছে। আরও আগে থাকতে ঘোষণা হলে তবুও কথা ছিল, এখন ক্ষতি কাদের বেশি? বছরের এই কয়েকটা দিন একটু আয়ের আশাতেও ছাই? এমনিতেই করোনা, লকডাউনে মানুষের আয় কমেছে। সবুজ বাজি, না ক্ষতিকারক বাজি, কোনটা ছাড় পাবে, তা নিয়ে জটিলতা ছিলই। এ বার সবুজ বাজি ছাড়া বাকি সব বেআইনি হল। আরও বিপন্ন হলেন উৎপাদক ও বিক্রেতারা।
শিবপদ চক্রবর্তী
কাঁচরাপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
শিল্পের সুরক্ষা
বাজি থেকে দূষণ কমানোর জন্য সুপ্রিম কোর্ট পরিবেশবান্ধব বাজি বানানোর দায়িত্ব দেয় ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট, সংক্ষেপে ‘নিরি’-র উপরে। নিরি অতি ক্ষতিকারক কিছু মশলা বাদ দিয়ে, কম ক্ষতিকারক কিছু রাসায়নিক কমিয়ে, ১০-১৫ রকমের পরিবেশবান্ধব বাজি তৈরি করে। উল্লেখ্য, এখন নিরি-র অনুমোদন ছাড়া বাজি তৈরি করা যাবে না। কিছু রাজ্যের বাজি উৎপাদকরা নিরি-র প্রশিক্ষণ নিয়ে এমন বাজি বানাচ্ছেন।
প্রশ্ন হল, বাজি কারখানাগুলি বন্ধ হলেই কি পরিবেশ দূষণ বন্ধ হবে? না, বরং বিপদে পড়বে হাজার হাজার পরিবার। বাজি উৎপাদক ও বিক্রেতাদের উপর নজরদারির সুবিধার জন্য ‘বাজি নগর’ তৈরি করা যেতে পারে। লাইসেন্সহীন উৎপাদকদের চিহ্নিত করে লাইসেন্স দেওয়া যায়। অগুনতি মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করতে এখনই তার আধুনিকীকরণ করা দরকার।
গোবিন্দ চক্রবর্তী
কলকাতা-৭৫
কবে টনক নড়বে
কালীপুজো, দীপাবলি উপলক্ষে প্রতি বছরই বাজি পোড়ানো নিয়ে আদালতের তরফে বহু কড়াকড়ি হয়, যা সাধুবাদযোগ্য। তবে এক দিন বা দু’দিন ধরে বাজি পুড়লে যে ক্ষতি হয়, তার চেয়েও বিপুল ক্ষতি হয়েছে উন্নয়নের নামে অরণ্য সাফ করে। মূল্যবান ম্যানগ্রোভ অরণ্য চোরাচালানকারীরা সাফ করার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। আছড়ে পড়ছে আয়লা, আমপান, ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়। অথচ, কিছু বছর আগে অবধিও এই ঝড়ের তাণ্ডব উপকূল পেরিয়ে শহরে প্রবেশ করতে পারত না। গাছের অভাবে মাটির ধারণ ক্ষমতার দুর্বলতা প্রকট হয়েছে। শিকড় যে প্রাকৃতিক বাঁধ নির্মাণ করে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে, তাও অবরুদ্ধ হয়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। অতএব বাজি পোড়ানোকে কেন্দ্র করে এই সময়ে যে তৎপরতা দেখা যায়, সেই তৎপরতা সারা বছর ধরেই পরিবেশকে রক্ষা করে চলুক। আদালত কৃত্রিম অরণ্য গড়ে তুলতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিক। বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় আছে কি না, দেখার জন্য বিশেষজ্ঞদের দল গড়া হোক।
আমরা উন্নয়নের আড়ালে ভয়াবহ ভবিষ্যৎকে প্রতিপালন করে চলেছি, যা শুধুমাত্র বাজি পোড়ানো বন্ধ করে আটকানো সম্ভব নয়। আরও কতটা ক্ষতি হলে টনক নড়বে?
শুভজিৎ বসাক
কলকাতা-৫০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy