Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Science

সম্পাদক সমীপেষু: বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ

দেশের ও দশের বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে চালিত হওয়ার জন্য সরকার পোষিত যে সংস্থার জন্ম, তা একটি রাজনৈতিক দলের ধর্মরক্ষার কাজে নিয়োজিত হবে কেন?

কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর)।

কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর)। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:২৭
Share: Save:

‘নিরালোক’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে (২৮-১১) যথার্থই প্রশ্ন করা হয়েছে, “যাঁদের ব্যস্ত থাকার কথা বৃহত্তর লক্ষ্যে— গবেষণার প্রসারে, মানুষের কল্যাণে, বিজ্ঞানেরই স্বার্থে— তাঁরা মগ্ন দেববিগ্রহ আলোকিত করার কাজে। নির্বাচন ও ভোটারের মন জিততে এমন কাজ রাজনৈতিক দল ও সরকারের কাজে লাগবে বটে, কিন্তু বিজ্ঞানের জন্য এ কি খুব সুস্থ বিজ্ঞাপন?” পাঁচশো বছরের পুরনো সৌধ গুঁড়িয়ে সেখানে ভাবাবেগ ও বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে রামমন্দির নির্মাণ দেশের সংখ্যাগুরু জনগণের ধর্মপালন ও এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের লক্ষ্যপূরণের আনুপাতিক মিশেল বলে অনেকেই মনে করেন। সেই মন্দির নির্মাণের এক বিশেষ অধ্যায়ে (রামনবমীর দিনে সূর্যালোকের প্রথম কিরণ বিগ্রহের উপর স্পর্শ করার কারিগরি প্রকৌশল উদ্ভাবন) দেশের বিজ্ঞান গবেষণা ক্ষেত্রের অগ্রণী সংস্থা কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর)-এর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত ভাবে সংবিধানসম্মত নয়। দেশের ও দশের বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে চালিত হওয়ার জন্য সরকার পোষিত যে সংস্থার জন্ম, তা একটি রাজনৈতিক দলের ধর্মরক্ষার কাজে নিয়োজিত হবে কেন? করদাতাদের টাকা এই কাজে ব্যবহার করা কত দূর সঙ্গত, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। মন্দির নির্মাণ কমিটি আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে এই প্রযুক্তি আমদানি করে এই বিশেষ উদ্দেশ্য রূপায়ণ করলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। স্বভাবতই বহু বিজ্ঞানী সিএসআইআর-এর এই কাজের বিরোধিতা করেছেন।

“মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম সম্পদগুলির মধ্যে বিজ্ঞান অন্যতম। সেই সম্পদ যাতে বোঝায় পর্যবসিত না হয়, বিজ্ঞানীরা যাতে অতি প্রত্যয়ের শিকার হয়ে এক অমানবিক, অনৈতিক আবর্তে ঘুরপাক না খান, তার জন্য দরকার বিজ্ঞান-অবহিত, বুদ্ধি বিভাসিত জাগ্রত জনমত। বিজ্ঞানের পথভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর চেক-ভালভ সেটাই।”— লিখেছিলেন আশীষ লাহিড়ী, এই সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাঁর একটি প্রবন্ধে (‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’, বিজ্ঞানীর ঈশ্বর ও অন্যান্য বিতর্ক, আশীষ লাহিড়ী)। এখন ক্রমশ হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে চলার পথে চেক-ভালভ কতটা কার্যকর হয়, সেটাই দেখার!

সরিৎশেখর দাস , ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

খণ্ডিত বাক্য

দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় তাঁর চিঠিতে (‘প্রতিদ্বন্দ্বী নেহরু’, ১৮-১১) লিখেছেন, “...নেহরু বলেন, সুভাষ জাপানিদের নিয়ে ভারতে ঢুকলে তিনি নিজে গিয়ে যুদ্ধ করবেন।” পত্রলেখক দুর্ভাগ্যজনক ভাবে একটি খণ্ডিত বাক্য উদ্ধৃত করেছেন।

১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করে। বোঝা গেল কংগ্রেসও চূড়ান্ত সংগ্রামের আহ্বান জানাতে চলেছে। এই বিষয়ে ১২ এপ্রিল এক সাংবাদিক সম্মেলনে সুভাষচন্দ্রের অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে পণ্ডিত নেহরু বলেছিলেন— “আমাদের অতীত বন্ধুত্বের জন্য আমি তার রাজনৈতিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারব না এবং তার বিরুদ্ধে কিছু বলতেও পারব না। আমি মনে করি, সে যে পথ গ্রহণ করেছে তা দেশের ভাল হবে ভেবেই করেছে।” যদিও নেহরু এমন কথাও বলেছিলেন যে, জাপান ভারতে আগ্রাসী বাহিনী নিয়ে প্রবেশ করলে তা প্রতিরোধ করতে হবে। (‘দ্য কংগ্রেস অ্যান্ড দ্য ক্রিপস অফার’, প্রেস সাক্ষাৎকার, ১২ এপ্রিল ১৯৪২, নেহরু, সিলেক্টেড ওয়ার্কস, দ্বাদশ খণ্ড)।

ওই সাংবাদিক সম্মেলনে নেহরু এ কথাও বলেন যে, “অনেক দিন হল আমরা পরস্পর থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছি। এই ঘটনা আমার পক্ষে আদৌ ভাল নয়। এই বন্ধুত্বের জন্য আমি তার উদ্দেশ্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারব না ও কিছু বলতেও পারব না।” নেহরু বলেন, “বাইরে থেকে কোনও বাহিনী যদি ভারতে আসে, তা জাপানের নিয়ন্ত্রণের অধীনেই থাকবে। মানসিক ভাবে ভারতীয় জনগণের পক্ষে ওই চিন্তা করা উচিত নয় যে, কোনও বৈদেশিক শক্তি এসে তাঁদের ব্রিটিশ অধীনতা থেকে মুক্ত করবে।”

এর ক’দিন পর ২৪ এপ্রিলের সাংবাদিক সম্মেলনে নেহরু বলেছিলেন “হিটলার এবং জাপানের নরকে যাওয়াই উচিত।” ওই সম্মেলনেও তিনি বলেন আগ্রাসী বাহিনী নিয়ে জাপান ভারতে প্রবেশ করলে তা প্রতিরোধ করতে হবে। এই দু’টি সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও নেহরু মনে করেছেন, সুভাষ যা করছেন তা দেশের ভালর জন্যই করছেন। পণ্ডিত নেহরু তাঁর তীব্র ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য জাপান ও জার্মানির মতো উগ্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় দেশকে স্বাধীন করার পন্থায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি ইউরোপ ও এশিয়ার পদানত দেশগুলির মানুষের উপর নাৎসি ও ফ্যাসিস্টদের ভয়াবহ অত্যাচারের কথা জানতেন। নেতাজি সুভাষও ১৯৩৮ সালে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট নেতা রজনী পাম দত্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে (ডেইলি ওয়ার্কার পত্রিকায় ২৪ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত) ফ্যাসিবাদের চরম আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেন (ভারতের মুক্তি সংগ্রাম, পৃ ২২৩-২২৪, সুভাষচন্দ্র বসু)।

পত্রলেখক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন— জাপানের বিরোধিতা করলেও পরে এই অবস্থানের বিপরীতে গিয়ে নেহরু গণপরিষদ নির্বাচনে ভোট পাওয়ার জন্য আজ়াদ হিন্দ ফৌজের হয়ে সওয়াল করেন। বোঝা গেল, তিনি ফ্যাসিবাদী জাপান ও আজ়াদ হিন্দ ফৌজের পার্থক্যটা গুলিয়ে ফেলেছেন। তিনি কি জানেন না, আজ়াদ হিন্দ ফৌজ যুদ্ধ করছিল নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য, আর জাপান ছিল পররাজ্যগ্রাসী। আজ়াদ হিন্দ ফৌজ অন্য কোনও দেশ আক্রমণ করেনি। আইএনএ ট্রায়ালে সামরিক আদালতে এটাই ছিল নেহরু-সহ কংগ্রেসের আইনজীবীদের বক্তব্য।

১৯৪৬ সালের শেষে এশীয় সম্মেলনের প্রস্তুতির জন্য নেহরু যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যান, তিনি সিঙ্গাপুরে নির্মিত আজ়াদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন (জওহরলাল নেহরু— আ বায়োগ্রাফি, প্রথম খণ্ড, সর্বপল্লি গোপাল)। পণ্ডিত নেহরুকে সতর্ক করে বলা হয়েছিল যে, মালয় ও সিঙ্গাপুরের চিনা বাসিন্দারা আজ়াদ হিন্দ ফৌজ ও নেতাজি সুভাষকে সমর্থন করার জন্য তাঁর (নেহরু) বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে পারেন। কেননা চিন আক্রমণকারী জাপানের সঙ্গে নেতাজি সুভাষ জোট করেছিলেন। কিন্তু পণ্ডিত নেহরু সিঙ্গাপুর ও মালয়ের জনসভায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, নেতাজি সুভাষ কখনও জাপানের চিন আক্রমণকে সমর্থন করেননি, তিনি চিনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন (সমগ্রন্থ, পৃ ৩১০)।

গণপরিষদের ভোট প্রসঙ্গে বলি, সংবিধান প্রণয়নকারী গণপরিষদ আদৌ জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়নি। ডিসেম্বর, ১৯৪৫ থেকে জানুয়ারি, ১৯৪৬-এর ভোটে নির্বাচিত হয় প্রাদেশিক আইনসভাসমূহ। ১৯৪৬-এর মে মাসে ক্যাবিনেট মিশনের সুপারিশে সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যরা অগস্ট মাসে ভোট দিয়ে গণপরিষদ নির্বাচন করেন। তার আগেই আইএনএ ট্রায়াল সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।

গণপরিষদের সঙ্গে আজ়াদ হিন্দ ফৌজ ও নেহরুর নির্বাচনী কৌশলের কী সম্পর্ক ছিল? প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন যে, রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এই দুই নেতা ছিলেন পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সুভাষচন্দ্র বসু আইএনএ-র একটি ব্রিগেডের নামকরণ করেছিলেন পণ্ডিত নেহরুর নামে। ১৯৪৬ সালের ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনে আয়োজিত সভার ভাষণে নেহরু বিস্তৃত ভাবে বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজি যে সঙ্কট মোকাবিলা করেছিলেন, সেই সম্পর্কে বলেছিলেন। আজ়াদ হিন্দ বাহিনীতে সুভাষচন্দ্র যে অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন, তারও ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন পণ্ডিত নেহরু (নেহরু অ্যান্ড বোস: প্যারালাল লাইভস, রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়)।

অমিতাভ সিংহ, কলকাতা-৬৪

অন্য বিষয়গুলি:

Science Ram Mandir
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy