Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

গাঁধীজির সত্যধর্ম

এই ধর্মচেতনা সম্পর্কে পান্নালাল দাশগুপ্তের বক্তব্য একদম পরিষ্কার: ‘‘ভগবানের নামে, ধর্মের নামে পৃথিবীতে কত অধর্ম হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তারই জন্য ভগবানের সংজ্ঞা শুদ্ধ করার প্রয়োজন হয়েছিল গান্ধীজির কাছে।’’

মহাত্মা গাঁধী।

মহাত্মা গাঁধী।

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৪০
Share: Save:

‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় গাঁধীজি তাঁর একটি প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখছেন, ‘‘আমি ভারী স্বার্থপর। চারিদিকে তুমুল ঝড়, তারই মধ্যে আমি শান্তিতে থাকতে চাই। পরীক্ষা চালাই নিজের ওপর। পরীক্ষা চালাই রাজনীতির মধ্যে ধর্মকে নিয়ে এসে। কিন্তু ধর্ম কাকে বলে? একটু বুঝিয়ে বলি। ধর্ম এখানে হিন্দু ধর্ম নয়। এই ধর্ম হিন্দু ধর্মকেও ছাপিয়ে যায়। এই ধর্ম মানুষের মূল প্রকৃতিকে পাল্টে দেয়। মানুষের ভিতরে আর বাইরে যে সত্য বিরাজ করছে, সেই সত্যের সঙ্গে মানুষকে অচ্ছেদ্য ভাবে বেঁধে দেয়। এই ধর্ম মানুষকে নিত্য শোধন করে।’’

এই ধর্মচেতনা সম্পর্কে পান্নালাল দাশগুপ্তের বক্তব্য একদম পরিষ্কার: ‘‘ভগবানের নামে, ধর্মের নামে পৃথিবীতে কত অধর্ম হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তারই জন্য ভগবানের সংজ্ঞা শুদ্ধ করার প্রয়োজন হয়েছিল গান্ধীজির কাছে।’’ অশীন দাশগুপ্তের মতে, গাঁধীর ঈশ্বর আসলে তর্কে বহুদূর। তিনি মনেপ্রাণে হিন্দু ছিলেন। কিন্তু জাতিভেদ মানতেন না। হিন্দু মতের চেয়ে গভীরে অন্য একটি সত্য মত নিজের জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন। যদি এই সত্যধর্মের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের সংঘাত বাধত, গাঁধী তাঁর অন্তরের সত্যধর্মের পথই অনুসরণ করতেন। যদিও গাঁধী নিজেকে সাচ্চা হিন্দু বলেই মনে করতেন আর তাঁর নিজস্ব সত্যধর্মের সঙ্গে এর কোনও বিরোধই তিনি স্বীকার করেননি। গাঁধীর পথ সত্যের পথ।

সত্যই তাঁর কাছে ঈশ্বর। এই সত্যধর্মবোধ থেকেই তিনি শুরু করেছিলেন ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’।

গাঁধীজির ধর্মচেতনার সন্ধান পেতে গেলে তাঁর শৈশবে ফিরতেই হবে। যে পারিবারিক ধর্মীয় ভাবধারায় তিনি বড় হয়েছেন, সেখানে প্রাণনাথী সম্প্রদায়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। গাঁধীর বাবা এবং মা সেই সৎ প্রণামী বা প্রাণনাথী সম্প্রদায়ের মানুষ। আঠারো শতকের গোড়ায় প্রাণনাথ নামের এক সাধক এই গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রাণনাথের উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দু ও ইসলাম-সহ সকল ধর্মের সমন্বয় সাধন। এই সম্প্রদায়ের মন্দিরে কোরান ও পুরাণ একত্রে রাখা হত। এদের মন্দিরের গায়ে লেখা থাকত কোরানের বাণী। মা পুতলি বাই সেখানে শিশু গাঁধীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। এই সৎ প্রণামী সম্প্রদায়ের মানুষেরা হিন্দু হলেও, মনের মধ্যে কোনও রকম সঙ্কীর্ণতাকে ঠাঁই দেননি। শৈশব থেকে গাঁধীজির মনেও তাই কোনও বিভেদের বিষ প্রবেশ করতে পারেনি।

এই ধর্মীয় বোধই ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটায় গাঁধীজির। ছোট্ট মনু থেকে মোহন, মোহন থেকে মোহনদাস, মোহনদাস থেকে মহাত্মা। তাঁর কাছে এই পারিবারিক ধর্মীয় পরিবেশই ছিল অহিংসার প্রথম পাঠ।

তাঁকে অস্পৃশ্যতা কোনও দিন স্পর্শ করতে পারেনি। গাঁধীজি পরিতাপ করেছিলেন, পুরীর মন্দিরে হরিজনেরা প্রবেশাধিকার পায় না। কস্তুরবা তাঁকে না জানিয়ে পুরীর মন্দিরে প্রবেশ করায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং শোনা যায়, তাঁর রক্তচাপও বেড়ে যায়। নিজের হৃদয়ে তিনি যে সত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, তা বহু মানুষের কাছে বোধগম্য না হলেও, তা ছিল খাঁটি সোনার মতন। নির্মল কুমার বসুকে তিনি বলেছেন, সত্যের প্রচারকে নিরোধ করার চেষ্টা করলেও তুমি সফল হবে না। আমাদের জীবন যদি অন্তরস্থিত সত্যের দ্বারা শাসিত হয়, তবে সেই জীবন হতেই সত্য বিকীর্ণ হবে। সত্য স্বভাবতই ব্যাপ্তিশীল। সূর্য যেমন নিজের আলো লুকিয়ে রাখতে পারে না, সত্যের আলোও তেমনই চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

গাঁধীজির ধর্মে অহিংসাই ছিল প্রাণ। এই অহিংসা আসলে ঠিক কী, দেশবাসী সে দিনও বোঝেনি। আজও পরিপূর্ণ বোঝে বলে মনে হয় না। ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় গাঁধী লিখছেন, কাপুরুষের মতো কিছু মেনে নেওয়ার চেয়ে হিংসাত্মক বিদ্রোহ অনেক ভাল। তবে সেই সঙ্গে এটাও তিনি মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, হিংসার ফল কখনও ভাল হয় না। হিংসার আবর্তের মধ্যে এক বার প্রবেশ করলে, সেখান থেকে মুক্তির উপায় মেলে না।

প্রয়োজনে হিংসার পথেও তাঁর অনুমোদন ছিল। বেলেঘাটায় তখন দাঙ্গা চলছে। ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বর মাস। একটি সম্প্রদায়ের কিছু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। সেই সময় কিছু স্বেচ্ছাসেবক নিরীহ মানুষকে রক্ষার জন্য লাইসেন্স-বিহীন অস্ত্র রাখার জন্য গাঁধীর কাছে আবেদন করেন। গাঁধীজি তাদের সেই অনুমতি তো দিয়েইছিলেন, পুলিশ যাতে লাইসেন্স-বিহীন অস্ত্র রাখার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের গ্রেফতার না করে, সে প্রয়াসও করেছিলেন। তবে আবারও বলতেই হবে, তিনি আজন্মকাল অহিংসার পূজারি। অহিংসা তাঁর কাছে এমনই এক শক্তি, যা মানুষকে আত্মশক্তিতে বলিয়ান করে। অস্ত্রশক্তি তো দুর্বলের হাতিয়ার।

অহিংসা প্রসঙ্গে গাঁধীজি বলেছিলেন, ‘‘অহিংসা আমার নিকট ধর্ম, আমার প্রাণস্বরূপ। হয়তো এক-আধ জনের নিকটে প্রসঙ্গক্রমে আমি অহিংসাকে ধর্মস্বরূপ গ্রহণ করিবার কথা বলিয়া থাকিব, কিন্তু ভারতবর্ষের পক্ষে আমি অহিংসা ধর্মস্বরূপ গ্রহণ করিবার কথা কখনও বলি নাই। রাজনৈতিক জীবনে সিদ্ধিলাভের উপায়স্বরূপ গ্রহণ করিবার জন্যই আমি কংগ্রেসের নিকট উহা উপস্থাপিত করিয়াছি এবং রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্যই ইহা ব্যবহার করিতে বলিয়াছি। হয়তো এরূপ উপায়ের মধ্যে অভিনবত্ব থাকিতে পারে; কিন্তু অভিনব বলিয়াই ইহার রাজনৈতিক দিকটি বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়।’’ (গান্ধীচরিত: নির্মল কুমার বসু)।

আজও আমরা গাঁধীজির ধর্মকে অনুধাবন করতে পারলাম না। হিংসার বীজমন্ত্র আমাদের অন্তরে। যার হাতে অস্ত্র আছে, সে অস্ত্র হাতে অন্যকে মারতে উদ্যত হয়। আর যার হাতে অস্ত্র নেই, সে মুখের ভাষায়, দৈহিক ভঙ্গিমায় ক্রমাগত হিংসার প্রকাশ দেখিয়ে চলেছে। এই জাতিরই তো জনক তিনি। এর চেয়ে আশ্চর্যের আর কী-ই বা হতে পারে!

সুদীপ বসু

রহড়া, খড়দহ

‘‘বাঘেও রাষ্ট্রভাষা কয়’’ (১৭-৯) নিবন্ধে আবাহন দত্ত উল্লেখ করেছেন, ‘‘স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কাজ চালাতে গেলে একটা সাধারণ ভাষার প্রয়োজন হয়। সমস্ত বহুভাষিক দেশেই এ রকম একটা সংযোগ ভাষা বা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা থাকে।’’ প্রশ্ন হল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সগর্বে জাহির করেন, হিন্দিতে বেশি লোক কথা বলে বলেই একটা বহুভাষী দেশে হিন্দি ভাষাই ভারতের ঐক্যকে ধরে রাখতে পারবে, তখন এমন বক্তব্যটি আধিপত্যকামী, অভিসন্ধিমূলক ও অগণতান্ত্রিক প্রয়াস বলে কি চিহ্নিত করা যায় না? রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলা ভাষার পরিচয়’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘‘রাষ্ট্রিক কাজের সুবিধা করা চাই বই কি, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কাজ দেশের চিত্তকে সরস, সরল ও সমুজ্জ্বল করা। সে কাজ আপন ভাষা নইলে চলে না। দেউড়িতে একটা সরকারি প্রদীপ জ্বালানো চলে: কিন্তু তার তেল জোগাবার খাতিরে ঘরে ঘরে প্রদীপ নেবানো চলে না।’’ তাই এই প্রশ্ন উঠে আসে— দেশের অন্তর্নিহিত ‘চিত্ত’কে জয় না করে, হিন্দিকে এক ভাষার বেগে চালনা করাটা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দাদাগিরিসুলভ মানসিকতার একটা বড় অভিমুখ নয়? উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির তলে তলে ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’ নামক মোক্ষম চালটি কেন তবে সর্বত্র এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে প্রভাব বিস্তার করছে? অহিন্দিবাসী রাজ্যগুলোতে হিন্দি আগ্রাসনের কুটিল ও সঙ্কীর্ণ প্রভাবটি কিন্তু বহু কালের জীবন-মরণ সংগ্রামের, যা আজও চলছে ক্ষমতাসীন রাজনীতির নানা মোড়কে। স্লোগান উঠছে: ‘‘জাতীয় ঐক্য বজায় রাখুন— বেশি করে হিন্দি বলুন।’’ এতে কি আপন ভাষার অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে ক্রমশ এক মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ছে না? হিন্দিকে জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়ায় সর্বত্র বাধ্যতামূলক হিসেবে কেন সুপারিশ করা হয়েছে? সবচেয়ে আশঙ্কা এটাই: পরিচিতির সত্তাকে দূরে ঠেলে, সব নিষ্প্রভ বা ম্রিয়মাণ প্রদীপকেও এখন যেন কেন্দ্রীভূত ঐক্যের ভাষার ছকে এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে— একমাত্র শক্তিশালী সরকারি প্রদীপে ঠিক ভাবে তেল জুগিয়ে যেতে, যাতে সেই বলিষ্ঠ প্রদীপটিই কেবল সবার চোখে আরও ভাল ভাবে আলোকিত হয়ে উঠতে পারে!

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

অন্য বিষয়গুলি:

Mahatma Gandhi Non violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy