হেমন্ত মুখোপাধ্যায়.
সত্তরের দশকের শেষের দিক। কলকাতা দূরদর্শনের ইন্দ্রাণী রায়ের ইচ্ছে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের চার কিংবদন্তি, দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করবেন। কিন্তু তখন প্রথম তিন জনের সম্পর্কে জমেছিল অস্বস্তির মেঘ। ইন্দ্রাণী ধরলেন চতুর্থ জনকে। হেমন্ত আশ্বাস দিলেন, তিনি থাকবেন। জর্জ বিশ্বাস জানালেন, হেমন্ত থাকলে তিনিও থাকবেন। সুচিত্রা-কণিকাও রাজি, ওই শর্তেই।
অনুষ্ঠানের দিন সুন্দর ভাবে সব কিছু সামাল দিলেন হেমন্ত। চার মহাশিল্পীর সেই দুর্লভ আলাপচারিতা সেই সময়ে সম্প্রচারিত হয়েছিল, কিন্তু পরে আর দেখানো হয়েছে কি? অনিল চট্টোপাধ্যায়ও একটি সু-সঞ্চালিত সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন হেমন্তের। এই দু’টি অসামান্য অনুষ্ঠান আজ আড়ালে।
বেতারে হেমন্তের গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত (‘মনমোহন গহন’, ‘যদি হায় জীবনপূরণ’, ‘তিমিরদুয়ার খোল’, ‘ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার’ এবং একক কণ্ঠে ‘এখন আর দেরি নয়, ধর গো তোরা’ প্রভৃতি), রজনীকান্তের ‘স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি’, নজরুলের ‘মেঘলা নিশিভোরে’, বেশ কিছু রম্যগীতি, এ ছাড়াও ‘তুমি নির্মল কর’, ‘চলিয়াছি গৃহপানে’ প্রভৃতি গান ব্যক্তিগত সংগ্রহের বাইরে প্রকাশ করারও উদ্যোগ করা হয়নি। বিশিষ্ট বেতার-সাংবাদিক মৃত্যুঞ্জয় ঝা ‘সদা বাহার সুর’ অনুষ্ঠানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন হিন্দিতে। সেখানে এমন কিছু কথা বলেছিলেন হেমন্ত, যা তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্ব এবং গভীর সঙ্গীত-মননে উজ্জ্বল। সেই সাক্ষাৎকারও এই প্রজন্মের মানুষের কাছে ‘অপ্রকাশিত’।
পৃথা কুণ্ডু
কলকাতা-৩৫
বাপুর গাছেরা
মহাত্মা গাঁধীর ১৫০ বছরের জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন করার এক অভিনব উদ্যোগ করেছে তাঁর জন্মভূমি গুজরাতের সরকার। ১৯৩২ সালে ওয়ার্ধা স্টেশনের পাঁচ মাইল দূরে জমনালাল বজাজ কিছু জমি দেন, যেখানে গাঁধীজি নিজের জীবনাদর্শ অনুযায়ী আশ্রমবাস করতে পারবেন। আশ্রমে যাওয়ার সেই রাস্তার দু’ধারে আশ্রমবাসীদের হাতে লাগানো গাছগুলি এ বছর কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গুজরাত সরকার, যাতে ওই রাস্তা চওড়া করে আশ্রমের ভেতর পর্যন্ত পর্যটকদের বিলাসবহুল বড় গাড়ি ঢুকতে পারে। কস্তুরবা এবং মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর পরিবারের সদস্যরা দুনিয়ার নানা দেশ থেকে সম্মিলিত ভাবে এই গাছ কেটে ফেলার বিরুদ্ধে ‘করজোড়ে আবেদন’ জানিয়েছেন কেন্দ্রকে।
গাঁধীজির প্রপৌত্র তুষার গাঁধী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে লিখেছেন, ওই আশ্রমের জায়গাটি আদতে ছিল জলহীন, প্রায় ঊষর। সেই সময়ের আশ্রমিক, এমনকি শিশুরাও ওই গাছগুলি লাগায়, নিজের হাতে দূর থেকে জল বয়ে এনে সেগুলিকে বাঁচায়। তখন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত যে অসংখ্য মানুষ বাপুর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তাঁদের অনেকেই গাছ লাগিয়েছিলেন। ওই গাছগুলি কাটার অর্থ ইতিহাসের চিহ্নকে মুছে ফেলা।
চিঠি লিখেছেন প্রবীণা এলা গাঁধী, রাজমোহন গাঁধী, গোপালকৃষ্ণ গাঁধী, অরুণ গাঁধী প্রমুখ। তাঁরা বলেছেন, এই গাছগুলি গাঁধীজির আদর্শের পরিচায়ক। বাপুর কাছে শারীরিক পরিশ্রমের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, যাঁরা আশ্রমে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন, তাঁরা যেন
ওই পাঁচ মাইল পথ হেঁটে আসেন। তবেই তাঁরা আশ্রমের শিক্ষা সহজে বুঝতে পারবেন এবং তার কদর করতে পারবেন।
অলোক বসু
কলকাতা-১৯
শান্তিদেবের বাড়ি
সঙ্গীত ভবন এবং কলাভবনের অনতিদূরে অবস্থিত ঘোষ পরিবারের মাটির বাড়িটি আমার জেঠামশাই শান্তিদেব ঘোষের বাড়ি বলে পরিচিত। এই বাড়িটির সঙ্গে শান্তিনিকেতনের জীবন ও ঐতিহ্যের নাড়ির যোগ আছে। বর্তমানে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বাড়িটির সামনে দিয়ে একটি আট ফুট উঁচু পাঁচিল তুলে দিয়েছেন তাঁদের জমির সীমানা বরাবর। ফলে বাড়িটি সাধারণের দৃষ্টির আড়াল হয়ে গিয়েছে এবং বিশ্বভারতীর সঙ্গে তার যোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, যা কখনও বাঞ্ছনীয় নয়।
শ্রীপল্লিতে অবস্থিত এই বাড়িটি ১৯৩০ সালে শান্তিদেবের পিতা কালীমোহন ঘোষ তৈরি করেন। তিনি ১৯০৭-১৯৪০ সাল পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে কর্মরত ছিলেন। শ্রীনিকেতনের গ্রামীণ পুনর্গঠনের কাজে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের এক জন প্রধান সহায়ক। তিনি লেনার্ড এলমহার্স্ট-এর সঙ্গে শ্রীনিকেতনে কাজ করেছেন। কালীমোহনের মৃত্যুর পরেও এলমহার্স্ট সাহেব যখনই শান্তিনিকেতনে এসেছেন, এ বাড়িতে এসে কালীমোহনের স্ত্রী, আমার পিতামহী মনোরমা দেবীর সঙ্গে দেখা করেছেন। এই বাড়ির উঠোনে গ্রামের মানুষের নিত্য যাতায়াত ছিল, তাঁদের নানা সমস্যার কথা কালীমোহনের সঙ্গে আলোচনার জন্য। তাঁরা সচরাচর মনোরমা দেবীর হাতে দুপুরের খাওয়া খেয়ে যেতেন।
কালীমোহনের জ্যেষ্ঠপুত্র শান্তিদেব ঘোষ তাঁর ২০ বছর বয়েস থেকে আমৃত্যু এই বাড়িতেই থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত, নৃত্য এবং নাটকের শিক্ষা ও প্রযোজনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি, রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে এবং তার পরেও। পৌষমেলার সময়ে বিভিন্ন লোকসঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয়ের যে বিশাল আয়োজন হয়, তার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন শান্তিদেব। এই সূত্রে বাউল নবনীচন্দ্র দাস, পূর্ণচন্দ্র দাস এবং অন্য অনেক লোকশিল্পী এই বাড়িতে এসেছেন। তখন পৌষমেলার সময় যাঁরা সানাই বাজাতেন, তাঁরা এসে প্রথম শান্তিদেব ঘোষের সঙ্গে দেখা করতেন। শান্তিদেবের সঙ্গীতভবন এবং কলাভবন-সংক্রান্ত সমস্ত কাজ, এবং তাঁর গবেষণা ও গ্রন্থরচনা সবই এই বাড়িতে বাস করাকালীন। ঘোষ পরিবার এই পারিপার্শ্বিক এবং প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মাটির বাড়িতেই বাস করেন। সামর্থ্য থাকলেও অন্য কোনও আধুনিক বাড়ি করে আলাদা হয়ে যাননি। শান্তিদেবের অবদান অনস্বীকার্য। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। তাঁর সম্মানে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়।
শান্তিদেবের স্ত্রী ইলা ঘোষ গ্রামীণ মহিলাদের উপার্জনের জন্য কাঁথার নকশা এবং সেলাই শিখিয়ে, তাঁদের তৈরি শাড়ি, শাল, ব্যাগ ইত্যাদি বিক্রির ব্যবস্থা করতেন। এই বাড়িটি সঙ্গীত, শিল্প, সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক জগতের নানা মানুষের যাতায়াতে সমৃদ্ধ হয়েছে। এঁদের মধ্যে কয়েকটি নাম হল সুচিত্রা মিত্র, গৌরকিশোর ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অমিতাভ চৌধুরী, অপর্ণা সেন প্রমুখ। দেশ-বিদেশের বহু প্রজন্মের সহস্রাধিক মানুষ, যাঁরা এই আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত, প্রাক্তনী এবং ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে এই বাড়ির হৃদয়ের যোগ রয়েছে। বাইরের পর্যটকরা অনেকেই বাড়িটি দেখতে আসেন।
শান্তিনিকেতনের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ এই বাড়িটি যদি বিশ্বভারতীর পাঁচিলের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক হবে। শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগে জ্ঞানীগুণী মানুষেরা যে অত্যন্ত সাধারণ মাটির বাড়িতে থাকতেন, তার বেশির ভাগই হয় বিলুপ্ত, নয়তো কেবল দ্রষ্টব্য হিসেবে রয়ে গিয়েছে। কেবল এই বাড়িটি ছাড়া।
শমীক ঘোষ
আমদাবাদ, গুজরাত
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy