‘অনির্বাণ প্রদীপশিখা’ (৬-৩) শীর্ষক রচনাটিতে স্বাতী ভট্টাচার্য বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। নারী স্বাধীনতার রুপালি আলোকরেখা কখনও সরলরৈখিক ভাবে সমাজে এসে পৌঁছয়নি। বেঁকেচুরে, দুমড়ে-মুচড়ে এসেছে, এখনও আসছে। প্রকৃতপক্ষে নারীমুক্তির ধারণা আত্মসচেতনতারই অঙ্গ। ইবসেনের ডলস হাউস-এর নোরা, ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের মৃণাল, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মিনী উপাখ্যান, মাইকেলের বীরাঙ্গনা প্রভৃতি কাব্যের মেয়েরা বেরিয়ে এসেছে সংসারের চৌহদ্দি ছেড়ে, বৃহৎ জগতে। প্রথম প্রতিশ্রুতি-র গোড়ার কথায় আশাপূর্ণা দেবী লিখেছিলেন, “স্তিমিত অন্তঃপুরের অন্তরালেও কি চলে না ভাঙা গড়ার কাজ। সেখান থেকেও রঙ বদল হয় সমাজের, যুগের, সমাজ মানুষের মানসিকতার।”
ঠিক যে ভাবে লেখাপড়া শেখার প্রবল আগ্রহে রান্নাঘরের হাতা, খুন্তি, বেড়ির আড়ালে স্বামীর চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থের একটি ছেঁড়া পাতা লুকিয়ে রেখেছিলেন রাসসুন্দরী দেবী। নিজ জেদ এবং একনিষ্ঠতায় ভর করে প্রবীণ বয়সে নিজের জীবনচরিত রচনা করেন তিনি। মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার অন্তর্গত চোঁয়া গ্রামের কৃষ্ণভাবিনী দাস নিজ স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে স্বামী দেবেন্দ্রনাথ দাসের বিলেতযাত্রার সকল ব্যয়ভার নিজে বহন করেছিলেন। উনিশ শতকে তাঁর লেখা ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলা বইয়ে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বক্তব্যই ধ্বনিত হয়েছে। নারী জাগরণের প্রদীপ প্রজ্বলনের আগে সলতে পাকানোর কাজটি এই মহীয়সীরাই নেপথ্যে থেকে করে গিয়েছেন।
সময় বদলেছে, কিন্তু বদল হয়নি মানসিকতার। সরকারি নানা প্রকল্পকে ব্যর্থ প্রমাণ করে তাই ২০২২ সালের অনেক নাবালিকা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সন্তান কোলে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রে। ‘কন্যাদায়’ থেকে মুক্তি-পাওয়া স্বজনরা এক বারও জানতে চায়নি আদৌ কন্যাটি এই সময় সন্তান চেয়েছিল কি না? অতিমারির আতঙ্কিত দিনগুলিতে ঘরে বন্দি অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বহু মেয়েকে। অভিযোগ জানানোর সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত হয়েছে। আর ঘরের বাইরে তাদের জন্য ওত পেতে রয়েছে ভদ্রবেশী ধর্ষকের দল। চলচ্চিত্র থেকে সাংবাদিকতা, কর্মস্থল থেকে উর্দিধারী আইনরক্ষকের দফতর, সর্বত্র এই ‘বীরপুঙ্গব’-দের অবাধ বিচরণ। নারী তাদের কাছে শুধুই সম্ভোগের বস্তু। কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধে একুশ শতকেও সন্তান-সহ আত্মঘাতী হতে হয় অনেক গৃহবধূকে। তাই মিটিং, মিছিলে, সেমিনারে, আড্ডায়, সংসারে ‘নারী দিবস’ নিয়ে যতই আলোচনা হোক না কেন, মুক্তমনা নারীদের ব্যতিক্রমী ভাবনাচিন্তার ঝলক যতই আমরা উদ্যাপন করি না কেন, লিঙ্গবৈষম্যের অবসান না ঘটলে মেয়েদের প্রকৃত উদ্যাপনের দিন আসতে এখনও ঢের দেরি।
স্বাতী চট্টোপাধ্যায়, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
মেয়েদের দেশ
অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইতিহাসের উপেক্ষিতা’ (৯-৩) প্রসঙ্গে এই পত্রের অবতারণা। মেয়েদের উপর যৌন হিংসার ঘটনা কোনও বিশেষ একটি দেশের নয়, এ হল বিশ্বব্যাপী কাহিনি। লেখক স্বাধীনতা-পূর্ব এই বাংলার তমলুক থেকে শুরু করে পশ্চিমি দেশগুলোয়, চিনে, কোরিয়ার নারীদের উপর সংঘটিত নির্মম যৌন অত্যাচারের কাহিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন।
ঘরের পাশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া ঘৃণ্য ঘটনাগুলোর কথাই বা আমরা, যারা এ-পার বাংলার মানুষ, কতটা মনে রেখেছি? বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী নীলিমা ইব্রাহিম রচিত আমি বীরাঙ্গনা বলছি গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে এমন অত্যাচারিত নারীদের জীবনবৃত্তান্ত বিবৃত হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দমনমূলক পরিকল্পনামাফিক ২৫ মার্চ, ১৯৭১-এ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে তৎকালীন পাক সরকার। সেই রাতেই দেশ জুড়ে শুরু হয় প্রচণ্ড হারে নারীহরণ ও নারীধর্ষণ। তাঁদের তুলে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে চলে অমানুষিক যৌন অত্যাচার। পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক বীরাঙ্গনাদের উপর এই অকথ্য অত্যাচার নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারকেও হার মানিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর, এই কয়েক মাসে অনেক বন্দিনি উপর্যুপরি ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলেন। এমন কয়েক জন নারীকে নীলিমা দেবী খুঁজে বার করেছিলেন, কেউ কেউ দেশ ছেড়ে বিদেশে বেনামে জীবন কাটিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই নারীদের মতো নারীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “তোরা আমার মা, জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিস। তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা। আমি আছি, তোদের চিন্তা কী?”
যদিও তাঁর ওই অভয়বাণী বীরাঙ্গনাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। বীরাঙ্গনারা পরিবার, আত্মীয় পরিজন, সমাজ থেকে কোনও সহানুভূতি পাননি। ফলে কেউ আত্মহত্যা করেছেন, কেউ বা জনস্রোতে হারিয়ে গিয়েছেন, আবার কেউ প্রতিবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের বেঁচে থাকার পথ নির্মাণ করেছেন।
কেউ আবার স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে জেগে মনে করেছেন, শহিদরা প্রাণ দিয়েছেন এক বার, আর বীরাঙ্গনারা মান দিয়েছেন বার বার। কেউ বা বিলাপ করেছেন, পাকিস্তানিদের সঙ্গে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন। সমাজের কাছে অবমাননাজনক সম্বোধন শুনতে হয়েছে। এক নারী বলছেন, যে দিন তাঁর নারীত্ব লুণ্ঠিত হয়েছিল, সে দিনও তিনি এমন আঘাত পাননি, যে আঘাত পেয়েছেন বাংলাদেশের পতাকাকে পিছনে ফেলে ভারতে ঢুকতে। তাঁর না আছে পিছনে ফেলে আসা দেশ, না আছে সামনের দেশ। আমরা কি বাঙালি হয়ে বাঙালি মেয়ের সেই অসহনীয় যন্ত্রণাকে ভুলে থাকতে পারি?
সুদীপ দাশ, কলকাতা-৭০
নিষ্ঠুর প্রথা
‘পণ কেন নেব না, প্রশ্ন তুললেন বর’ (৯-৩) খবরটি পড়ে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। পণপ্রথা অত্যন্ত অমানবিক, গোটা সমাজের পক্ষেই তা অবমাননাকর। তা সত্ত্বেও এত দিন ধরে তা সমাজে জাঁকিয়ে বসে রয়েছে। ওই যুবক বলেছেন, “কে বলেছে এ দেশে পণপ্রথা নেই? সর্বত্র এটা চলে। কিছু ঘটনা সামনে আসে, কিছু আসে না।” সর্বত্র যে এটা চলে, এ কথা কার জানা নেই? সরকার, পুলিশ জানে, মন্ত্রীরা জানেন, পঞ্চায়েতের সদস্যরা জানেন। তবুও এই নিষ্ঠুর প্রথা চলছেই। নারী দিবসে এই ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হতেই এই যুবকের গ্রেফতারের দাবিতে সরব হয়েছেন নাগরিকদের একাংশ। কিন্তু তাতে কি সমস্যাটির গায়ে আঁচড়টুকুও কাটা যাবে? প্রশ্ন হল, এমন একটি নিষ্ঠুর অমানবিক প্রথা সভ্য সমাজে টিকে থাকতে পারছে কী করে? সরকারের সমাজকল্যাণ দফতর, নারী কল্যাণ দফতর রয়েছে, পুলিশ রয়েছে, তাঁদের পিছনে বাজেটে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকাটি কী? পণপ্রথার বিরুদ্ধে আইন কার্যকর হয় না কেন? কেন পণপ্রথার বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার করা হয় না, কেন এটিকে একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ দেওয়া হয় না?
পরাধীন দেশে বিদেশি শাসকরা সমাজ সংস্কারের কোনও দায়িত্ব অনুভব করেননি। দেশের মনীষীরা, সমাজ সংস্কারকরা আন্দোলন গড়ে তুলে সমাজ সংস্কারের, নারী অধিকারের বেশ কিছু দাবি আদায় করেন। অপূর্ণ দাবিগুলি পূরণ করার কাজটি তো স্বাধীন ভারতের নেতাদেরই ছিল। কিন্তু তাঁরাও সেগুলিকে অবহেলা করলেন। তাই গোপনীয়তা ছাড়াই পণপ্রথা রমরমিয়ে চলছে। পণ দিতে না পারলে, পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে না পারলে, গায়ের রং কালো হলে আজও অত্যাচারিত হন, খুন হন কত মহিলা! সরকার নির্বিকার। দেশে কত মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হলেন, কিন্তু অবস্থা বদলাল কই! মহিলা বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রীরা তো বিধানসভায়, লোকসভায় পণপ্রথা-নারী নির্যাতন বন্ধের দাবিতে ঝড় তোলেন না?
সমর মিত্র, কলকাতা-১৩
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy