জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় ‘অতীত আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা’ (১০-৫) নিবন্ধে বলেছেন, বাম ও কংগ্রেসের প্রচার শুধুমাত্র মমতা-বিরোধিতায় আটকে থাকার কারণেই বিধানসভা নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হয়েছে। অস্বাভাবিক লাগে যখন দেখি, বাংলার মতো রাজ্যে একটা নির্বাচন আবর্তিত হয় সাম্প্রদায়িক এবং ভাষাগত মেরুকরণকে ঘিরে। চাপা পড়ে যায় দুর্নীতি, শিল্পহীনতা, বেকারত্ব, অতিমারি পরিস্থিতিতে গরিব ও পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক খাতের টাকা আত্মসাৎ, কাটমানি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, আমানতে সুদ হ্রাসের মতো মানুষের দৈনন্দিন বিভিন্ন সমস্যা। এখানে আবার কোনও রাজনৈতিক দলের জনসেবাকে তুলনা করা হয়েছে দাতব্য প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে, যা শুনে মনে হয় রাজনৈতিক দলের শুধুমাত্র ভোটে জেতার সমীকরণ দেখাটাই প্রধান কাজ, জনসেবা সেখানে ব্রাত্য। অনৈতিক মনে হয়, যখন ভোটের অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমের ভোট-সমীক্ষা চিহ্নিত করে দেয়, কোন দুটো দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে নির্বাচনী লড়াই, যা বহুলাংশে প্রভাবিত করে ভোটারদের। নির্বাচনের আগে ইভিএম নিয়ে বিরোধিতা ভোটে জেতার পর আশ্চর্য রকমের নীরবতা এনে দেয়। আর বাংলার এই নির্বাচনে বিজেপি যেমন রামধাক্কা খেয়েছে, এই ধাক্কা অন্য কয়েকটি রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে অব্যাহত থাকলে, ভবিষ্যৎদ্রষ্টার আর প্রয়োজন নেই, কালের আবর্তে এই রাজ্যে বাম এমনিই ফিরে আসবে, খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার রক্ষার স্বার্থে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
পরে বাম?
‘অতীত আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা’ নিবন্ধটি একটি বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ। লেখক বলেছেন, এ বারের ভোটে বিজেপিকে রুখে দেওয়াটা যত বড় স্বস্তির, বিরোধী রাজনীতির একচেটিয়া আসন তৃণমূলের ঝুলিতে যাওয়াটা বাম-কংগ্রেস জোটের কাছে ততটাই অস্বস্তির। শুধু অস্বস্তিরও নয়, উদ্বেগের, দুশ্চিন্তার। ‘আগে রাম, পরে বাম’, এই যাঁদের রাজনৈতিক ভাবনা, তাঁরা যে কোনও মূল্যে মমতাকে বিদায় জানাতে চান। নির্বাচনী জনসমাবেশে তাঁদের ভাষণে বিজেপির বিরোধিতা আলগোছে বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়ার মতো তো হবেই। তা ছাড়া নতুন কণ্ঠ মীনাক্ষী-দীপ্সিতা-ঐশী-সৃজনদের বক্তব্যের উপজীব্য নিয়ে কাটাছেঁড়া না-হওয়াটাই সঙ্গত। কারণ, প্রথমত নেট-দুনিয়ার মন্তব্যগুলি সাধারণ ভাবে তাৎক্ষণিক ও আবেগসর্বস্ব। এঁদের বাস্তব পরিস্থিতি ও মৌলিক ভাবনার অভাব প্রকট। দ্বিতীয়ত, প্রশ্ন ওঠা অসঙ্গত নয় যে, জনসমাবেশে মীনাক্ষী-দীপ্সিতারা আদৌ কি স্বাধীন মতামত তুলে ধরতে পেরেছেন? না কি আলিমুদ্দিনের কর্তাদের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি হয়েছে নতুন মুখ দিয়ে?
প্রাবন্ধিকের জিজ্ঞাসা, ‘আগে রাম’ তো হল, ‘পরে বাম’-এর কী ব্যবস্থা হবে? প্রশ্ন হল, এই বঙ্গে প্রকৃত বামপন্থী দল বলে কিছু আছে কি? বিভ্রান্তিকর, ভিন্ন ভিন্ন মত নিয়ে প্রায় ১৫-১৬টি বাম-উপদলের জীবনভর বিচ্ছিন্ন থেকে যাওয়ার কারণ কী? সর্বহারাদের ‘সৃষ্টিশীলতা’, ‘সাম্যবাদ’ এই শব্দগুলো এখনও কী ভাবে যে আওড়ান ওঁরা!
এ বারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালেও ভিতরে ভিতরে ‘ছাব্বিশে বাম’-এর যে স্বপ্নজাল ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অদূরদর্শী বাম-নেতৃত্ব, এবং প্রশ্নহীন আনুগত্য স্বীকার করা ক্যাডার বাহিনী, তাঁদের এই অলীক স্বপ্ন সযত্নে শিকেয় তুলে রাখা ছাড়া উপায় নেই। কারণ এখনও বাম-নেতৃত্ব আত্মসমীক্ষার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়াতে রাজি নন। ইতিমধ্যেই তাঁরা দলের দুর্বলতা ও হঠকারী সিদ্ধান্তগুলো আড়াল করে, মমতাকে তীব্র কটাক্ষ-সহ অন্য সব কারণের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ শুরু করেছেন। এই লজ্জাজনক অবস্থান চলতে থাকলে বাম দলগুলোর ফসিল-এ রূপান্তরিত হতে সময় লাগবে না!
সবুজ সান্যাল, ধাড়সা, হাওড়া
ভোটমুখী
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবন্ধ বামেদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো। দু’একটা কথা এখানে জুড়তে চাই। এই তথাকথিত বামেদের একমাত্র লক্ষ্য হল লোকসভা বা বিধানসভার ঠান্ডা ঘর। বছর দুয়েক আগে ব্রিগেডের এক সভায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গিয়েছিলেন, কিন্তু গাড়ি থেকে নামতে পারেননি। সেখানে ভিড় দেখে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, এই ভিড়কে ভোটের বাক্সে নিয়ে যেতে হবে। একটি বামপন্থী দলের এই হল নেতৃত্বের মানসিকতা, যেন তেন প্রকারেণ ঠান্ডা খোঁয়াড়ে (এক সময়ে সংসদকে ওঁরা ‘খোঁয়াড়’ বলতেন) ঢোকা। চৌত্রিশ বছরে গণআন্দোলনে অনভ্যস্ত একটি বামপন্থী দল ২০১১’র পরবর্তী সময়ে দিশাহারা। অন্য রাজনৈতিক দলের থেকে তাদের অবস্থান ভিন্ন বলে দাবি করা হয়। গত ছ’বছরে, বিশেষ করে নোটবন্দি-পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রের শাসক দল জনস্বার্থ-বিরোধী অজস্র কাজকর্ম করেছে— প্রতিবাদীদের কণ্ঠরোধ, ইউএপিএ প্রয়োগ করে প্রতিবাদী সাংবাদিকদের জেলবন্দি করা। বামপন্থীদের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার এই তো উপযুক্ত সময়। কিন্তু বাস্তবে সীতারাম ইয়েচুরিদের নিয়মমাফিক প্রেস বিবৃতি ছাড়া কী পেলাম? এই পটভূমিকায় বাংলার নির্বাচন। এ বার আমরা পেলাম একটা অরাজনৈতিক মঞ্চ, যেখানে বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার অনুরোধ জানানো হল। বিজেপি-শাসিত রাজ্যের নানা উদাহরণ টেনে বলা হল, বিজেপি ক্ষমতায় এলে তা বাংলার পক্ষে সুখের হবে না। প্রমাদ গুনল বামেরা। বলা হল, বকলমে এরা তৃণমূলকে ভোট দিতে বলছে। বাম নেতাদের অদূরদর্শিতার ফলে, তাঁদের কাটা রাজনৈতিক খাল বেয়ে বাড়ল বিজেপির আসন, ৩ থেকে ৭৭।
শেষে, নিবন্ধের সঙ্গের ছবিটি সম্বন্ধে একটি কথা। ব্রিগেডের মঞ্চে দেখলাম বামপন্থায় পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য, যারা লক্ষণীয় ভাবে সবাই ‘উঁচু’ জাতের। আর পিছনের চেয়ারে আড়ালে রয়ে গেলেন মহিলা কমরেড দেবলীনা হেমব্রম। জেএনইউ-এর লড়াকু কমরেড ঐশী ঘোষরা ব্যস্ত রইলেন স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্ব পালনে।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১৫৬
সত্য সে কঠিন
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সহমত। বিহার বিধানসভা নির্বাচনে ভাল ফল করার পর সিপিআই (এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনেও মূল প্রতিপক্ষ বিজেপি হওয়া উচিত। তিনি ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ক্যাম্পনেরও হোতা ছিলেন। কিন্তু এখানকার নেতৃত্ব বিজেপি ও তৃণমূল থেকে সমদূরত্ব নীতি গ্রহণ করলেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর অত্যাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বামেদের ভোটের একটা অংশ বিজেপিতে চলে যায়। বামফ্রন্টের দুর্বল সংগঠনের উপর তাঁরা ভরসা করতে পারেননি। এ কথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নীলোৎপল বসু স্বীকার করে নেন। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন এ বার সে ভোট বামে ফিরবে। লেখকের সঙ্গে আমি একমত যে, সমদূরত্বের কথা বললেও মূলত তৃণমূল কংগ্রেসকে হারানোর জন্যই বামফ্রন্ট নেতৃত্ব আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট করেছিলেন, যা তাঁদের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত যে হেতু অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাই ভোটের ফলের পরে তন্ময় ভট্টাচার্য বা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষোভ খুবই সঙ্গত।
যে ছাত্র-যুবরা অতিমারি পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন, সমাজমাধ্যমে তাঁদের এক অংশের অভিমান লক্ষ করা যাচ্ছে। যে ভাবে রেড ভলান্টিয়াররা অক্সিজেন, ওষুধ ইত্যাদি নিয়ে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছেন, মানুষের আশীর্বাদ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হবেন না। বামপন্থীদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। তাঁরা অসীম সম্ভাবনার আধার।
শিখা সেনগুপ্ত,কলকাতা-৫১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy