নির্বাচন ঘিরে সন্ত্রাস। —ফাইল চিত্র।
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল ভোটাধিকার এবং স্বাধীন মতপ্রকাশ। কিন্তু ভোটাধিকার প্রয়োগ যদি শেষ পর্যন্ত তামাশা হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে আর গণতন্ত্রের থাকে কী! বিশেষ করে পঞ্চায়েত, পুরসভা ও সমবায় সংস্থার নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যন্ত চলে লাগামহীন সন্ত্রাস। এমনকি ভোটের পরেও সে সন্ত্রাসের অবসান হয় না। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, পুলিশ-প্রশাসনকে কব্জা করে ভিন্ন মত বা দলকে আটকাতে সব রকম অগণতান্ত্রিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে। তাই আমাদের রাজ্যে সন্ত্রাস, রক্তপাত আর মৃত্যু নির্বাচনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। এখন আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে, বিশেষ করে দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমের দৌলতে ‘গণতন্ত্র নিধনের মহোৎসব’ ঘরে বসে প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। নির্বাচন কমিশনের আশ্বাস, কোর্টের কড়া নির্দেশ, এ সব উপেক্ষা করে গণতন্ত্রের হত্যালীলা চলতেই থাকে। ভোটে সন্ত্রাস, বেনিয়ম এ সব নিয়ে কিছু দিন আলোচনা, তর্কবিতর্ক, এক সময় তা থিতিয়ে যায়। ভোট ‘লুট’ করে জেতা প্রার্থীরাও ‘নির্বাচিত’ শংসাপত্র নিয়ে দিব্যি কোনও না কোনও পদ আলো করে বসে পড়েন। সব দেখে-শুনেও নির্বাচন কমিশন বা আদালতকে আর তেমন রা-কাড়তে দেখা যায় না। এ ভাবেই চলছে আমাদের গণতন্ত্র এবং চলবেও।
আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ দরকার। নির্বাচন কমিশন যে রাজনৈতিক দলকে স্বীকৃতি দেয়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার বা দায়ও তার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কাজ করার জন্য যে দল স্বীকৃতি এবং প্রতীক পেয়েছে, সেই দলই যদি বারে বারে গণতন্ত্রের পরিপন্থী কাজ করে চলে, মানুষের অবাধ ভোটাধিকারে বাধা সৃষ্টি করে, কমিশনের উচিত সেই দলকে তথা দলের নেতৃত্বকে সতর্ক করা। একাধিক বার সতর্কবার্তার পরেও না শোধরালে সেই দলের স্বীকৃতি বাতিল করে নির্বাচনে যোগদানের অধিকার কেড়ে নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। এ রকম কিছু কড়া দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা না করলে নির্বাচন তথা গণতন্ত্রের নামে প্রহসন চলতেই থাকবে।
তারাপদ যশসরঙ্গা, পূর্ব বর্ধমান
লাঠি কেন?
মনোনয়ন দাখিলের তৃতীয় দিনে পূর্ব বর্ধমানের বড়শুলির মনোনয়ন জমা দেওয়ার ছবি টিভির পর্দায় দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, লাঠি হাতে পুলিশ ও বিভিন্ন দলের ক্যাডারদের এমন সহাবস্থান কি দিনে দিনে নিয়মসিদ্ধ হয়ে উঠছে? লাঠি হাতে একই ছবি মিনাখাঁ থেকে সোনামুখী, রানিনগর, কাকদ্বীপ— সব জায়গায়। দলীয় পতাকা আনতে হলে বাঁশের কঞ্চি কেটে, বা সরু বাখারি কেটে তাতে পতাকা লাগানো থাকলে মানুষ হঠাৎ ক্ষিপ্ত হলেও তেমন ক্ষতি কারও হবে না। কিন্তু যে সব বাঁশ বা মোটা লাঠিতে পতাকা আটকে দলীয় উৎসাহীরা মিছিল করেন, তাতে উত্তেজনার পরিস্থিতিতে পরস্পরের মাথা ফাটতে পারে, প্রাণ সংশয়ও হতে পারে। পুলিশও যে আহত বা আক্রান্ত হবে না, সে গ্যারান্টি কোথায়!
অশান্তি রুখতে ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। মনোনয়ন জমা দেওয়া কেন্দ্রের এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধে নিষিদ্ধ করতে হবে জমায়েত। তার বাইরে লাঠিসোঁটা নিয়ে দলীয় কর্মীরা টহল দিয়ে বেড়ালে কি আদৌ আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকবে এলাকায়! এ কেমন গণতন্ত্র! এ সব দেখলে ভোট প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস হারাবে না তো!
সৌম্যেন্দ্রনাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
হিংসার বীজ
‘আতঙ্কের কাল’ (১৪-৬) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে কিছু কথা। পঞ্চায়েত নির্বাচনে রক্ত ঝরার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে নতুন নয়। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের রক্তাক্ত স্মৃতি আজও মুছে যায়নি। উন্নয়নের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ কত এগিয়ে, তা নিয়ে অনেক প্রচার চলে। তবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গ যে হিংস্র তাণ্ডবে অনেকটাই এগিয়ে, তাতে আর কোনও সন্দেহই নেই। এ বারও মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার অধ্যায় শুরু হতেই দেখা গেল সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করে প্রকট হল সেই অমোঘ বাণী— জোর যার, মুলুক তার। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে রক্তক্ষয়ী হিংস্র সংঘর্ষের ধারা তৈরির ঘটনা আজকের নয়। বহু দিন আগেই এর বীজ বপন হয়েছে এ রাজ্যের রাজনীতিতে। আর কত বিভীষিকার ছবি দেখতে হবে?
১৯৯৩ সালের ২৪ এপ্রিল পঞ্চায়েতি রাজ এ দেশে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। তার পর থেকে কত মানুষই না সংঘর্ষে জড়িয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন! কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও দলই তা বন্ধের জন্য সে ভাবে উদ্যোগী হয়নি। তিন দশক পূর্ণ হওয়ার পরেও ছবিটা এক। সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি ভোটদাতা ৩৩১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ৩৪১টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ২০টি জেলা পরিষদে এ বছর প্রতিনিধিদের নির্বাচন করবেন। নিঃসন্দেহে এ গণতন্ত্রের এক বড় উৎসব। কিন্তু এই উৎসবে কেন এত রক্ত ঝরবে?
ইতিমধ্যেই তৃণমূলের রাজ্য শাসনের এক যুগ অতিক্রান্ত। সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনী হিংস্রতায় যে প্রথম, এমন কথা বিরোধীরা বলছেন। শাসক দল না মানলেও মনোনয়ন-পর্বের হিংসা ও প্রাণক্ষয় কিছুতেই মুছে যাবে না। আমাদের রাজ্যের এ এক বড় কলঙ্ক, যা শাসক দলের কাছে লজ্জারও বটে। যাঁদের হাতে এ রাজ্যের জনগণ শাসনভার তুলে দিয়েছেন, এ কলঙ্ক মোচন আজ তাঁদেরই করতে হবে। আগামী ৮ জুলাই নির্বাচন সুসম্পন্ন করে পশ্চিমবঙ্গ যেন সগৌরবে বলতে পারে, এ বারের গণতন্ত্রের উৎসবের দিনটি বিনা রক্তপাতেই আমরা সমাপ্ত করতে পেরেছি।
প্রদ্যুৎ সিংহ, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
দায় কমিশনের
শুধু পঞ্চায়েত নির্বাচন নয়, লোকসভা, বিধানসভা এমনকি সমবায় সমিতি, স্কুল, কলেজ নির্বাচনেও এ রাজ্যে ঘটে যায় ধুন্ধুমার কাণ্ড। তবে সকল নির্বাচনী হিংসাকে ছাপিয়ে যায় পঞ্চায়েত নির্বাচন। ২০১৮ এবং ২০২৩ সালের নির্বাচনে সেটা বেশি করে প্রকট। পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন শুরু থেকে গণনার দিন বিভিন্ন রকম হিংসা, কারচুপি, জবরদখলের অভিযোগ ওঠে, এবং সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে অনেক অনৈতিক ঘটনা সাধারণ জনগণ চাক্ষুষ করেন। আঁটসাঁট নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করে তবেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত ছিল। কিন্তু স্বশাসিত সাংবিধানিক সংস্থা হয়েও রাজ্য নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সাল থেকে যে ভাবে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের উপর অতি-নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, তাতে সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ পঞ্চায়েত নির্বাচন যে আদৌ সম্ভব নয়, বলার জন্য বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয় না। ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্ত এবং কাজের মধ্যে দলীয় সুবিধার দিকটি প্রতিফলিত হওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু রাজ্য নির্বাচন কমিশন যদি নিরপেক্ষ ও দৃঢ় মতামত জানাতে অপারগ হয়, এবং নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে না পারে, তা হলে তা যথাযথ নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ। নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য যখন বিরোধীরা বারে বারে দাবি জানিয়েছেন, তখন নির্বাচন কমিশনার— রাজ্য পুলিশের বিপুল ঘাটতি সত্ত্বেও পুলিশের উপর আস্থা আছে বলে জানিয়েছেন। এমনকি রাজ্যের প্রস্তাবে সিলমোহর দিয়ে এক দিনে সারা রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণা করতে এতটুকু দ্বিমত পোষণ করেননি। নিরাপত্তার দাবিতে আদালতে যেতে হচ্ছে বিরোধীদের। আদালত নির্দেশ দিচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে। এ বড় লজ্জার। রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে চরম অশান্তি, হিংসা, মারামারি, প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতির জন্য সবার আগে তাই আঙুল উঠবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দিকে। ২০১৩ সালে কমিশন যে সততা, নিষ্ঠা, নিরপেক্ষতা দেখাতে সচেষ্ট হয়েছিল, পরের দু’টি নির্বাচনে সেই প্রচেষ্টা উধাও।
প্রদ্যোৎ পালুই, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy