শেখর ভৌমিকের ‘একের পর এক মৃত্যুর ঢেউ, তবু হুঁশ ফেরে না’ (রবিবাসরীয়, ১৬-৫) পড়ে মনে হচ্ছে, ইতিহাস আমরা শিখি না, তবে ইতিহাস আমাদের শেখায়। মহামারি অতীতের মতোই এখনও পারিবারিক সম্পর্ককে ভেঙে ছিন্নভিন্ন করছে। পরিবারের সদস্যরা কোভিডে প্রিয়জনদের মৃত্যুর পর তাঁদের ত্যাগ করছেন সংক্রমণের ভয়ে। খবরে প্রকাশ, বিহারের সিওয়ান জেলার এক বিচারক ৭০ বছর বয়সি পিতার শেষকৃত্য করতে অস্বীকার করেছেন। গয়া জেলায় এক পরিবার তাদের ছোট ছেলের মৃতদেহ পরিত্যাগ করেছে। এ যেন শেখরবাবুর লেখা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
১৩৪৮ সাল। ইটালীয় লেখক জিয়োভান্নি বোকাচ্চিয়ো ফ্লোরেন্সে বাস করছেন। ১৩৪৭-এ শুরু হওয়া প্লেগ মহামারির কবলে ইটালির জনজীবন তখন জেরবার। বোকাচ্চিয়ো সেই অবস্থা বর্ণনা করলেন তাঁর দ্য ডেকামেরন-এ। এমন এক সমাজ, যেখানে মানুষ মূল্যবোধ হারিয়েছে। পরিবারে একে অপরকে পরিত্যাগ করছে। বোকাচ্চিয়ো বলছেন, প্লেগ বাচ্চাদের পিতামাতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছিল। প্লেগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে অনেক চিকিৎসক রোগীদের চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেছিলেন, যাজকরা মৃতদেহের শেষকৃত্য করতে নারাজ হয়েছিলেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, অসুস্থদের একা রেখে দেওয়া হয়েছিল তিলে তিলে মৃত্যুবরণের জন্য। কোনও লোক যখন তাঁর বাড়িতে মারা যেতেন, মৃতদেহের গন্ধ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ সে দিকে নজর দিতেন না। বেঁচে থাকা মানুষরা লাশ সংগ্রহ করে রাস্তার ধারে গাদা করে রেখে দিতেন। কবরস্থানে জায়গা না থাকায় বিশালাকার পরিখা খনন করে তাতে শত শত লাশের কবর দেওয়া হত। কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত ভারতও দেখেছে গণ-চিতার আয়োজন; দেখেছে গঙ্গা-যমুনার জলে মৃতদেহ ভাসতে।
নটরাজ মালাকার
আন্দুলবেড়িয়া, মুর্শিদাবাদ
এত অপচয়
করোনা অতিমারিতে এখনও দৈনিক প্রায় তিন লক্ষ থেকে সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। মারা যাচ্ছেন প্রায় চার হাজার মানুষ! এটি সরকারি হিসাব। আমরা দেখছি অনির্বাণ চিতা জ্বলছে, শ্মশানে ঠাঁই নেই, গোরস্থানেও নেই! শবদেহ ভাসছে গঙ্গার জলে। দাহ করার কাঠের জোগাড় করতে পারছেন না সাধারণ মানুষ! এ নিয়ে উত্তরপ্রদেশ ও বিহার সরকার নির্লজ্জ ভাবে পরস্পরের উপর দোষারোপ করছে! রাজধানী দিল্লির বুকে মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি করছে কুকুর। সর্বত্র শুধু নেই-নেই— যথেষ্ট হাসপাতাল নেই, বেড নেই, অক্সিজেন নেই, ভেন্টিলেটর-সহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি নেই, টিকা নেই, ওষুধ নেই। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক অ্যাম্বুল্যান্স বা শববাহী গাড়ি! যথেষ্ট ডাক্তার, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীও নেই। এই ‘নেই রাজ্যে’ কেবল নেতা-মন্ত্রীদের বড় বড় ভাষণ আছে, বিলাসব্যসন আছে, ভাল ভাল বিবৃতি আছে।
অথচ, এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। সরকার পুরো একটা বছর সময় পেয়েছিল, যখন দরকার ছিল করোনা মোকাবিলার জন্য দেশ জুড়ে প্রস্তুতির। আজ যে হাহাকার শুনতে পাচ্ছি, সেটা আমাদের শুনতে হত না, যদি সরকার ঠিক সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ করত। অথচ, তার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের জন্য দেশের মানুষকে থালা, কাঁসর-ঘণ্টা বাজাতে বলেছেন, কখনও প্রদীপ জ্বালাতে বলেছেন। এর দ্বারা বিজ্ঞানের পরিবর্তে পুষ্ট হয়েছে কুসংস্কার।
গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ইউরোপ এবং আমেরিকা। তারা এর থেকে শিক্ষা নিয়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে মোকাবিলা করার জন্য এক দিকে যেমন ভেন্টিলেটর-সহ অন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী, অক্সিজেন ও ওষুধ উৎপাদন বাড়ানোর এবং প্রয়োজনে জোগাড় করার উদ্যোগ করেছিল; সেই সঙ্গে টিকা পাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিল। টিকা উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোকে আগাম অর্থ দিয়ে টিকা পাওয়া নিশ্চিত করেছিল। সেখানে ভারত সরকার বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও শুধুমাত্র দু’টি দেশি সংস্থার উপর নির্ভর করেছে। যার ফলে আজ দেশে টিকার চূড়ান্ত অভাব।
কেন্দ্রীয় সরকার আজ আর্থিক সঙ্কটের ধুয়ো তুলে অক্সিজেন, জীবনদায়ী ওষুধ-সহ করোনা মোকাবিলার সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উপর জিএসটি বহাল রেখেছে। সেই সঙ্গে কেন্দ্র টিকা সরবরাহের দায়িত্ব অস্বীকার করে রাজ্য সরকারগুলিকে ও দেশের মানুষকে বেশি দামে টিকা কিনতে বাধ্য করছে। এবং তা নিয়েও চলছে রাজ্যভিত্তিক পক্ষপাতিত্ব।
অন্য দিকে, দেশের মানুষ বিস্মিত হয়ে লক্ষ করছেন যে, প্রধানমন্ত্রী নির্লজ্জ ভাবে তাঁর এবং উপরাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন, নতুন সংসদ ভবন ও কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট, যার পোশাকি নাম ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’, তার নির্মাণের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। যেখানে সরকারের উচিত ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে করোনা অতিমারির মোকাবিলা করা, তার পরিবর্তে লকডাউনের মধ্যেও এই নির্মাণের কাজকে ‘অত্যাবশ্যক’ আখ্যা দিয়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ২৪ ঘণ্টা কাজ করানো হচ্ছে অগণিত কর্মীকে। যার ফলে বাড়ছে অতিমারি বিধ্বস্ত দিল্লিতে সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা।
গত বছর অতিমারির সময়ে হাজার হাজার কোটি বাড়তি টাকা খরচ করে কেনা হয়েছে বিতর্কিত ‘রাফাল’ বিমান; এমনকি এই সঙ্কটের মধ্যেও কেনা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মতো গণ্যমান্য ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্য দু’টি অত্যন্ত বিলাসবহুল বিমান (৮৫০ কোটি), যে দামে অনায়াসে তৈরি করা যেত তিনটি এমস-এর মতো অত্যাধুনিক হাসপাতাল। এই ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার কোষাগারের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় করছে দেশের এই গভীর বিপর্যয়ের সময়।
তাপস বেরা
আন্দুল মৌড়ি, হাওড়া
ভাষার জন্য
ষাট বছর আগের এই দিন, ১৯ মে, রাষ্ট্রের বুলেটে প্রাণ হারিয়েছিলেন অসমের ১১ জন বাঙালি। তাঁদের অপরাধ ছিল, মাতৃভাষা বাংলাভাষার সম্মান আদায় করতে তাঁরা পথে নেমেছিলেন, আন্দোলন, সত্যাগ্রহ করেছিলেন অহিংস পথে। এই ঘটনার প্রেক্ষাপট অসমের ‘বঙ্গালখেদা’, যা শুরু হয়েছিল দেশ স্বাধীন হতেই। এর জেরে অসম সরকার অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিলে বাঙালিরা অনুভব করেন, তাঁরা যেন নিজভূমে পরবাসী! আন্দোলনের পথে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব পরিকল্পনা মতো ১৯৬১-র ১৯ মে বরাক উপত্যকা জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। চাষি-জেলে-তাঁতি, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল, পিকেটিং আটকাতে সক্রিয় হয় পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী। লাঠিচার্জ বা কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়েও বিক্ষোভকারীদের হটাতে পারে না। দুপুর আড়াইটে নাগাদ শিলচর রেল স্টেশনে বিক্ষোভকারীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে হঠাৎই পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লেন কমলা ভট্টাচার্য, তরণী দেবনাথ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, শচীন্দ্র পাল, সুনীল সরকার, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদরঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্র দেব এবং কানাইলাল নিয়োগী। রক্তনদী বয়ে গেল স্টেশন চত্বর জুড়ে।
এই ঘটনার প্রায় এক দশক আগে ঢাকা শহরে ঘটে গিয়েছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’— ভাষাশহিদ দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁদের এই অভূতপূর্ব মরণগাথা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। অথচ, অসমে বাংলা ভাষার জন্য শহিদ হলেন যে ১১ সৈনিক, তাঁদের নামটুকুও মনে রাখিনি আমরা। অসমে বাঙালির বিপন্নতা বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং রাষ্ট্রের ‘ডবল ইঞ্জিন’-এর চাপে সেই রাজ্যের বাঙালি নতুন করে অস্তিত্বহীনতার মুখে দাঁড়িয়ে। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আত্মশক্তির প্রেরণা নিতে হবে ‘উনিশে মে’-র দামাল ভাইবোনদের কাছ থেকে।
শুভাশিস চক্রবর্তী
অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy