শুভময় মৈত্রের ‘কার কতখানি লাভ’ (২৯-১০) প্রবন্ধটি চিত্তাকর্ষক মানসভ্রমণ। প্রবন্ধকার মহাকাশ পরিক্রমণ করে এলেন অথচ মূল প্রকোষ্ঠে প্রবেশের প্রচেষ্টা থেকে বিরত থেকে গেলেন।
জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন যে ভাবে নাগরিক আন্দোলন হয়ে গিয়েছিল, তা অরাজনৈতিক ছিল না, তবে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে ছিল। দলীয় রাজনীতি তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে, এও ঠিক। এ রাজ্যে বর্তমান ভোট রাজনীতি, অস্তিত্বের সমীকরণে চতুর্ধা বিভক্ত। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার সময় এ অবস্থা ছিল না। বিজেপি-কে এ বঙ্গে প্রাসঙ্গিক এবং শক্তিশালী করেছে তৃণমূল: মেরুকরণ রাজনীতির দাক্ষিণ্যে বিজেপি এখন প্রধান বিরোধী দল। শাসক দলের সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে হিন্দুত্বই একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ানোর পিছনে বাম শাসনের শেষ দশকের লাগামছাড়া গা-জোয়ারি, গোঁয়ারতুমি আর গুন্ডাগিরির কথাও ভুললে চলবে না। হাল ফেরাবে লাল, এমন স্বপ্ন এই দুঃসময়েও বেশি লোক ভাবতে পারছেন না।
এই গণআন্দোলন মানুষের ভিতরে জমা পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আর জি কর কাণ্ড তাতে অগ্নিসংযোগের কাজটা করেছে মাত্র। তবে লেখক ঠিক বলেছেন, তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্ক ভাঙার চোখে পড়ার মতো কোনও লক্ষণ এখনও দেখা যায়নি, যা মূলত গ্রামকেন্দ্রিক।
অযাচিত সুযোগ পেয়ে, সিপিএম সচেতন ভাবেই দূরত্ব বজায় রেখে সমর্থন দিয়ে গেছে এই গণআন্দোলনে। হেভিওয়েট নেতারা সরাসরি আন্দোলনে উপস্থিত থাকেননি, অথচ অনেক সিপিএম সমর্থককে আন্দোলনের মঞ্চে, মিছিলে, অনশন মঞ্চে শামিল হতে দেখা গিয়েছে। ভোটবাজারে অতিবাম কোনও দিনই হালে পানি পায় না, ভোটকাটুয়া হিসাবেই স্থান পায় মাত্র।
তবে প্রবন্ধকারের সঙ্গে একমত যে, এই আন্দোলন সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে এক ঝলক টাটকা বাতাস বয়ে নিয়ে এসেছে। এই ঘোর অমানিশা কাটতে পারে, এমন আশাবাদী মানুষের সংখ্যা, থুড়ি, ভোটারের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
প্রদীপ কুমার সিংহ, কলকাতা-৮২
রাজনীতির রং
‘কার কতখানি লাভ’ প্রবন্ধে মোক্ষম কথাটি শেষ অনুচ্ছেদে। জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলনে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তাদের শিরদাঁড়াটা সোজা রাখার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। এমনিতেই তো তারা মেনে নেওয়া এবং মানিয়ে নেওয়ার রাজনীতিতে ন্যুব্জ। কিন্তু, জুনিয়র ডাক্তারদের মুখ্যমন্ত্রীর সামনে ঋজু বক্তব্য রাখা, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের বলতে না দিলেও সেটি সংবাদমাধ্যমের সামনে বলা, অভিযুক্তকে অভিযুক্ত বলাই যে শ্রেয় তা জানিয়ে দেওয়া— এই ঘটনাগুলি তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছে। মুখ্যমন্ত্রী আমলাদের বৃত্তে সভাটি করলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর মুখের উপর কথা শোনালেন সাধারণ মানুষ’— এ সবে চতুর্দিকে ‘আধিপত্যবাদ’-এর রাজত্বে মধ্যবিত্ত শ্রেণি একটু যেন আলোর সন্ধান পেল।
এই আন্দোলনের প্রতিটি পর্বে আমরা দেখেছি, রাজনীতি তার স্বভাববশে ডালপালা বিস্তার করেছে। টিভিতে চ্যানেলের সান্ধ্য বিতর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হাজির থেকেছেন আমন্ত্রিত বক্তা হিসাবে। স্বাভাবিক ভাবেই নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এক হাত নিয়েছেন। সেই প্রতিপক্ষই বা ছেড়ে কথা বলবেন কেন? আর জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি বা অতিথি সিনিয়র ডাক্তারও বিতর্কের ধরাবাঁধা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কখন যে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ ছুঁয়ে যান, তা হয়তো তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না। কারণ, প্রতিটি বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ একটি রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। সেটি কখনও সিপিএম, কখনও বিজেপি, কখনও তৃণমূল বা কংগ্রেসের ধারাবাহী। নির্দিষ্ট একটি দলের সমর্থক কেউ না-ও হতে পারেন। কিন্তু, তাঁর মতাদর্শে রাজনৈতিক রং লেগে যায়।
যে বিপুল জনতা আন্তরিক ভাবে তাঁদের আন্দোলনে এবং অনশন মঞ্চের সামনে নিরন্তর থেকেছিলেন, তাঁরাও কি রাজনীতির ঊর্ধ্বে? সবাই কি আবেগের বশে ডাক্তারবাবুদের পাশে থেকেছিলেন? যদিও বাম বা কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। তাদের জোটও পশ্চিমবঙ্গে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করে না। কিন্তু বাম-সমর্থকেরা কোনও দোলাচলে ভোগেন না। তাঁদের সমর্থকদের ভোট, ‘বামের ভোট রামে’ গেলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বিজেপি, চারশো পারের স্বপ্ন অধরাই।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচি, কলকাতা-১২৫
মারণ রোগ
‘সিলিকোসিস’ এক মারণ অসুখ। দীর্ঘ দিন বালি বা পাথর খাদানে কাজ করলে এই অসুখ দেখা যায়। এই অসুখের নেই কোনও সুনির্দিষ্ট ওষুধ। নেই কোনও ভাল চিকিৎসাও। এই মুহূর্তে গোটা দেশে অসংখ্য শ্রমিক এই মারণ অসুখে আক্রান্ত। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সিলিকোসিস আক্রান্ত রোগীর গড় আয়ু খুব কম। অথচ, অসুখটা যে-হেতু মূলত গরিবের, তাই হয়তো আলোচনা কম। পেটের টানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পাথর-বালির খাদান, কয়লা খনি, কাচ বা সেরামিক কারখানা, রাস্তা তৈরির কাজ ও মার্বেল কাটার কারখানায় কাজ করেন। এই কাজ করতে গিয়ে শ্বাসের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ধূলিকণা শরীরে ঢোকে এবং তা জমা হয় ফুসফুসে। তার পর দেখা দেয় কাশি। এই ধরনের জটিল কাজে শ্রমিকদের মুখে মাস্ক ও আলাদা পোশাক পরা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে দেখা দেয় তার উল্টো। মালিক, ঠিকাদার থেকে শ্রমিক— কেউই এই বিষয়ে সচেতন নন।
‘সিলিকোসিস’ অসুখ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এই পেশায় শ্রমিকদের জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টের লক্ষণ দেখা দিলেই সতর্ক হতে হবে। প্রত্যেক শ্রমিকের মুখে মাস্ক চাই বাধ্যতামূলক ভাবে। নিয়মিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হোক। সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধির দিকেও নজর দিতে হবে।
দীপংকর মান্না, চাকপোতা, হাওড়া
কুঠার ও ছোরা
রোচনা মজুমদারের লেখা ‘কিছু একটা করতে হবে তো’ (৩-১১) সময় ও সমাজের সূত্রে বেঁধেছে ঋত্বিক ঘটক এবং গুরু দত্তকে। দু’জনেই আবেগপ্রবণ এবং প্রতিবাদী। দু’জনেরই হাতিয়ার সমাজ ও জীবনসূত্রে প্রাপ্ত কুঠার ও ছোরা। ঋত্বিক ঘটক সেই কুঠার দিয়ে সময়কে ক্রমাগত আঘাত করতে করতে ক্লান্ত অবসন্ন এবং ভূলুণ্ঠিত হয়ে যান। গুরু দত্তও তাঁর প্রতিবাদী স্বর লিরিক্যাল মেজাজে চাপা স্বরে উচ্চারণ করতে করতে শব্দ ছন্দ সুর টুকরো করতে করতে এক সময় ছোরাটা ব্যবহার করেন আত্মঘাতের জন্য। ঋত্বিকের ছবিগুলির পটভূমি দেশভাগের ফলে অজস্র মানুষের বাঁচার সংগ্রামের তথ্যচিত্র। মেঘে ঢাকা তারা-র আবেগ স্পর্শ করার জন্য এক সাধারণ আখ্যানকে অসাধারণ উচ্চতায় বৈপরীত্যের উপকাঠামোর প্রেক্ষাপটে হাজির করেছেন ঋত্বিক। অযান্ত্রিক সিনেমায় তথাকথিত যন্ত্রকে ব্যক্তিত্ব আরোপের মধ্যে রয়েছে আগামী সময়ের ব্যঞ্জনা। যুক্তি তক্কো আর গপ্পো-য় কঠোর এবং ব্যঙ্গাত্মক ভাবে বুদ্ধিজীবীদের বিশ্লেষণ অথবা সুবর্ণরেখায় যে কঠোর নির্মম সত্য উন্মোচিত হয়, সেই দুঃশাসনীয় সমাজের উন্মোচন ঋত্বিকের ভীমপ্রতিজ্ঞা ছাড়া আর কী করে হত? গুরু দত্তের সাহেব বিবি অউর গোলাম-এ নামেই প্রমাণ মানুষ যেন ভাগ্যের হাতের পুতুল। যতই শোভনীয় লাগুক আসলে মানুষ কাগজ় কে ফুল।
তাঁরা দু’জনেই সমালোচিত, দর্শকানুকূল্য লাভেও বঞ্চিত। এ বড় দুর্ভাগ্য! শঙ্খ ঘোষের এক লেখা থেকে জানা যায় ঋত্বিকের কোনও সিনেমা মুক্তি পেলে পরিচালকস্বয়ং হলের সামনে দাঁড়িয়েহাতজোড় করে রাস্তার মানুষকে ডাকছেন তাঁর সিনেমাটি দেখে যাওয়ার জন্য। এ রকম হয়তো আমাদের সমাজেই হয়।
প্রতিমা মণিমালা, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy