জহর সরকারের নিবন্ধটি (‘প্রশ্নটা বাঙালির আত্মরক্ষার’, ১৫-৪) অত্যন্ত সময়োপযোগী। ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে। ...মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা তত গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে।” বাস্তবিক সামাজিক বৈষম্য সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকদের কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছিল।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের অপসারণ, অর্থাৎ ছিদ্র বন্ধ করে শনি প্রবেশের রাস্তা বন্ধ করতে চিত্তরঞ্জন দাশ অগ্রণী হলেন। হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানে অনবদ্য ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এর অবতারণা করলেন। এই প্যাক্ট-এ বলা হল, আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব হবে জনসংখ্যার অনুপাতে এবং পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা, স্থানীয় প্রশাসনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব হবে যথাক্রমে ৬০ এবং ৪০ শতাংশ, এ ছাড়াও সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের জন্য ৫৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে।
বেঙ্গল প্যাক্ট-এর দ্বারা চিত্তরঞ্জন দাশের গ্রহণযোগ্যতা মুসলিমদের কাছে বৃদ্ধি পেল। বাংলা কংগ্রেসের একাংশ বেঙ্গল প্যাক্ট-এর বিরোধিতা করেছিল। হিন্দুদের প্রবল আক্রমণের ফলে তিনি বলেন যে, এই চুক্তিটি সাময়িক এবং সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অনুমোদন সাপেক্ষ। এই চুক্তিটি পূর্ণ স্বরাজ প্রাপ্তির পরই কার্যকর করা হবে। চিত্তরঞ্জন দাশের পূর্বে গাঁধীজি খিলাফতকে অস্ত্র করে হিন্দু-মুসলমান সহযোগিতা লাভে সফল হয়েছিলেন। তবে চিত্তরঞ্জন ধর্মকে মূল হাতিয়ার না করে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি বৃদ্ধির চেষ্টা করেন।
কিন্তু ১৯২৪ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর গ্রেফতারি, এবং ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জনের অকালপ্রয়াণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধন ঢিলে করে দিতে আরম্ভ করে। যে প্রীতির বন্ধনে চিত্তরঞ্জন দুই সম্প্রদায়কে বেঁধে রেখেছিলেন, তা ছিন্ন হয়ে যায় তাঁর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে, এবং কলকাতা-সহ বাংলা বিধ্বস্ত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে।
সৌপ্তিক অধিকারী
সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
অধস্তন?
জহর সরকার লিখেছেন “… যাঁকেই তাঁরা রাজ্যের নেতা করবেন তাঁকে আজ্ঞাধীন অধস্তন হয়েই থাকতে হবে। বাংলার মানুষকে তাই এখনই ঠিক করতে হবে তাঁরা রাজ্যকে সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় শাসনাধীন অঞ্চলে পরিণত করতে রাজি আছেন কি না।” বিধান রায় যখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসেরই জওহরলাল নেহরু। বিধান রায় কি ‘অধস্তন’ হয়ে গিয়েছিলেন? না কি বাংলা কেন্দ্রীয় শাসনাধীন অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল? এই ধরনের ভাবনা অর্থহীন ও হাস্যকর। এখন বাঙালি-অবাঙালি নিয়ে এক চরম প্রাদেশিকতার চর্চা শুরু হয়েছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। এটা আর এক নতুন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা। প্রাদেশিকতার উপর ভর করলে বাংলার রাজনীতির জমি উর্বর হতে পারে। কিন্তু বাঙালির আত্মপরিচয়ের পথ কি তাতে বিকশিত হবে?
মিহির কানুনগো
কলকাতা-৮১
এই দাসত্ব
জহর সরকারের নিবন্ধ প্রসঙ্গে জানাই, এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে রাজনীতির মসনদ দখলের উদ্দেশ্যে বিজেপির নেতা-নেত্রীরা বাঙালির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে আক্রমণ করে যে ভাষায় কথা বলছেন, তা নিয়ে লেখকের সঙ্গে আমরাও চিন্তিত। বাংলার দিকপাল মনীষীদের বক্তব্যের এই বিকৃত রূপ যে আমাদের কোনও দিন শুনতে হবে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু প্রশ্ন হল, বিজেপি ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও আমরা কি ‘বাঙালিত্ব’ রক্ষা করতে পারব, বাঙালির হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে পারব? সমগ্র জাতির মেরুদণ্ডে ঘুণ ধরে যায়নি তো?
ভোট শুরুর কিছু দিন আগে থেকে দেখলাম, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরা দলে দলে বিজেপিতে যোগদান করছেন। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি, রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত নেতা— দিল্লি থেকে ভোটের প্রচারে যিনিই আসছেন, মঞ্চে উঠে তাঁদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বিজেপির পতাকা নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে পড়ছেন। বাঙালির দাসত্ববৃত্তির চরমতম উদাহরণ। এঁরা বাঙালির মর্যাদা রক্ষা করবেন? আজ যখন একের পর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারে এসে বাঙালির কাছের লোক হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে গিয়ে মঞ্চ থেকে বাঙালি মনীষীদের বিভিন্ন উক্তির বিকৃত রূপ প্রকাশ করেন, তখন ভিড় থেকে কোনও বাঙালি কি বলেন যে, “রাজনৈতিক বক্তব্য রাখুন, ক্ষতি নেই। কিন্তু দয়া করে বাঙালি মনীষীদের নামে এই বিকৃত বা ভুল তথ্য দেবেন না, আমরা শুনতে চাই না?” মঞ্চে উপস্থিত যাঁরা, তাঁদেরও সেই সৎ সাহস নেই। ১০০ বছর আগে আলস্যপ্রিয় বাঙালিকে দাসত্ববৃত্তি সম্পর্কে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সাবধান করেছিলেন।
শাসক ও বিরোধী দলের রাজ্য স্তরের কিছু নেতা-নেত্রীও বক্তব্য রাখাকালীন যে মৌখিক এবং শরীরী ভাষা প্রয়োগ করেছেন, তা-ও সমর্থনযোগ্য নয়। মঞ্চ এবং ময়দানের পরিবেশ হয়ে উঠেছে কুরুচিপূর্ণ। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, বাংলার মানুষ যে ভাষায় কথা শুনতে পছন্দ করেন, তিনি সেই ভাষায় কথা বলবেন। বুঝতে অসুবিধে হয় না, বাংলার সংস্কৃতি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেক প্রচারসভায় কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। আজ কোনও রাজনৈতিক দল শিল্পের কথা বলে না। বাঙালি কি সম্মান নিয়ে এ দেশে বাঁচবে, না শুধু ভিক্ষা নিয়েই টিকে থাকবে? আর সেটাই মনে করবে জীবনের একমাত্র প্রাপ্তি? এর থেকে দুঃখের দিন কী হতে পারে! বাঙালি তরুণ-তরুণী নিজের পেটের চিন্তা করবে, না বাঙালিত্ব রক্ষা করবে? অপদার্থ রাষ্ট্রশক্তি এটাই চায়।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-৫৭
বাঙালি মানস
জহর সরকারের নিবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। হোসেনুর রহমান ‘সুভাষচন্দ্র ও বাঙালি মানস’ নিবন্ধে (দেশ, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৯৬) লিখেছিলেন, “বাঙালি মানসিকতা বলতে যা বুঝি তা হল বাঙালি দুঃখ, দারিদ্র, বঞ্চনা সহ্য করেও কাব্য, রাজনীতি, কবিতা, নাটক নিয়ে পরম সুখে কালাতিপাত করতে পারে।... গতানুগতিকতা, ধর্মমনস্কতা কিংবা ভয়াবহ অর্থগৃধ্নুতা সাধারণত বাঙালির কল্পনাকে কোনও দিন যথেষ্ট আয়ত্ত করতে পারেনি। আর সে জন্যেই দক্ষিণ-উত্তর ভারতের ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে পূর্ব দেশের বাঙালি চিরকালই কোনও না কোনও অর্থে আপত্তিকর। কারণ ধর্মে বাঙালির মতি নেই। পূজা-আর্চায় মন নেই, গুরুজনে ভক্তি নেই।” একুশ শতকে এসে তবে কি বাঙালির চরিত্রে চিড় ধরল? এই সময়ের বঙ্গদেশের পরিস্থিতি বলে, কিছুটা হলেও নিজস্ব জাতিগত চরিত্রকে ক্ষুণ্ণ করে বাঙালি আজ দিগ্ভ্রষ্ট পথিক! ধর্মীয় উন্মাদনায় মত্ত এই বঙ্গদেশ আমার নয়।
সঞ্জয় রায়
দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
রাজধর্ম
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হচ্ছে। এই নির্বাচনে বিজেপি জিততে চায়। এই দলের সর্বোচ্চ নেতা নরেন্দ্র মোদী, তিনি নির্বাচনী প্রচারে নেতৃত্ব দেবেন, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তিনি যে দেশের প্রধানমন্ত্রীও বটে, সে কথা ভুলে গেলে চলবে? তাঁর দল তো ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ নয়, অন্য নেতারা আছেন এবং তাঁরা যথেষ্ট ওজনদার। তা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যখন করোনা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে, তখন তিনি প্রায় রোজ এ রাজ্যে এলেন, একের পর এক জনাকীর্ণ সভায় ভাষণ দিলেন। তাঁর মঞ্চে অবশ্য সবাইকে উঠতে হল কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে। এ কি ‘রাজধর্ম’? তিনি নিজেই বিভিন্ন সভায় দাবি করেছেন, তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গিয়েছে। যদি তা-ই হয়, তবে কি একটি রাজ্যের নির্বাচনে ব্যস্ত না থেকে করোনার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত ছিল না?
প্রিয়রঞ্জন পাল
রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy