শঙ্খ ঘোষ। —ফাইল চিত্র
শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে জয় গোস্বামীর ‘তাঁর কবিমনের গতি সমাজের দিকে আর অতলান্ত অন্তরে’(৫-২) লেখাটি পড়লাম। আমরা, যাঁরা কবি শঙ্খ ঘোষকে ভালবাসি, তাঁর সৃষ্টিকে আপন আপন সাধ্য অনুসারে গ্রহণ করতে চেষ্টা করি, কখনও কখনও তাঁর প্রত্যক্ষ সঙ্গলাভেরও অভিলাষী হই। প্রতি রবিবারে এবং তাঁর জন্মদিনে তো বটেই, অজস্র মানুষের জমায়েত তাঁর গৃহে। দেখেছি, স্বল্পবাক শঙ্খদা কথা কমই বলেন, স্বমনোযোগে শোনেন সবার কথা। প্রত্যহ দেখছি আত্মীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে শঙ্খদার ঘরে এমন উপচে পড়া ভিড়!
আমরা কি তাঁর সময়ের অপচয় করে এলাম এ-তাবৎ কাল! অনেকেই যে নিজের গবেষণার কাজ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন বা লেখা দেখতে দেন, শঙ্খদা বলেন, সে সব থেকে তিনিও অনেক নতুন তথ্য জানতে পারেন, তাঁর ভাল লাগে। আমরা যদি তাঁর সময়ের এত অপচয় না করতাম? ছাপার অক্ষরে কবি শঙ্খ ঘোষ চিন্তাবিদ শঙ্খ ঘোষ কি তা হলে আরও প্রতিফলিত হতেন?
স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের কথাই মনে এসে যায়। কত যে কাজে অকাজে জড়িয়েছিলেন নিজেকে। অকিঞ্চিৎকর একটা চিঠির উত্তরে তাঁর কলম পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলে। একটি শিশুও তাঁকে চিঠি লিখে সযত্ন উত্তর পেয়েছে বরাবর। তাতে কি তাঁর সৃষ্টির জগৎ খর্ব হয়েছিল, হয়েছিল একটুও আপনাবিস্মৃত?
হয়তো তা নয়, স্রষ্টা কখন কোথা থেকে যে আপন মনের রসদ সংগ্রহ করে নেন, তা আমার মতো অ-কবি সাধারণ মনের মানুষের অনুভবে সামান্যই হয়তো ধরা দেয়, বা দেয় না। শঙ্খদা যে এমন করে সবাইকে আকর্ষণ করতে পেরেছেন, আপনজন হতে পেরেছেন, আর সকলের কাছ থেকে নিজেকে পৃথক করে রাখেননি, এ আমাদের এক আশ্চর্য সৌভাগ্য।
অভীককুমার দে
কলকাতা-৩৭
‘রাবীন্দ্রিক’?
রবীন্দ্রনাথের অনুভূতির উচ্চতা অভ্রংলিহ আর অতলান্ত সমুদ্রের মতোই তা গভীর। এমন কবির অনুভবজাত কোনও কথা বা উদ্ধৃতিকে সামগ্রিক পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে টেনে নিয়ে, আত্মপক্ষ সমর্থনের পথ সহজেই আলোকিত করা যায়, কিন্তু সেই সঙ্গে কবির মূল অভিপ্রেত আদর্শকে যে প্রায়ই খাটো করা হয়, এমন কথাটি অনেকেই ভুলে যান। বিশ্বজিৎ রায়ের ‘সজাগ থাকাই রাবীন্দ্রিক’ (১৯-১) নিবন্ধটি পড়তে গিয়ে এমনই সব পুরনো কথা ফের যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল।
নিবন্ধকার মূলত ‘অচলায়তন’, ‘মুক্তধারা’ আর ‘রক্তকরবী’ গ্রন্থের নির্যাস নিষ্কাশন করে বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতনের বিক্ষোভকারী পড়ুয়াদের সমর্থন করেছেন, তারিফ করেছেন তাদের প্রশ্নশীলতাকে। কিন্তু ভুলে গেলেন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রবীন্দ্রনাথের সেই উদার আদর্শের কথা: ‘‘অনেকে এখানে এসেছেন, বিচিত্র তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা— সকলকে নিয়েই আমি কাজ করি, কাউকে বাছাই করি নে, বাদ দিই নে; নানা ভুলত্রুটি ঘটে, নানা বিদ্রোহ-বিরোধ ঘটে— এ সব নিয়েই জটিল সংসারে জীবনের যে প্রকাশ ঘাতাভিঘাতে সর্বদা আন্দোলিত, তাকে আমি সম্মান করি।’’ (রবীন্দ্ররচনাবলী, চতুর্দশ খণ্ড, প. সরকার, ১৯৯২, পৃ ৫৩৭)।
এমন নিষ্কলুষ অভিব্যক্তির আলোয় এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, রবীন্দ্রনাথ যদি বেঁচে থাকতেন, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তের বলতে আসার বিরুদ্ধে তিনি ইন্ধন জোগাতেন না। বরং বক্তা আর ‘প্রশ্নশীল’ পড়ুয়াদের মুখোমুখি বসিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠানটিকে করে তুলতেন সর্বাঙ্গসুন্দর। কেননা, আজীবন পরমতসহিষ্ণুতাই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে দামি।
আমন্ত্রিত বক্তা-সহ উপাচার্যকে ঘেরাও করে রাখার মধ্যে যে ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে, তার সবটাই বিশ্বভারতীর আদর্শের পরিপন্থী। এতে প্রলম্বিত হয়েছে এক জঘন্য, কুৎসিত ভাবমূর্তিরই কালো ছায়া। মন যথার্থ ভাবে ‘প্রশ্নশীল’ হয়ে উঠলে, মনের সম্পদেই সম্মাননীয় ব্যক্তিকে বরণ করে নেওয়া সমুচিত। শক্তিপ্রদর্শনে সে পথ রুদ্ধ করে দেওয়া তো এক ধরনের কাপুরুষোচিত পলায়নবৃত্তি!
যদি পড়ুয়ারা সে দিন বক্তাকে প্রশ্নোত্তরে জর্জরিত করে নিজেদের বুদ্ধিদীপ্ত পরিচয় তুলে ধরতেন, তবেই হত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে দীক্ষিত মনের উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ।
দেবশ্রী সেনগুপ্ত
কলকাতা-৯
ভুল ভাইরাল
১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ হিসেবে। দিনটির বিষয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। তাই পক্ষে বা বিপক্ষে আমার কোনও বক্তব্য নেই। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখছি, সোশ্যাল মিডিয়াতে দিনটিকে নিয়ে অপপ্রচার চলছে।
বলা হচ্ছে, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভগৎ সিংহ, রাজগুরু ও শুকদেব-দের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। আবার মতপার্থক্যে বলা হচ্ছে, ওই দিন ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তাই ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতীয়দের কাছে অন্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ দিন। ওই দিন বরং শহিদদের সম্মান জানানো উচিত। ভালবাসার দিন পালন করা উচিত নয়। এ হেন পোস্ট এখন ‘ভাইরাল’ হয়ে দৌড়চ্ছে।
এই ধরনের পোস্ট স্পষ্টতই তথ্যবিকৃতি। ইতিহাসকে বিকৃত করে আমরা কিন্তু শহিদদের অসম্মানই করছি। জানি না এ হেন বিভ্রান্তিকর তথ্য কার মাথায় প্রথম এল।
ইতিহাস বলছে, ভারতে ৮ এপ্রিল ১৯২৯, দিল্লিতে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভায় বোমা নিক্ষেপ করে বিপ্লবী ভগৎ সিংহ ও বটুকেশ্বর দত্ত গ্রেফতার হন। ১৪ জুন ১৯২৯, বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাস গ্রেফতার হন। এর পর গ্রেফতার হন শুকদেব, রাজগুরু-সহ অনেক বিপ্লবী। জেলে থাকাকালীন প্রত্যেকে দফায় দফায় আমৃত্যু অনশন করেছিলেন।
১৯২৯ সালে ২৬ জুন, ২৩ জন বিপ্লবীর বিরুদ্ধে শুরু হয় মামলা। যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ‘লাহৌর ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে বিখ্যাত। এই মামলা চলাকালীন, ৬৩ দিন আমৃত্যু অনশন করে, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাস মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৩০ সালে ৭ অক্টোবর, ‘লাহৌর ষড়যন্ত্র মামলা’য় ভগৎ সিংহ, শুকদেব ও রাজগুরুর প্রাণদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। ফাঁসির দিন ধার্য করা হয় ২৪ মার্চ। আর শিব বর্মা, কিশোরীলাল, গয়াপ্রসাদ, জয়দেব কপূর, বিজয় কুমার সিংহ, মহাবীর সিংহ, কমলনাথ তেওয়ারি প্রভৃতি বিপ্লবীদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ দেওয়া হয়। এবং বাকিদের দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১, প্রখ্যাত জননেতা পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয়, বড়লাটের কাছে ভগৎ সিংহ-দের পক্ষে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেন। সমস্ত দেশবাসীর হয়ে আবেদন জানালেও, তাঁর আবেদন নাকচ হয়ে যায়।
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১, এক লাখ মানুষের গণস্বাক্ষর সংবলিত ভগৎ সিংহদের দণ্ডাজ্ঞা রদের আবেদনপত্রও বড়লাট নাকচ করেন।
১৯৩১-এর ১৪ মার্চ, গাঁধীজির কাছে সুভাষচন্দ্র অনুরোধ জানান ভগৎ সিংহ, শুকদেব ও রাজগুরুর মৃত্যুদণ্ড রোধ করার চেষ্টার জন্য। কিন্তু গাঁধীজি বিশেষ আগ্রহ দেখাননি।
অবশেষে, নির্ধারিত দিন (২৪ মার্চ)-এর আগের দিন, ২৩ মার্চ ১৯৩১, ভগৎ সিংহ, রাজগুরু ও শুকদেবের ফাঁসি হয়। (ঋণস্বীকার: অসিতাভ দাশ সম্পাদিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত: তারিখ অভিধান’)।
তাই, ওই দেশপ্রেমী বিপ্লবীদের ফাঁসি হয়েছিল ২৩ মার্চ। ১৪ ফেব্রুয়ারি নয়। এটাই প্রকৃত ইতিহাস। ভাইরাল হওয়া বিকৃত ইতিহাস বিষয়ে সকলকে সজাগ থাকার জন্য অনুরোধ করছি। কারণ এই ধরনের কথা আমরা না জেনেই অনেক সময়ে বিশ্বাস করি এবং উত্তেজিত হয়ে অনেক ভুল কথা বলে ফেলি।
বিশ্বনাথ বিশ্বাস
কলকাতা-১০৫
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy