কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সৃষ্টি এবং বিপুল প্রসার ঘটেছিল এক সময়, আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। ফাইল ছবি।
শিশির রায়ের ‘নিজভূমে শরণার্থী’ (১৯-২) শীর্ষক প্রবন্ধটি একটি সময়োপযোগী লেখা। ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর প্রাক্বালে লেখাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চায়, বাংলা ভাষা এখনও ‘নিজভূমে পরবাসী’। কিন্তু, কেন এই হাল? আমরা যে এখনও সেই ভাষা ব্যবহারে যত্নশীল হইনি, এই আক্ষেপ প্রবন্ধকার-সহ বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চাকারী প্রত্যেকেরই। কেন আমরা সব সময় নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে অন্য একটি ভাষা হিন্দি কিংবা ইংরেজির সঙ্গে লড়িয়ে দিই? বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির উদাসীনতা বেশ কয়েক দশক ধরে লক্ষ করা গিয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাংলা না পড়তে বললেই যেন তারা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। যে কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সৃষ্টি এবং বিপুল প্রসার ঘটেছিল এক সময়, আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। বছরের পর বছর বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির দিকে কারও নজর নেই। কালক্রমে, স্কুলগুলি বন্ধ হওয়ার মুখে। স্কুলই যদি না থাকে, ভাষা শিক্ষার পাঠ কোথায় পাবে ছাত্রছাত্রীরা? পরিতাপের বিষয়, সেই স্কুলগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার কোনও পরিকল্পনা আজ পর্যন্ত হল না।
অভিজ্ঞতায় বলি, টিফিন টাইমে এক সপ্তম শ্রেণির ছাত্র বাড়ি যেতে চায়। স্কুলের লিভ রেজিস্ট্রারে তাকে নাম, ক্লাস, সেকশন, রোল নম্বর এবং কারণ লিখতে বললে সে নিজের নামটুকুই লিখেছে। তার পেট ব্যথা— এই বানান বলে দেওয়া সত্ত্বেও সে লিখতে পারেনি। জানতে চাই, সে বাংলা বর্ণমালা লিখতে জানে কি না। ভাবলেশহীন ছাত্রটি মাথা নাড়িয়ে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে। তার বাংলা বর্ণমালা শেখা এখনও হয়ে ওঠেনি। অথচ, সে শুধু নিজের নামটুকু লিখতে শিখেছে বা শেখানো হয়েছে। কেন এই হাল? সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক— সবাই পরস্পরের দিকে দায় ঠেলাঠেলি করে ক্ষান্ত হই। কিন্তু ভাষা শিক্ষা এখন এই করুণ অবস্থাতেই বিচরণ করছে, যার মান ক্রমশ নিম্নমুখী। প্রতি বছরের মতো এই বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষাও বাংলা ভাষার পরীক্ষা দিয়ে শুরু হয়েছিল। পরীক্ষার শেষে পরীক্ষকদের হাতে খাতা এলে প্রতি বছরের মতো এ বারেও হয়তো দেখা যাবে, বহু ছাত্রছাত্রী ঠিকমতো বাংলা বাক্য লিখে উঠতে পারেনি। মাধ্যমিকেও ভাষাশিক্ষা ঠিকমতো না হওয়ার কারণে বিভিন্ন মিডিয়ায়, সমাজমাধ্যমে বাংলা ভাষা নিয়ে কয়েক দিনের জন্য হাহাকার পড়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থেকে যাবে।
এর সমাধানের জন্য সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। বাংলা ভাষার মান-মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে হলে আজকের ছাত্রছাত্রীদের বাংলা গল্প, ছড়া, প্রবন্ধ, নাটক এবং উপন্যাস পড়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। তাদের লাইব্রেরিমুখী করতে হবে। তার জন্য রাজ্য সরকারের উচিত, যথেষ্ট সংখ্যায় লাইব্রেরিয়ান নিয়োগের মাধ্যমে লাইব্রেরিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা। সর্বোপরি, কোনও একটি বিশেষ দিন নয়, সারা বছর ধরেই আমবাঙালিকে এই ভাষার চর্চা করে যেতে হবে।
বাংলা ভাষা নিয়ে শুধু আবেগের ফুলঝুরি নয়, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ও যাপনে বাংলা ভাষার ব্যবহারে খুব যত্নবান হতে হবে। প্রত্যেককেই মনে রাখতে হবে, যে বাংলা ভাষার জন্য এক দিন রক্তপাত হয়েছে, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন দুই বাংলার মানুষ, সেই বাংলা ভাষার কৌলীন্য অটুট রাখার দায় সবার।
অরুণ মালাকার, কলকাতা-১০৩
বিবিধ রতন
শুধু লেখকদের নয়, বাংলা ভাষা রক্ষার দায় সাধারণ মানুষেরও— প্রবন্ধকার শিশির রায়ের এ কথা অনস্বীকার্য। ভাষা প্রয়োজনীয় গ্রহণ ও বর্জনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। স্কুলে ক্লাসের অভিজ্ঞতা এ রকম। ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী পিকনিক-এর বর্ণনায় লিখেছে— দিদি ও তার বন্ধু সকাল সকাল ‘রেজা-রেজি’র কাজ শুরু করল। রেজা-রেজি কথাটি মূলত গ্রামবাংলায় ব্যবহৃত হয়। সে লিখেছে— “দুপুরে আমাদের মেনু ছিল ভাত, স্যালাড, ফুলকপির তরকারি, আলু পুস্তু, চিকেন... বাড়ি ফিরে খুব আলামাড়া লাগছিল।” শিক্ষকমশাই ‘রেজা-রেজি’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত নন। তিনি জানলেন, তরকারি কাটাকে রেজা-রেজি বলে। বেশ কিছু ছাত্রী হেসে উঠলে মেয়েটি একটু লজ্জা পেল। এক দিকে কথ্য ভাষা, তার পাশে চিকেন, মেনু-র মতো ইংরেজি ভাষা। কথ্য ভাষার কারণেই গ্রামের ছেলে বা মেয়েটি স্কুলে হাসির খোরাক, অথচ এই কথ্য ভাষাই সাধের বাংলা ভাষার জিয়নকাঠি। মান্য বাংলার ব্যবহার গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভাল জানে না। ইংরেজি উচ্চারণেও নেই সাহেবিয়ানা। তারা যে বাংলা মাধ্যমে পড়ে। ভাল কলেজে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বড্ড বেমানান। তাই হীনম্মন্যতায় ভুগে এক দিন কলেজ ছেড়ে দেয়, অথবা পরীক্ষায় খারাপ ফল করে।
২০১০ সালে রেলমন্ত্রী রৌরকেলা থেকে ভুবনেশ্বর-রৌরকেলা ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস উদ্বোধন করতে পারেননি, কারণ আমন্ত্রণপত্র ছাপানো হয়েছিল বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায়। ওড়িয়া ভাষায় ছাপা না হওয়ায় অনুষ্ঠানটি করা যায়নি। ভাষাকে ভালবেসে তার জন্য গর্ব অনুভব করা ও তার প্রতিষ্ঠার জন্য অস্মিতা প্রয়োজন। প্রয়োজন সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা। ১৩৮৬ সালের পঁচিশ বৈশাখ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু জানান, ওই দিন থেকেই সরকারের সমস্ত কাজকর্ম বাংলা ভাষায় হবে। ১৪০৮ সালের পয়লা বৈশাখ ওই একই ঘোষণা করা হয়েছিল। বর্তমান সরকারও একই ঘোষণা করেছে, কিন্তু বাস্তব সম্পূর্ণ ভিন্ন। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মহানগরীর সব দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলা ভাষার ব্যবহার আবশ্যক করা হয়েছিল। তা আজ অতীত।
সলিল চৌধুরীর লেখা এই লাইনগুলো আজ যেন আমাদের প্রত্যয়ী করে তোলে— “আমার প্রতিবাদের ভাষা/ আমার প্রতিরোধের আগুন/ দ্বিগুণ জ্বলে যেন...।”
দেবাশিস দাস বোলপুর, বীরভূম
কুকথায় পঞ্চমুখ
শিশির রায় তাঁর প্রবন্ধটিতে খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা লিখেছেন। বাংলা ভাষার কৃষ্টিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সবারই এগিয়ে আসা উচিত। সেই সঙ্গে একটা কথা ভেবে আমি অবাক হয়ে যাই— আমাদের গর্ব বাংলা ভাষা দিন দিন কী রকম ক্লেদাক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই নিয়ে প্রতিবাদ করতে এক জনও বিদ্বজ্জন এগিয়ে আসছেন না। প্রকাশ্য রাস্তাঘাটে, বিশেষ করে অল্পবয়সি ছেলেরা চিৎকার করে যে রকম চূড়ান্ত অশ্লীল ভাষায় কথা বলে, তা শোনেননি এমন কেউ নেই। কিন্তু প্রত্যেকেই ভান করে আছেন, যেন তিনি কিছু শুনতে পাননি। কুবাক্য যারা বলে, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে যদি বলি— ছি, তোমাদের মুখে এ সব কী ভাষা। এ সব কথা বলতে নেই। গোপনে বলো, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একান্তে আড্ডা দিতে গিয়ে বলো, ঠিক আছে। কিন্তু প্রকাশ্যে এ সব বোলো না— তার পর এই বীরপুঙ্গবদের হাতে কী ভাবে চূড়ান্ত লাঞ্ছিত হতে হবে, তা ভাল করেই জানি। হয়তো শারীরিক ভাবেও নিগৃহীত হতে হবে। আশপাশের মানুষ মনে মনে আমাকে সমর্থন করবেন। আবার, তাঁরা কখনও আমাকে বাঁচাতে সাহস করে এগিয়ে আসবেন না। তাই আমি মুক্তকণ্ঠে এর প্রতিবাদ করব না। সেটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ব্যক্তিগত আলাপচারিতাতেও অল্পবয়সিদের মধ্যে এই কুবাক্যের স্রোত নিয়ে অনেকের মুখেই কোনও অসন্তোষের কথা শুনতে পাই না। যদি আমি নিজে থেকে এই প্রসঙ্গটা তুলি, তবে তাঁদের মুখে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের সুর শুনতে পাই— এরা তো আজকালকার ছেলে। এই সব ভাষা বলবেই তো। আপনি আমি কী করতে পারি বলুন। এই প্রশ্রয়ও পরোক্ষে কুবাক্য বলাকে ইন্ধন জোগাচ্ছে।
অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা-৫০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy