—প্রতীকী ছবি।
‘দুস্তর পারাবার’ (১৬-৬) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে পুরুষ ও নারীর মাঝে দুস্তর ব্যবধানের বিষয়ে আলোকপাত করার পাশাপাশি কিছু আশাব্যঞ্জক কথাও বলা হয়েছে, যা পড়ে মনে সাহস জাগে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর গবেষণা অনুযায়ী, ‘জেন্ডার গ্যাপ’ বা ‘লিঙ্গগত ব্যবধান’ পূর্বাপেক্ষা কমেছে, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতেও তা ঘুচিয়ে ফেলা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি পর্যবেক্ষণ প্রাসঙ্গিক হবে। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে অমর্ত্য সেন পরিসংখ্যান সহকারে দেখিয়েছিলেন যে, প্রায় ১০ কোটি নারী বিশ্বের জনসংখ্যা থেকে উধাও হয়েছেন। সাধারণত পুরুষের তুলনায় নারী দীর্ঘায়ু হন। তাই জনসংখ্যায় পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি হওয়া উচিত। অমর্ত্য সেনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, তৎকালীন সময়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকাতে ১০০ জন পুরুষপিছু ১০৫ জন নারী ছিলেন। কিন্তু চিন ও বাংলাদেশে ছিলেন ১০০ জন পুরুষপিছু ৯৪ জন নারী, পাকিস্তানে ৯০ জন নারী। এর কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য, অপুষ্টি ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চনা। এই সব কারণে মেয়েদের জীবন দ্রুত ফুরিয়ে গিয়েছে।
পারিবারিক বা সামাজিক সম্পদ কখনও নারী-পুরুষে সমভাবে বণ্টিত হয়নি। আগে মনে করা হত, পরিবারের কর্তাই আয় করবেন, অন্যরা ভোগ করবেন। সাংসারিক কাজকর্ম করা সত্ত্বেও পরিবারের মেয়েদের কোনও প্রত্যক্ষ আয় ছিল না। এক সময়ে অর্থনীতিবিদরা পরিবারের কর্তা তথা পুরুষ সদস্যের প্রতি তাঁদের নজর কেন্দ্রীভূত করে রাখতেন। এখন বলা হয়, পরিবারের মহিলারাও সম্পদ সৃষ্টির উৎস। এঁদের শ্রমও অর্থনীতিতে সমান গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব অনুযায়ী, বেতনহীন শ্রম বিশ্বের অর্থনৈতিক উৎপাদনের ৭০ শতাংশ। তাই নারীর অবদানকে উপেক্ষা করা চলে না।
অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
সংস্কারের বোঝা
‘দুস্তর পারাবার’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাঠক সমাজের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর গবেষকরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাপ্তি ও অর্জন, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রা এবং রাজনৈতিক সামর্থ্য— এই চারটি পরিমাপে বিশ্বের পুরুষ ও নারীর অবস্থান বিচার করেছেন (২০২৪)। ফলাফল, পুরুষ ও নারীর মাঝখানে দুস্তর ব্যবধান দূর করতে ১৩৪ বছর লাগবে। এই ব্যবধান কতটা বিপুল, কতটা অনৈতিক!
আমরা যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তাতে এই ব্যবধান থাকাটাই যেন বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক দিকে পুঁজিবাদের জাঁতাকল, অপর দিকে পুরুষশাসিত সমাজের নানা নিয়মের বেড়াজাল, এই দুইয়ে আবদ্ধ মেয়েরা। তার উপর ভারতের সাবেক সংস্কৃতি, মনুসংহিতার নিদান মেনে চলতে গিয়ে নারীদেরও অস্থি-মজ্জায় এমন কিছু কুসংস্কার মিশে গিয়েছে, যেগুলো থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। সেই জন্য মেয়েরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিজেরাই নিজেদের অগ্রগতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা সময় নারীর বাক্স্বাধীনতা ও ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার ছিল না। শিক্ষা অর্জনের সুযোগ ছিল না। এ সবের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল। নবজাগরণের সময়ে ভারতে নারী-শিক্ষার আয়োজন হয়। পরে স্লোগান উঠেছে নারী-স্বাধীনতার, নারীমুক্তির এবং সমান কাজে সমান মজুরির। আজও সেই সব দাবি পূরণ হয়নি।
মেয়েদের বাইরে যেতে মানা, এ দিকে-ও দিকে চাইতে মানা, এগোতে-পিছোতে দোষ, এ সব সংস্কার পিছু ছাড়ে না। পুরুষদের বুঝতে হবে, নারীর মুক্তির সঙ্গে তাদেরও মুক্তি জড়িয়ে আছে। অসাম্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হবে। না হলে ১৩৪ বছর কেন, আরও অনেক বেশি বছর পেরিয়ে যাবে।
কৃষ্ণা সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া
কলমে ফাঁস
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘুরে দাঁড়ানোর দায়’ (১৮-৬) শীর্ষক প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠির অবতারণা। গণতন্ত্রের সূচকে ভারতের স্থান অনেক দিন ধরেই ক্রমশ নিম্নগামী। বিগত কয়েক বছর ধরে ঘটে আসা একের পর এক ঘটনায় বিশ্বের দরবারে ভারতের মুখ পুড়লেও, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আসা বিজেপি সরকার ও তাদের আইটি সেল জাতীয়তাবাদের ঢেউয়ের উপর ভর করে সেটাকে ভারতের বিরুদ্ধে বিদেশি চক্রান্ত বলে প্রচার করত। দেশের সাধারণ জনগণের একটা বিপুল অংশ মোদী ও বিজেপির প্রতি তাঁদের প্রশ্নহীন আনুগত্য থেকে আজ অনেকটাই সরে এসেছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আফিম গিলতে তাঁরা যে আর প্রস্তুত নন, তা লোকসভা ভোটের ফলাফল থেকে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
কিন্তু বিজেপির আসন কমলেও ঔদ্ধত্য কমেনি। নতুন সরকার গঠনের এক মাসও হয়নি, তার মধ্যেই এক জন প্রথম সারির বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে চোদ্দো বছর আগে দেওয়া বক্তৃতার জন্য ইউএপিএ-র মতো কঠোর ও দমনমূলক আইনে মামলা শুরু করার সরকারি অনুমতি তারই সাক্ষ্য বহন করে। গণতন্ত্রে মতবিরোধ থাকাটা শুধু স্বাভাবিকই নয়, বরং সেটাই কাম্য। অরুন্ধতী রায় আজীবন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নিপীড়িত মানুষদের হয়ে সওয়াল করেছেন। যে রাষ্ট্র তাঁর সেই স্বাধীন কণ্ঠস্বরটিকে রোধ করতে চায়, তাকে ধিক্কার জানাই।
সৌরনীল ঘোষ, কলকাতা-১৪১
ধর্মের কল
পায়েল বসু তাঁর ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই’ (৭-৬) প্রবন্ধে ঠিকই বলেছেন, আজ ভোট-রাজনীতির জাঁতাকলে ‘ধর্ম’ পিষ্ট হয়ে মানুষকে বিপন্ন করে তুলছে। এ সময়ে কবি নজরুল বড়ই প্রাসঙ্গিক। যে মানুষটি একই আসরে গাইতে পারেন আগমনী গানের পাশাপাশি ইসলামি ভক্তিগীতি, তাঁকে কি ‘ধর্মের কল’-এ বিভাজন করা যায়! তিনিই লিখতে পেরেছিলেন ‘মহাকালের কোলে এসে গৌরী হ’ল মহাকালী’-র মতো পরমাশ্চর্য শাক্তগীতি। আবার তাঁরই কলম থেকে বার হয়েছিল, ‘যাবি কে মদিনায়, আয় ত্বরা করি’-র মতো রূপক প্রতীকে মোড়া ইসলামি ভক্তিসঙ্গীত। নজরুল কালের কণ্ঠে পরিয়েছিলেন এমনই সব গানের অক্ষয়মালা। তিনি চেয়েছিলেন মানবের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি, পূর্ণ মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠা। ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ। সেখানে তিনি অন্তহীন প্রেমানুভবে মহীয়ান। সেখানে “হিন্দু-পুরাকথার অন্তরঙ্গে আন্তরিক ইসলামি প্রত্যয়কে জড়িয়ে এক সর্বভারতীয় জীবন-ঐতিহ্যের লালন এবং উন্মোচন ঘটেছে নজরুলের কবিতায়” (ভূদেব চৌধুরী, বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সংস্করণ)।
আবার ১৯২৬-এর এপ্রিলে কলকাতায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অত্যন্ত বিচলিত হয়ে নজরুল লিখেছিলেন, “ধর্ম সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সত্য চিরদিনই বিশ্বের সকলের কাছে সমান সত্য।” (ছুতমার্গ)। তিনি অনুভব করেছিলেন গরিব মানুষের একটাই ধর্ম, বেঁচে থাকার আকুল চেষ্টা। আর আপন স্বার্থে ধর্মীয় উন্মাদনায় কিছু স্বার্থান্বেষী সর্বদা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ধর্মের অধিকার’ (সঞ্চয়, ১৩২৩) শীর্ষক আলোচনায় বলেছেন, ধর্মের দোহাই দিয়ে কোনও জাতি যদি মানুষকে পৃথক করতে থাকে এবং তার অধিকারকে সঙ্কুচিত করে, তা হলে সে জাতিকে হীনতার অপমান থেকে রক্ষা করার জন্য কোনও রাষ্ট্রনৈতিক ইন্দ্রজাল নেই। সেখানে নজরুলও ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বলেছেন, “তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,/ মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!” নজরুল বরাবরই মনে করতেন, মানুষের প্রথম এবং প্রধান পরিচয় তার ধর্মীয় চেতনা দিয়ে নয়, মনুষ্যত্ব দিয়ে। আজ এই আদর্শের বড় অভাব।
সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy