জুনিয়র ডাক্তারদের বিক্ষোভ।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র রাজ্য মুখর। ডাক্তার মহল থেকে রাজনৈতিক মহল পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা এ বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করছেন। কিন্তু সবটুকু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, অভিমতগুলি বড়ই একপেশে হয়ে পড়েছে। কারণ খুব স্পষ্ট: বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সদ্ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, ডাক্তারদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের আড়ালে, রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির প্রসঙ্গ টেনে এনে সরকারকে দুষছেন। অন্য দিকে, ডাক্তার মহল যে অভিমত ব্যক্ত করছেন তাকেও পুরোপুরি নিরপেক্ষ বলা যায় না, কারণ তাঁদের অভিমত একান্ত ভাবেই তাঁদের নিজস্ব শ্রেণিস্বার্থ সঞ্জাত।
এনআরএস-এ যা ঘটেছে, তা নতুন কিছু নয়, বরং অতীতের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু ঘটনাটি স্বকীয়তা অর্জন করেছে অতীতের সমস্ত ঘটনাকে হিংস্রতার নিরিখে অতিক্রম করায়। সুতরাং প্রশ্ন থেকে যায়, তাৎক্ষণিক কারণের আড়ালে কি তা হলে অন্য কোনও মূলগত কারণ রয়েছে, এই ঘটনা পরম্পরার পিছনে? তাই ঘটনাটি নিয়ে গলা ফাটানোর আগে সব পক্ষেরই উচিত, পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো না করে তুলে, সামাজিক বাস্তবতার দিকে দৃষ্টিপাত করা।
বিগত বেশ কিছু বছর ধরে চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীদের সম্পর্কের অবনতির কথা কারও অজানা নয়। চিকিৎসকমহলও এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। চিকিৎসক সমাজের এক বড় অংশের অনভিপ্রেত আচরণই রোগীদের মনে চিকিৎসক সমাজের প্রতি এক অদৃশ্য ঘৃণা ও অবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছে। হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়া, গাফিলতির কারণে রোগীমৃত্যু, রোগীদের বিভ্রান্ত করে ডাক্তারদের ‘উপরি কামাই’, রোগীদের আত্মীয়দের প্রতি অমানবিক আচরণ এবং সর্বোপরি চিকিৎসার নামে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক দুর্নীতি ও অর্থপিশাচবৃত্তির অভিযোগ, কার্যত সম্পূর্ণ রোগীসমাজের সাধারণ এবং সর্বাত্মক অভিযোগে পরিণত হয়েছে।
এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে যা ঘটেছে, তা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে এই ঘটনার শিকড় সন্ধান না করে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে, নিজেদের মতো করে ঘটনাটির ব্যাখ্যা করে, মানুষকে বিভ্রান্ত করাটাও দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়। সব পক্ষের উচিত ইচ্ছাকৃত অন্ধত্ব পরিহার করে সামাজিক বাস্তবতার দিকে, এই ঘটনার মূল কারণের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। তা না হলে, দু’দিনের গলা ফাটানো আর চিকিৎসার মতো জরুরি পরিষেবা বন্ধ রেখে মানুষকে হয়রান করে কোনও ফল পাওয়া যাবে না, ভবিষ্যতে ইতিহাস আবারও নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।
শুভম রায়চৌধুরী
প্রবেশ প্রস্থান
মানুষের জীবন রক্ষার দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন ডাক্তারেরা, স্বেচ্ছায়। সেরার সেরা ছাত্রছাত্রীরা নানাবিধ কঠিন কঠিন পরীক্ষা সম্মানের সঙ্গে পাশ করে, ডাক্তারি পড়তে আসেন। কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কখনও স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে কোনও মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে চান না। এক জন ডাক্তার, যিনি মানুষকে নবজন্ম দান করার আদর্শ নিয়ে রোগীর সেবা করতে চান, তিনি কী ভাবে অবহেলায় এক জনের মৃত্যু তরান্বিত করবেন? এই ভাবনাটা আসে কোথা থেকে?
ডাক্তার নিগ্রহের যে ভয়ঙ্কর নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে প্রায় নিয়মিত ভাবে, তার একটা হেস্তনেস্ত করার সময় এ বার চলে এসেছে। প্রশাসনের দায় আছে সমাজের সেরা মানুষগুলোকে রক্ষা করার। ডাক্তার নিগ্রহের সঙ্গে যুক্ত এই বর্বরমানুষদের খুঁজে খুঁজে বার করে চরম শাস্তি দেওয়া হোক। যে কোনও হাসপাতালের চত্বরে প্রবেশ-প্রস্থানে দৃঢ় হাতে রাশ টানা হোক। রোগী ভর্তি করার সময় রোগীর সঙ্গে দু’জনের বেশি প্রবেশ করা নিষিদ্ধ হোক। ভর্তি রোগীর পরিজনের জন্য মাত্র দুটো কার্ড দেওয়া হোক, যা দেখিয়ে রোগীকে দেখতে তার বাড়ির লোক ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবেন। ক্যাম্পাসের ভেতরে যে কোনও অনধিকার প্রবেশকারীকে যেন সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। রোগীর ছুটির সময় বা রোগীর মৃত্যু হলেও, কার্ড দেখিয়েই দু’জনকে ঢুকতে হবে। কার্ড ফেরত না দিলে ডিসচার্জ বা ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হবে না।
পার্থসারথি নন্দী
শেওড়াফুলি, হুগলি
পরিকাঠামো
জুনিয়র ডাক্তারদের উপর পৈশাচিক আক্রমণে, সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তীব্র নিন্দা জানাবেই, দোষীদের শাস্তি চাইবেই।
পাশাপাশি এ কথা মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য পরিষেবায় উপযুক্ত পরিকাঠামো যত দিন না গড়ে উঠবে, তত দিন ডাক্তার-নার্স বনাম রোগীর এই দ্বন্দ্ব চলতেই থাকবে। যখন ১০ জন ডাক্তারের জায়গায় ২ জন ডাক্তার, আর ৬ জন নার্সের জায়গায় ১ জন নার্সের উপর সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে বাধ্য। রোগীদের আশানুরূপ যথার্থ পরিষেবা দান কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। জনসংখ্যার নিরিখে উপযুক্ত পরিকাঠামো-সহ অসংখ্য হাসপাতাল গড়ে উঠলে, বিশেষ হাসপাতালে রোগীর অসম্ভব ভিড় সামলানো যেত। তা না থাকায়, স্বাস্থ্য পরিষেবা আজ প্রশ্নের মুখে। রোগীদের ক্ষোভ গিয়ে আছড়ে পড়ছে ডাক্তার বা নার্সদের উপর। তার পরিণতিতে ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক আজ তলানিতে। এই পরিস্থিতির জন্য সামগ্রিক ভাবে স্বাস্থ্যপরিষেবা ভয়ঙ্কর ভাবে দায়ী। এই আসল দিকটির প্রতি আদৌ নজর দেওয়া হবে কি? না হলে কেবল দু’এক জন অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে এ সমস্যা মেটানো যাবে না।
কিংকর অধিকারী
বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
বহু কারণ
রোগীর মৃত্যুর জন্য চিকিৎসক দায়ী— এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে বা অন্য যে কোনও কারণে চিকিৎসককে মারা কোনও ভাবেই যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। তেমনই, গোটা রাজ্য জুড়ে চিকিৎসার মতো জরুরি পরিষেবা কোনও কারণেই বন্ধ রাখা যেতে পারে না। চিকিৎসক ও রোগীর এই রকম আচরণের জন্য হাসপাতালের পরিকাঠামো ও সামগ্রিক পরিচালন ব্যবস্থা অনেকাংশেই দায়ী।
না বলে উপায় নেই, চিকিৎসকেরা প্রায়শই রোগী ও তাঁর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে সুব্যবহার করেন না। যেমন, কথা না বলা, সময় না দেওয়া, প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া, সহানুভূতিশীল না হওয়া, প্রেসক্রিপশন বুঝিয়ে না দেওয়া, এক কথা দু’বার জানতে চাইলে বিরক্ত বোধ করা। সরকারি হাসপাতালগুলিতে অতি নগণ্য ফি-র বিনিময়ে (২ টাকা) বহির্বিভাগে রোগী দেখা হয়। অসংখ্য রোগী লাইন দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন ওপিডি কাউন্টারের সামনে, বিভিন্ন বিভাগের সামনে। হাসপাতাল চত্বর নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত। নেই কোনও প্রতীক্ষালয় বা বসার ব্যবস্থা। সারা হাসপাতাল লোকে লোকারণ্য— শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে। সব মিলিয়ে সরকারি হাসপাতাল, বিশেষ করে রাজ্য স্তরের হাসপাতালগুলি, যেন দুঃস্বপ্ন। বেসরকারি হাসপাতালগুলি যদিও পরিষ্কার পরিছন্ন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা যুক্ত, কিন্তু চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের ব্যবহার প্রায় সরকারি হাসপাতালেরই মতো। অনেক সময়ই রোগীদের ভর্তি নেওয়া হয় শুধু বিল বানানোর জন্য।
বেঁচে থাকার জন্য এক প্রাথমিক প্রয়োজন হল চিকিৎসা পরিষেবা। যা বিনা পয়সায় বা খুব কম খরচে সবার জন্য সহজলভ্য হওয়া উচিত। বিশেষ করে অতি গরিব শ্রেণির মানুষদের জন্য। সর্বোপরি, ওষুধ তৈরিকারী সংস্থাগুলি একটা ট্যাবলেট বানাতে এক টাকা খরচ হলে বিক্রি করে দশ টাকায়। চিকিৎসার মতো একটি অতিপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ব্যবস্থার এই দুর্দশা যত দিন থাকবে, তত দিন ভুল বোঝাবুঝি ও পারস্পরিক অবিশ্বাসজনিত কারণে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে তিক্ততা থাকবে। দুর্ঘটনা ঘটবে।
সমরেশ কুমার দাস
জালুকি, পেরেন, নাগাল্যান্ড
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy