প্রতীকী চিত্র।
‘কোন পথে’ (সম্পাদকীয়, ১০-১০) নিবন্ধের সূচনায় মনে হতে পারে, এত দিনে তবে বাজার অর্থনীতির পক্ষে সওয়ালকারীদের বোধোদয় ঘটেছে। করোনার অতিমারি রূপ পরিগ্রহের পিছনে যে রয়েছে ব্যক্তিস্বাস্থ্যের প্রাধান্য, স্বাস্থ্যমাফিয়াদের মুনাফা লোলুপতা, তা আজ অস্বীকার করা কঠিন। শক্তিধর দেশগুলির মুখ থুবড়ে পড়া যেন মনে করিয়ে দেয় সেই প্রবাদ, ‘আমার সৃষ্ট দানব আজ আমাকেই খাইতে আসে।’ তবে বাজার অর্থনীতির ধারক-বাহকরা অত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন। উনিশ শতকের মধ্যভাগে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘‘ইউরোপ কমিউনিজ়মের ভূত দেখছে।’’ সেই ভূত আজ করোনা আবহে এঁদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাই তাঁরা বলছেন, সমস্যা সমাধানের নিদান সমাজতন্ত্র নয়, ‘দায়িত্বশীল ধনতন্ত্র’।
পুঁজির মালিক পুঁজি খাটায় কোন লক্ষ্যে? নিজের মুনাফা, না কি জনসেবা? কেন মানুষ অনাহারে, অথচ গুদামে খাদ্য পচছে? ‘‘ধনতন্ত্রকে রাষ্ট্র দায়িত্বশীল করে তুলবে’’— এ যেন ছাগল সামনে রেখে বাঘকে দেখভাল করার উপদেশ। মার্ক্স তাঁর উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বে দেখিয়েছিলেন, পুঁজিপতির অতিরিক্ত সম্পদের রহস্য শ্রমিকের প্রাপ্য মূল্যের বঞ্চনায়। যে ধনতন্ত্র সমাজ-সভ্যতা-বিজ্ঞান সমস্ত কিছু বিকাশের অন্তরায়ে উপনীত, তাকে আঁকড়ে বিপত্তারণের ব্যর্থ চেষ্টা কেন?
জয়ন্ত সাহা
স্বরূপনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
দুর্বলতা
যে কোনও প্রতিষ্ঠানে বিত্ত আধিকারিক (ফাইনান্স অফিসার) পদটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বভারতী এর ব্যতিক্রম নয়। আয়ব্যয়ের হিসেব, বার্ষিক বাজেট তদারকি, উন্নয়নের ব্যয়ে নজরদারি, অপচয় বন্ধ প্রভৃতি দায়িত্ব ছাড়াও বিশ্বভারতী আইন, ১৯৫১ আরও দু’টি দায়িত্ব দিয়েছে বিত্ত আধিকারিকের উপর— নির্মিত ভবন, জমি, আসবাব, যন্ত্রাদির তালিকা রক্ষা ও সংশোধন করা, এবং কোথাও কোনও আর্থিক দুর্নীতি দেখলে তা উপাচার্যের নজরে আনা।
১৯৭৫ সালে বিশ্বভারতীর মূল্যায়নে সরকার বিচারপতি মাসুদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি চেয়েছিল যে, ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস থেকে যোগ্য অফিসারকে যেন এই পদে আনা হয়। এই ব্যবস্থা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। বিশ্বভারতীতেও যোগ্যতাসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু গত প্রায় তিন বছর এই পদে অস্থায়ী ভাবে কিছু অধ্যাপককে দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। এমন ব্যবস্থার ফলে কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছে। যেমন, ২০১৫-১৬ সালের পর ‘ফিনানশিয়াল স্টেটমেন্ট’ তৈরি হয়নি। এ ছাড়া, প্রতিষ্ঠানের কোনও ‘অ্যাসেট রেজিস্টার’ নেই। অনেক সম্পত্তির বিমা নেই। ২০১৫-১৬ সালের ফিনানশিয়াল রিপোর্ট-এর শেষের দিকে উল্লিখিত হয়েছে, শুভানুধ্যায়ী ও প্রাক্তনীদের অনুদানে বিশ্বভারতীতে বহু ‘এনডাওমেন্ট ফান্ড’ রয়েছে, যাতে বেশ কয়েক কোটি টাকা রয়েছে। যে টাকা থেকে অনেক ছাত্রছাত্রী আর্থিক অনুদান পেতেন, তা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এটি বাঞ্ছনীয় নয়। এক সুযোগ্য বিত্ত আধিকারিক থাকলে তিনি অবহেলা ও অপচয় রোধ করতে পারতেন। অবিলম্বে সাংগঠনিক দুর্বলতার প্রতিকার করা উচিত।
সুনন্দ রায়
পাঠভবন ও বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্র
রণক্ষেত্র নয়
আমরা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বভারতীতে পড়েছি, পড়িয়েছি অথবা কর্মসূত্রে জড়িত ছিলাম দীর্ঘ কাল। রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শ ও শিক্ষাচিন্তায় পালিত হয়ে বর্তমানে বিশ্বভারতীর প্রশাসনিক কার্যকলাপ আমাদের বিশেষ উদ্বিগ্ন ও বিচলিত করছে। দেশবাসীর সঙ্গে আমরা তা ভাগ করে নিতে চাই। বিশ্বভারতীর প্রাণকেন্দ্র হল ছাত্রছাত্রীরা। মুক্ত পরিবেশে অধ্যয়ন ও গবেষণা, অধ্যাপকদের সঙ্গে স্বাধীন ভাবে আদানপ্রদান, একটি সহজ সামাজিক চেতনা ও দায়িত্ববোধ এখানকার শিক্ষার মূল কথা। গত কয়েক বছর ধরে এর ক্রমশ অবনতি ঘটছে। অধ্যয়ন ও পঠনপাঠনের কায়িক আড়ম্বর বেড়েছে সন্দেহ নেই। অনেক আধুনিক ঘরবাড়ি নির্মিত হয়ে খালি পড়ে আছে। অপর দিকে, আমাদের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাড়িগুলি, যা সুরেন্দ্রনাথ কর, রথীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত স্থাপত্যরীতির পরিচায়ক, সে সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
পিয়ারসন হাসপাতালে আইসিইউ-এর অভাবে আমরা অনেক আশ্রমিককে অকালে হারিয়েছি। ডাক্তাররা হাসপাতালের আধুনিকীকরণের পক্ষে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা ও তার তাৎক্ষণিক নিয়োগের অভাবে এই অবাঞ্ছিত বিলম্ব। ছাত্রদের আবাসগুলির সংস্কারের আশু প্রয়োজন। তাদের বৃত্তি যাতে নিয়মিত হাতে আসে তার ব্যবস্থা একান্ত জরুরি। অনেক ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া এই বৃত্তির উপর নির্ভর করে।বিশ্বভারতীর ২০১৮-১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ৫ নম্বর পাতায় আমরা অব্যবহৃত তহবিলের (আনস্পেন্ট ব্যালান্স) কথা জানতে পারি। অডিটর জানাচ্ছেন যে, এই টাকার পরিমাণ হল ১৯৫ কোটি টাকা। এই অর্থের ব্যবহার করে ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দেওয়া যেতে পারে। ভর্তির টাকার অঙ্ক না বাড়িয়ে তাদের সাহায্য করা যেতে পারে। দু’টি ঘটনা বিশেষ লক্ষণীয়। প্রথমটি হল, বিশ্বভারতীর উপাসনা মন্দিরের সংস্কারকার্যের জন্য উপাচার্যের প্রাক্তনীদের প্রতি অর্থসাহায্যের আহ্বান (এর বৈধতা ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে আরও তথ্য দরকার, এই আমাদের অভিমত)।দ্বিতীয়টি হল, গত ২৫ সেপ্টেম্বর, বিশ্বভারতীর জারি করা একটি ‘টেন্ডর’। কোনও বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে বিশ্বভারতীর চুক্তি অনুযায়ী ১৬ পৃষ্ঠার ২০ নম্বর স্তবকে ‘ডবল/সিঙ্গল ব্যারেল গান’, ‘পাম্প অ্যাকশন গান’-এর বর্ণনা ও বিশেষ পরিস্থিতিতে ব্যবহারের বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী, ২৭১ জনের একটি দল আসবেন। তাঁদের দক্ষিণা দৈনিক ২ লক্ষ টাকা, মাসিক খরচ ৬০ লক্ষ টাকা।
উপাসনা মন্দিরের জন্য অর্থ সাহায্য চাওয়া হয়েছে, প্রায় একই সময়ে সেপ্টেম্বর মাসেই ৫০ লক্ষ টাকার বেশি মূল্যের ‘টেন্ডর’ দেওয়া হয়েছে শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচিল নির্মাণের জন্য। কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করা হবে ও তারই সঙ্গে এই সশস্ত্র বাহিনীর নিয়োগের ব্যবস্থা চলেছে।ইদানীং বিশ্বভারতীর কোনও অনুষ্ঠানে বা পাঁচিল-সংক্রান্ত আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকলে শোনা যায় বিশ্বভারতীর অর্থ সঙ্কটের কথা। মনে হয়, অর্থ সম্পর্কে এক ভীতি ও ত্রাসের জন্ম হচ্ছে। অর্থভিক্ষা ও তার সঙ্গে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে, বিশ্বভারতীর জমি বেদখল হওয়ার বিবৃতি দিয়ে জেলখানার মতো প্রায় ১০ ফুট উঁচু পাঁচিল উঠছে যত্রতত্র, অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকার পথ বন্ধ করে। এ এক পরস্পর-বিরোধী কর্মপদ্ধতি, যা সম্পূর্ণত রবীন্দ্রনাথের মুক্ত জীবনদর্শনের বিপরীতগামী এক যুক্তিহীন, কুরুচিপূর্ণ ও ভয়াবহ মানসিকতার পরিচায়ক। বিশ্বভারতী সারা দেশ ও বিদেশের সম্পদ। এক সার্বভৌম সাংস্কৃতিক চেতনায়, সামাজিক দায়বদ্ধতায়, ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত জীবনানন্দে, ইতিহাস বোধে ও ঐতিহ্য রক্ষায়, সর্বোপরি, শালীনতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বাক্যে ও সুস্থ আচরণে এ সম্পদ শুধুমাত্র বস্তুগত বা জমির মালিকানার অনেক বেশি। বিশ্বভারতীর উপাচার্য তো কোনও দেবোত্তর সম্পত্তির ‘নায়েবমশাই’ নন। তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন একটি বিশিষ্ট বিদ্যায়তনের, যার মূল মন্ত্র পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও শান্তিপূর্ণ মানবিকতা। এ মন্ত্র রাজনৈতিক বিবাদের ও গোষ্ঠীগত সংঘর্ষের সীমিত গণ্ডির অনেক ঊর্ধ্বে। তাঁর দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।এই মহামারি-জনিত দুঃসময়ে ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিশ্বভারতীর একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। বিশ্বভারতীকে রণক্ষেত্র বানানোর এই পরিকল্পনা অবিলম্বে বন্ধ হোক।
আলো রায়, কল্পিকা মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিয় ঠাকুর, উমা সেন, সুজিত চট্টোপাধ্যায়, চিত্রা সিংহ, সুনন্দ রায়, আনন্দরূপ রায়, জয়িতা চক্রবর্তী, শ্রীলা চট্টোপাধ্যায়, চন্দনা সেন সরকার, তাপস বসু, জনক ঝংকার নারজারী, শর্মিলা রায় পোমো, মালবিকা গুহ, শান্তভানু সেন, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, দেবযানী সেনগুপ্ত, মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
শান্তিনিকেতন, বীরভূম
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy