টালা ব্রিজ।
৩১ জানুয়ারি ২০২০, অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। প্রায় রাত ন’টা। ব্যারাকপুরের ব্রিজ পেরিয়ে যখন টালা ব্রিজে পড়লাম, দেখলাম বড় বড় সব মেশিন হাজির। হঠাৎ মনে পড়ল, কাল থেকে তো এটা আর রুট হবে না। টালা ব্রিজ ভাঙা পড়বে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। গাড়িটা সাইডে দাঁড় করিয়ে নেমে পড়লাম। অনেক কথা মনে পড়ে গেল।
এই ব্রিজের পাশেই কালী কুমার ব্যানার্জি লেনে আমার বাড়ি ছিল, যদিও এখন বরাহনগরে থাকি। ছোট থেকে বড় হওয়া এই ব্রিজকে ঘিরেই। ছোটবেলায় কেউ যদি জিজ্ঞেস করত কোথায় থাকো, এক কথায় উত্তর দিতাম, টালা ব্রিজের কাছে। ব্যস, আমার মনে হত, আমার ঠিকানা সবাই চিনে গেল। স্কুলে যাওয়া বা ঘুরতে যাওয়ার জন্য বাস ধরতে টালা ব্রিজের বাসস্ট্যান্ডেই এসে দাঁড়াতাম। মা’র অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলেও, সেই বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াতাম। বাড়িতে কোনও গেস্ট এলে, তাঁকে বাসে তুলে দিতে ছাড়তে সেই টালা ব্রিজে। ট্যাক্সি ডাকতে হলে, যাও টালা ব্রিজে। জায়গাটা মনে হত খুব নিজের।
পরে যখন চলে গেলাম অন্য জায়গায়, খুব মন খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু যেতে-আসতে টালা ব্রিজ পেরোলেই মনে হত, নিজের জায়গায় এসে পড়েছি। মাধ্যমিকের রেজ়াল্ট নিয়ে বাড়ি ফিরেছি টালা ব্রিজ দিয়ে, প্রথম চাকরি পেয়ে মা’র কাছে গিয়েছি, প্রথম গাড়ি কিনে তাতে চড়ে বাড়ি ফিরেছি টালা ব্রিজ দিয়েই।
এক বার বরাহনগর থেকে ট্যাক্সি করে রবীন্দ্র সদনের দিকে যাচ্ছি, ট্যাক্সি ড্রাইভার বললেন, দাদা কাশীপুর রোড ধরে নিই, তাড়াতাড়ি হবে। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, না, টালা ব্রিজ দিয়ে চলুন। টালা ব্রিজ ধরতেই, পিছনে বসেই বলে দিচ্ছিলাম, এই জায়গাটা ডান দিক চেপে নিন গর্ত আছে, বা ওই জায়গাটা একটু আস্তে চালান, উঁচু হয়ে আছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। উনি বুঝবেন কী করে, টালা ব্রিজের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা।
ওখানে কত ক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই, হঠাৎ মনে হল মা’কে তো শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিলাম এই টালা ব্রিজ ধরেই। ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠলাম, মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে গেলাম টালা ব্রিজকে, এতটা পথ সঙ্গে থাকার জন্য। আর বলে গেলাম, অপেক্ষায় রইলাম তোমার নতুন রূপের জন্য, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
প্রশান্ত সর্দার
বরাহনগর
কাজের সুযোগ
‘রাজনৈতিক সমীক্ষা’ (১-২) শীর্ষক সম্পাদকীয় আরও উদ্বিগ্ন করে তুলবে ভারতের কর্মপ্রার্থী বিশাল শ্রমজগৎকে। আমার বন্ধুর মেয়ে প্রথাগত শিক্ষায় সদ্য ফিজ়িক্স অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করল। প্রথাবহির্ভূত শখের নাটকে অভিনয় রপ্ত করেছে। এ বার? উত্তর: ‘চাকরি’ করবে। অর্থাৎ চাকরির জন্য আলাদা করে পড়াশোনা। ফিজ়িক্স অপদার্থ হয়ে গেল। অভিনয়ের জগতে ভরসা নেই। অতএব এখন জেনারেল অ্যাওয়ারনেস, ইতিহাস, ইংরেজির টোটকা গলাধঃকরণ করবে। মাস্টার্স, গবেষণার মাধ্যমে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা বলতে গিয়ে গিলে ফেললাম।
সম্পাদকীয়ে লেখা হয়েছে, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ছিল, ‘‘ক্ষমতায় এলে প্রতি বছর গড়ে ২ কোটি কাজের সুযোগ তৈরি করবে সরকার।’’ লক্ষণীয়, ‘চাকরি’ নয়, ‘কাজের সুযোগ’। অধিকাংশ মানুষ কেমন ‘কাজের সুযোগ পান? অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য অস্থায়ী পারিশ্রমিক, যার শ্রমশর্তগুলো অস্পষ্ট। নিয়মিত বেতন, বিমা, পিএফ, চিকিৎসা ভাতা, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেই। নেই আট ঘণ্টা শ্রমের পর অন্তত কিছু সময় সৃষ্টিশীল অবকাশ। নেই সুস্থ দক্ষতা, স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা, অন্তত ষাট বছর বয়স অবধি স্থায়িত্ব। ৫০ বছর আগে রাজ্য সরকার, কেন্দ্র সরকারে উৎপাদন, পরিষেবা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে ‘চাকরি’ ছিল। ধীরে ধীরে সব বেসরকারি হয়ে যাচ্ছে, যা পছন্দ করছে সাময়িক চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক। জাতীয় ন্যূনতম বেতন আশা করা হয়েছিল দিনে ৩৭৫ টাকা। কিন্তু ১৭৬ টাকা ২ টাকা বেড়ে হল ১৭৮ টাকা। বন্ধুকন্যা নিশ্চয় দেখেছে, মাসিক ন্যূনতম বেতন ১৮,০০০ টাকার দাবিকে অবহেলায় সরিয়ে রেখেছে এই ‘কাজের সুযোগ’।
শ্রম-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনের সংস্কার শুরু হয়েছে। শিল্প সম্পর্কীয় কোড বিলে ৪৪টি শ্রম আইনের খোলনলচে বদলে তৈরি হয়েছে চারটি শ্রম কোড। বিরোধীদের অভিযোগ: স্থায়ী চাকরি বিলোপ, অবাধ ছাঁটাই ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রম আইনে কর্মসংস্থান সংক্রান্ত যে অধিকার ও সুযোগ রয়েছে, তা অনেকটাই খর্ব করে, কার্যত আন্তর্জাতিক
শ্রম সংগঠনের (আইএলও)
নির্দেশ লঙ্ঘন করা হচ্ছে। বন্ধুকন্যা এই বিষয় নিশ্চয় পড়বে ‘কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স’ বলে ।
সে তো পড়েছে ভারতের ‘জবলেস গ্রোথ’-এর বিষয়ে। বন্ধুদের মুখে নিশ্চয় শুনেছে ঝাঁ-চকচকে ইন্ডিয়ার গুরুগ্রামে তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরের বাইরে স্থানীয় দোকান-বাজারের কথা, যেখানে বিক্রেতা বাড়ছে অথচ ক্রেতা কমছে। গুরুগ্রামের বাইরে ভারতে গত ৪৫ বছরে বেকার সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের সঙ্গে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-এর হিসেব মিলছে না। জবলেস গ্রোথ না গ্রোথলেস জব?
দক্ষ কারিগর, প্রশিক্ষিত নবিশ, শিক্ষিত কর্মপ্রার্থী ইত্যাদিরা বেঁচে থাকার জন্য, যে কাজ হাতের কাছে পাচ্ছেন তা-ই করছেন। রাস্তায় এত টোটো-অটো যে সওয়ারি চাপা পড়ে যাচ্ছেন। ফুটপাতে গায়ে-গায়ে এত দোকান যে ক্রেতাই চলতে পারছেন না। খুচরো বাজার এত ছড়িয়ে পড়েছে যে বাজার বলে নির্দিষ্ট জায়গা ভুলে যাচ্ছেন মানুষ। এখন বাড়ি বাড়ি সব ফেরি করছে আধুনিক ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা। নির্দিষ্ট ক্রেতার পিছু অজস্র বিক্রেতা। বিনোদন, বিজ্ঞাপনের জগৎ মিথ রচনা করছে। কেউ বলছেন চা বিক্রি করতে, কেউ বলছেন তেলেভাজা, চপ বেচতে। বিক্রি না-হওয়া চা-চপ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শ্রমের সুরক্ষা, উপযুক্ত পরিবেশ, ন্যায্য মজুরি, সুস্থ অবকাশের জন্য দর-কষাকষির সুযোগ ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ‘কালেক্টিভ বার্গেনিং’ ইতিহাস হতে চলেছে। আজ সুযোগ পেলে আছো, মারাত্মক প্রতিযোগিতার বাজারে কাল হয়তো নেই। মাস-মাইনে নয়, ‘থাউকো’, আধুনিক ভাষার মোড়কে: ‘প্যাকেজ’। যেখানে শ্রমিক সর্বদা আতঙ্কে থাকে, শ্রমিকের সঙ্গে উৎপাদন প্রক্রিয়ার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না, সেখানে পণ্যের উৎকর্ষ থাকতে পারে না, থাকছেও না।
এ জন্যই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এখন গালভরা স্লোগান মাত্র। রফতানি কম, আমদানি বেশির অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারত পিছিয়ে। ‘অ্যাসেম্বল ইন ইন্ডিয়া’ দিয়ে পরিষেবা ক্ষেত্রে আফটার-সেলস-সার্ভিস হতে পারে মাত্র। দু’মাসের বেতন বকেয়া রেখে ৭৮ হাজারেরও বেশি কর্মী-আধিকারিককে স্বেচ্ছাবসর দিল বিএসএনএল। শোনা যাচ্ছে এই সব পদে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ‘কাজের সুযোগ’ করে দেওয়ার চেষ্টা হবে!
শুভ্রাংশু কুমার রায়
ফটকগোড়া, হুগলি
সেই দোকান
‘সরকারি জমি থেকে সরবে দোকান’ (১-২) শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশ, কামালগাজি থেকে বারুইপুর পর্যন্ত সাদার্ন বাইপাসের সৌন্দর্যায়নের জন্যে সরানো হবে রাস্তার ধারে গজিয়ে ওঠা বেআইনি দোকানগুলো। দোকান-মালিকেরা পুনর্বাসনের দাবি তুলেছেন। সে প্রসঙ্গে বারুইপুর (পশ্চিম) বিধানসভার বিধায়ক বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘সরকারি জায়গায় বেআইনি ভাবে যে যার মতো দোকান বসিয়েছেন। নিজের প্রয়োজনে সরকার তো জমি ব্যবহার করবেই। এর মধ্যে পুনর্বাসনের কোনও প্রশ্ন নেই।’’ তাঁর এই মন্তব্য একদমই ঠিক। তবে একটা প্রশ্ন আছে। যে সমস্ত বেআইনি দোকান গোটা শহরের ফুটপাত (সেটাও সরকারি জায়গা) দখল করে পথচারীদের উপর চরম দুর্ভোগ চাপিয়ে দিয়েছে, এই নিয়ম কি সেই বেআইনি দখলদারদের উপর প্রযোজ্য নয়? রাজধর্ম এ কথা বলে না।
সুরজিত সাহা
কলকাতা-৩৩
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy