সরাসরি না হলেও, ‘করোনা-আক্রান্ত‘ আমরা সবাই—ছবি:রয়টার্স
জানুয়ারির মধ্য সপ্তাহ। ক্লাসে আছি। আমার সহকারী আলজেরিয়ান। ‘প্লেগ’ উপন্যাস রচয়িতা অ্যালবার্ট কামু-র দেশের।
সে ইংরেজি, ফরাসি ও আরবীয় ভাষা জানে । এবং সারা বিশ্বের সব ‘খবরের চ্যানেল’ শোনে ও আমায় শোনায়। যেমন, ভারতের ‘এনআরসি‘ নিয়ে আরবীয় চ্যানেলের নিউজ শুনে, সে আমায় তাঁর ‘অসন্তোষ’ জানিয়ে যায়।
সেদিন একটি আরবীয় চ্যানেলে, চিন থেকে আপলোড করা একটি ভিডিয়ো ক্লিপ দেখিয়ে সে জানাল যে, একটি ভয়ঙ্কর রোগ চিনে এসেছে। ক্লিপিংস-এ দেখলাম, একটা দরজার সামনে দন্ডায়মান একটি লোক, ঠাস করে সামনে পড়ে গেল। রিওয়াইন্ড করে কয়েক বার সেই ভিডিয়োটি দেখলাম। তাতে বলা হয়েছে যে ইমিউনিটি শক্তপোক্ত না করে রাখলে, ফুসফুস-কুপোকাত হবার সম্ভাবনা বেশি। এ ভাবে রোজই আমায় চিনের আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধির পরিসংখ্যান জানায়। এখন যেমন আমরা সারা বিশ্বের ক্ষতির খতিয়ানের হিসেবে রাখছি। আমি খবরের সারাংশ কানে ঢুকিয়ে, তার আশংকাকে অমূলক ঠাউরে, অবজ্ঞা করি।
এর বেশ ক’দিন পর, আমরা একটু একটু করে ‘করোনা-শিক্ষিত’ হচ্ছি। যদিও কিছু বিখ্যাত চ্যানেল আমাদের আশ্বস্ত করে যাচ্ছিল যে-- এটি ‘ফ্লু-কেবলম্’। আমার সেই আলজেরিয়ান সহকর্মীর হাঁপের ব্যামো। তাঁর আবার কোন স্বাস্থ্যবীমা না থাকায় মাঝে মধ্যেই দরজা খুলে শ্বাস নেয়। তাই, বাস্তববুদ্ধি অনুসরণ করে আমার মুখে ওঠে মাস্ক।
সদ্য জুলাই মাসেই চিন হয়ে মানস-কৈলাস-তিব্বত গিয়েছি। চিনের ’দূষণ-দুর্নামে’ বেশির ভাগ মানুষই সারা বছর মাস্ক পরে থাকে। চিন-ট্যুর গাইডের আবশ্যিক নির্দেশ মেনে চলার ফলে বেশ কটি মাস্ক, সফরশেষেও বাড়িতে পড়েছিল। সেটাই তখন দুর্বল মনের দুর্গ।
যাঁরা এই আক্রমণ থেকে বাঁচাতে এগোচ্ছেন, সেই ‘ফ্রন্টলাইনার’-রাও শিকার হচ্ছেন আক্রমণের—ছবি:রয়টার্স
তখন আমেরিকার কোথাও একটিও ‘করোনা-কেস’ নেই। সরকার তরফে কোন সতর্কীকরণের প্রশ্নই নেই। সহকর্মীদের ঠাট্টার পাত্র হলাম ক’দিন। ছাত্র-অভিভাবকদের চোখে বিস্ময় এবং কর্তৃপক্ষ ক’দিন পর, মৃদু অসম্মতি জানালেন।
স্বামীর দেশে যাবার কথা ফেব্রুয়ারির তেরো তারিখ। আটলান্টায় ৯ ফেব্রুয়ারি, ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি ‘শুভ মহরৎ’ -এর উপস্থাপনার কাজে রয়েছি। হঠাৎ কর্তার ফোন। তত দিনে বিমানবন্দরে ‘চেকিং’ শুরু হয়েছে এবং চাকরিসূত্রে যাঁদের প্রায়ই সফর করতে হয়, তাঁরা মাস্ক পরতে শুরু করায়, আমায় এই অনুষ্ঠানের মাঝে জরুরি তলব। ফুলটন কাউন্টি-র কোথাও তিনি মাস্ক পাচ্ছেন না। তাই আমি যেহেতু ফোরসাইথ কাউন্টিতে রয়েছি, সে দিকের দোকানগুলো-তে যাতে ফিরতি পথে মাস্কের খোঁজ করি।
আমিও মাস্ক পেলাম না। আমাজনে অর্ডার দেওয়া হল। মাস্ক বাড়ি এসে পৌঁছতে পৌঁছতে, তিনি কলকাতায় পৌঁছে গেলেন। ফিরলেন ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ। তত দিনে করোনা আমেরিকায় যে দাঁত বসিয়েছে, সেটা সকলের বোধগম্য হতে শুরু করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর আমেরিকায় একই দিনে, প্রকাশ্যে এল প্রথম ‘করোনা-কীর্তি’।
অতি সত্বরই পূর্ব পশ্চিমের দুই ওয়াশিংটন-ই করোনার বিচরণক্ষেত্র । আর কলকাতা থেকে ফিরেই মার্চের প্রথম সপ্তাহে, ওয়াশিংটনের লাগোয়া ভার্জিনিয়াতে স্বামীর ট্যুর। তত দিনে আমাদের পরিচিত কিছু সফ্টওয়্যার সংস্থা সফর বন্ধ করে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ চালু করে দিলেও, তাঁর সংস্থা অনড়। আমার আলজেরিয়ান সহকর্মী শুনে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। এতদিনের বন্ধু, তায় আমার অধস্তন। তবু তাঁর উহ্য নাক সিঁটকানো উপেক্ষা করে সপ্তাহটি টেনে দিতে হল।
স্বামীর ফেরার পরের সপ্তাহ থেকেই ভার্জিনিয়ায় ‘লকডাউন’ হয়ে গেল। এর পরের দু সপ্তাহ ভয়ে কাঁটা হয়েছিলাম। এমনকি, গ্লাভস-মাস্ক পরে রাতে ঘুমিয়েওছি!
তত দিনে বুঝেছি, যে দেশ-নির্বিশেষে আক্রমণের ব্যাপারে করোনার ‘সাম্যবাদ’ স্পষ্ট। কিন্তু আক্রমণের বহরে কেউ ‘কাত’, আবার কেউ বা দিব্যি ‘মাত’। সেখানেই তার ভয়াবহতা। তাই সরাসরি না হলেও, ‘করোনা-আক্রান্ত‘ আমরা সবাই।
বাতিল করলাম আমার দেশের জন্য কাটা ‘আয়, খুকু আয়’ বিমান টিকিট। এই মূহুর্তে দেশে গেলে ‘মাসি পিসি বঙ্গবাসী’ পর্যন্ত বলবে, ‘ওঁকে ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছিঃ’!
মার্চের ৮ তারিখ, সেই শুক্রবারই আমার শেষ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা। তারপর তো এখন চলচ্চিত্রের মতো তাঁদের রকমসকম দেখি, নব্য কানাইমাস্টারের ভূমিকায়। কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়েছেন যে ‘এন্ড অব দ্য স্কুল ইয়ার উদযাপন’ সারতে হবে ভার্চুয়ালি। ‘জুম’ বা ‘হ্যাংআউট‘ তো ‘কোরাস-অপারগ’। ‘হুক্কা হুয়া’ শোনালেও সরকারি নির্দেশ শিরোধার্য করা বিকল্পহীন।
এরপর সব ইতিহাস। এক একটি স্কুল কলেজ ‘বন্ধ’ হতে হতে, অবশেষে জীবনেই ‘তালাচাবি’ পড়ে গেল। আজ সরকারিভাবে তালাচাবি খোলার উদ্যোগ দেখা দিলেও, জনগণের নিস্তেজ ও সচেতন ‘টু-ইন-ওয়ান’ মন, ‘মুক্তি’-তে সাড়া দিচ্ছে না। কারণ কোনও ‘রক্ষাকবচ’ এখনও দূর অস্ত।
বিশ্বের গবেষণাগারগুলি ‘বিশল্যকরণী’-র সন্ধানে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। যাঁরা এই আক্রমণ থেকে বাঁচাতে এগোচ্ছেন, সেই ‘ফ্রন্টলাইনার’-রাও শিকার হচ্ছেন আক্রমণের। এ যেন জলে ডুবন্ত কাউকে বাঁচানোর জন্য বিশেষ ’শৈলী’ জানা দরকার। নতুবা দু’জনেরই মৃত্যু অনিবার্য।
এরপরের টুকরো খবর : ‘আমাজন’, ‘হোলফুড’, ‘ক্রোগার’ এই দোকানগুলোয় চার সপ্তাহ জুডে ময়দা অদৃশ্য। বস্টনে ‘চাল’, ক্যালিফোর্নিয়াতে ‘নুন’ এবং আমাজনে ‘ময়দা’-র আকাল দেখা দিয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির হিসেবের মতো, কড়া হিসেবে, সরকারকে সামলাতে হচ্ছে বাজেট।
এরই মধ্যে চলছে ‘নাই নাই ভয়,” করোনা “হবে জয়’ —এর ক্যাম্পেইন। ‘আগে কে বা প্রাণ, করিবেক দান’-এর সুইসাইডাল আহ্বান। এখন মরণরূপী শ্যাম ‘করোনা’-কে ‘লাগ যা গলে’ বলে ঝুলে পড়ি আর কি!
কাকেই আর দোষ দেওয়া যায় ? সময়টি যখন উন্মাদ, তখন মানুষ প্রলাপ বকবে - তাতে আর আশ্চর্য কী ?
করোনাগ্রাফ এখনও সুবিধেজনক নয়। তার চলন বোঝা দায়। প্রত্যেকটি দিনই উচাটনে মোড়া। বন্দিত্ব-ই প্রাণরক্ষার মুক্তি মন্ত্র —এও কি কেউ ভেবেছিল কখনও ! যখন মানুষ একমাত্র বিকল্প হিসেবে নিজেকে গৃহবন্দি রেখে, অন্যান্য আতঙ্ক থেকে নিস্তার খুঁজছে, তখন রাজনৈতিক নেতারা পাল্লায় মাপছেন ‘স্বাস্থ্য’ নাকি ‘অর্থনীতি’!
সারা বিশ্বকে একসঙ্গে সমব্যথী করতে সক্ষম হয়েছে ‘করোনা’। ‘প্রবাসী’, ‘অনাবাসী’, ‘দেশি’ এবং ‘অভিবাসী’ নির্বিশেষে, সব বাঙালি যেমন একসঙ্গে ‘দুগ্গাপুজোয়’ হাসে, তেমনই ‘করোনায়’ কাঁদে।
কী ভয়াবহ একা ও নিঃশব্দ করে দিয়ে গেল আমাদের করোনা। শঙ্কা হয় দেখে যে, করোনা অবসানকালে অভাব ও অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাবার ভয়ে, শান্তশিষ্ট মধ্যবিত্ত ভেতো বাঙালিও বাড়িতে বন্দুক রাখার কথা ভাবছে। তাই সমবেত বিবেকের গান গাইতেই হয়, ‘‘ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে।’’
করোনা, ‘কেওস’ ও ‘কোরাস’ দুই-ই বটে। এমন একটি ভয়াবহ ‘কেওস’ লড়তে, সমগ্র বিশ্বস্বর যেন একটি ‘ট্র্যাজিক কোরাস’।
শুভশ্রী নন্দী, আটলান্টা
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy