শান্তনু দত্ত চৌধুরী তাঁর চিঠিতে (‘নেহরু ও সুভাষ’, ৩০-১০) বলেছেন, জওহরলাল নেহরু সুভাষচন্দ্র বসুকে তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম সহযোদ্ধা মনে করতেন। তাঁদের মধ্যে স্নেহের সম্পর্ক ছিল— অন্তত নেহরু সে কথা বলেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসও কি তা-ই বলে? গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে এই দুই তরুণ নেতা দেশে বিপুল জনপ্রিয় ছিলেন, ব্যক্তিগত ভাবেও তাঁরা কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই সুসময় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ, তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলেন। বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৩৯-এর জানুয়ারিতে, কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনে, যেখানে সুভাষ দলের সভাপতিত্বের জন্য গান্ধী সমর্থিত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়ার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই মহারণে সুভাষ নেহরুর সমর্থন আশা করলেও তা পাননি। নেহরুর ভূমিকায় সুভাষ বিশেষ ক্ষুব্ধ হন, ভ্রাতুষ্পুত্র অমিয়নাথকে এক চিঠিতে তিনি খোলাখুলি লেখেন, তাঁর বিরুদ্ধে নেহরুর প্রচার তাঁর যতটা ক্ষতি করেছে, অত আর কেউ করেনি। স্পষ্ট যে, মতভেদ রাজনৈতিক থেকে ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে। সাত মাস পরে সুভাষকে লেখা শেষ চিঠিতে নেহরু বলেন, “আমি দুঃখিত যে আমাকে বুঝতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে। হয়তো চেষ্টা করার মানে হয় না” (নেহরু অ্যান্ড বোস: প্যারালাল লাইভস, রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়)। এই কথাগুলো ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ বলা যায় কি?
যদিও ত্রিপুরীর ঘটনার দু’দশক পরে এক বিদেশি সাংবাদিকের কাছে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নেহরু বলেন, “ইট ইজ় ট্রু, আই ডিড লেট সুভাষ ডাউন” (রিপোর্টিং ইন্ডিয়া, তারা জ়িনকিন, ১৯৬২)। ১৯৪২-এর এপ্রিলে নেহরু বলেন, সুভাষ জাপানিদের নিয়ে ভারতে ঢুকলে তিনি নিজে গিয়ে যুদ্ধ করবেন। অথচ, পরে এই অবস্থানের বিপরীতে চলে যান। আজ়াদ হিন্দ সেনানীদের বিচারের সময়ে তিনি নিজে আইনজীবীর গাউন পরে তাঁদের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। মনে রাখতে হবে, সে সময় আজ়াদ হিন্দের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, সংযুক্ত প্রদেশের রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রিপোর্ট দিচ্ছেন যে, তখন সুভাষ গান্ধীজির থেকেও জনপ্রিয়। সামনে দেশব্যাপী গণপরিষদের নির্বাচন। সে সময়ে নেহরু ভোটের জন্য এক জন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের ভূমিকায় নেমেছিলেন। আজ়াদ হিন্দ-এর প্রতি তিনি প্রকৃত শ্রদ্ধাশীল হলে প্রতুল গুপ্তের লেখা ইতিহাস আজও অপ্রকাশিত থাকত না। ইতিহাসের খাতিরেই নিরপেক্ষ মূল্যায়ন দরকার।
দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৩৩
ইতিহাসের সাক্ষ্য
শান্তনু দত্ত চৌধুরীর চিঠির প্রসঙ্গে বলতে চাই, গান্ধী, নেহরু ও সুভাষ বসুর পারস্পরিক সম্পর্ক অজানা নয়। গান্ধী ও নেহরু নিজেদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বজায় রাখতে ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে সুভাষকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও সুভাষ আজীবন গান্ধীজির প্রতি সশ্রদ্ধ মনোভাব রেখে গিয়েছেন। সুভাষের সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের পথ গান্ধীজি এবং তৎকালীন কংগ্রেসের নেতাদের একাংশ সমর্থন করেননি। প্রাক্ স্বাধীনতা পর্বে এবং স্বাধীন ভারতে সুচারু ভাবে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার কী ভাবে নেতাজির অবদানকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তা ল্যারি কলিন্স ও দমিনিক লাপিয়ার-এর ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, শ্যামল বসুর সুভাষ ঘরে ফেরে নাই, সমর গুহর নেতাজি মৃত না জীবিত গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে।
সোমনাথ ভট্টাচার্য, বড়িশা, কলকাতা
শহিদের মর্যাদা
‘৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতি দাবি করে প্রস্তাব আমেরিকায়’ (১৬-১০) সংবাদের প্রেক্ষিতে এই পত্র। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নারী নেত্রী ও সাংসদ আরোমা দত্তের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, তাঁর দাদু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (৮৫) এবং কাকা দিলীপ দত্ত (৪০)-কে ময়নামতী ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে ভয়ঙ্কর অত্যাচার করে খুন করে পাক সেনা। এই হত্যার বিচার ও শাস্তি চান তিনি।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এক মহান দেশপ্রেমিক ছিলেন। আজ আমাদের দেশে যেমন হিন্দি সম্প্রসারণবাদ গোটা দেশের বহুমাত্রিকতা, বহুভাষিক সত্তাকে হাঁ করে গিলতে চাইছে, একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানও তেমন পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল রাষ্ট্রভাষা উর্দু। যে উর্দু ভাষা পাকিস্তানেরই মাত্র ৮% মানুষের, প্রধানত অভিজাত শ্রেণির, কথ্য ও লেখ্য ভাষা ছিল। পূর্ব পাকিস্তান কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল।
দেশভাগের পরে কংগ্রেসও ভাগ হয়ে গেল ও পূর্ব পাকিস্তান কংগ্রেসের নেতা হলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বটি ঘটেছিল ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দৃঢ় বক্তব্যে। তিনি ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সালে করাচির গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বাংলা ভাষার দাবি করলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিষ্য, আবদুল্লাহ রসুলের প্রেরণা, গান্ধী ও সুভাষ বসুতে মুগ্ধ বাংলার এই কৃতী সন্তান করাচির গণপরিষদে দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, পাকিস্তানের তৎকালীন ৬ কোটি ৯০ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষই বাংলাভাষী। তাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। ধীরেন্দ্রনাথের পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালে পাক সৈন্যরা হঠাৎ ঢাকায় গণহত্যা শুরু করার পরে ২৬ মার্চ কুমিল্লা শহর যেন শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। ধীরেন্দ্রনাথের উচ্চ রক্তচাপ ছিল, প্রবল মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণায় তিনি বারে বারে মাথা ধুচ্ছিলেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে অন্যত্র অন্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করাকে ভীরুতা মনে করেছিলেন। যে নিরপরাধ মানুষদের খানসেনারা নির্বিচারে গণহত্যা করছিল, ধীরেন্দ্রনাথ তাঁদের পাশেই থাকতে চেয়েছিলেন।
২৮ মার্চ ধীরেন্দ্রনাথ ও তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ দত্তকে খানসেনারা কুমিল্লার বাড়ি থেকে প্রহার করতে করতে টেনে নিয়ে যায়। পরবর্তী কালে জানা যায়, তাঁদের ভয়ঙ্কর অত্যাচার করে ১৪ এপ্রিল হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার খবর পাওয়া যেত না, যদি না এক জন ক্ষৌরকার রমণীমোহন শীল (চুল-দাড়ি কাটার জন্য খানসেনারা তাঁকে হত্যা করেনি) এই নৃশংসতার একমাত্র সাক্ষী থাকতেন। তিনি অকথ্য অত্যাচারে ধ্বস্ত ৮৫ বছরের বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন।
মিনার মনসুর লিখিত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: জীবন ও কর্ম বইতে আমরা দেখি, ধীরেন্দ্রনাথের জীবনই ছিল তাঁর বাণী। তিনি বলেছিলেন, মানবজাতিকে ভাল না বাসলে দেশকে ভালবাসা যায় না। ত্রিপুরা ও তার মানুষ ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। তাদের ছেড়ে কোথাও যেতে চাইতেন না। মাতৃভাষার প্রতি তাঁর দরদ ছিল সীমাহীন। পাকিস্তানকে স্বদেশ ভেবে রয়ে যাওয়া মহৎপ্রাণ মানুষগুলির মধ্যে শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক।
জ্যেষ্ঠ পুত্র সঞ্জীব দত্ত পাক আক্রমণের সময়ে কলকাতায় চাকরি করছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছিলেন আকুল ভাবে, কিন্তু সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। সঞ্জীব দত্তকে লেখা চিঠিগুলিতে সেই বিবরণ, আকুতি ধরা রয়েছে। এমন এক মহান দেশপ্রেমিককে আমরা কী অনায়াসে ভুলে গিয়েছি!
সন্দীপ সিংহ রায়, কাঁকিনাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
এক ফুটও নেই
‘ফিতে দিয়ে মাপা হল ফুটপাত’ (১০-১১) শীর্ষক সংবাদটি সময়োপযোগী। আমার সত্তর বছরের বাস গড়িয়াহাটে। আগে ফুটপাতের দুই দিকে হকার বসতেন, কিছু বছর আগে রাস্তার দিকে একটা খোপ বার করে চা, কফি, এমনকি ফ্রিজ রেখে ঠান্ডা পানীয় বিক্রি চলছে। বাজারের পিছনের গেটের ঢোকার মুখে বড় রাস্তার উপর ফুটপাত ছেড়ে প্রায় দশ ফুট দখল করে ফলের দোকান, বাস স্ট্যান্ডের উপর পুলিশের চোখের সামনেই বিরাট বড় গাড়িতে ফুটন্ত তেলে পকৌড়া ভাজা হচ্ছে। ফুটপাতের দুই-তৃতীয়াংশ তো দূরের কথা, পথচারীদের জন্য এক ফুট জায়গাও নেই।
পুরণজিৎ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-২৯
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy