Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
R G Kar Protest

দমেনি আন্দোলন

ডাক্তারদের অনশনকারী বাছাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি, কোনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রতা, কিছু কিছু মতভেদ ইত্যাদি উল্লেখ করে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:৫১
Share: Save:

দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘এই উৎসবের লগনে...’ (১০-১০) প্রবন্ধটি পড়ার পর কিছু লেখার প্রয়োজন অনুভব করলাম। আর জি কর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন শুরুর পর স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষের তীব্রতার পিছনে ছিল অরাজনৈতিক উদ্যোগের আহ্বান। তাই তার ব্যাপ্তি ছিল নজিরবিহীন ও ঐতিহাসিক। আর জি করের নির্যাতিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ধারাবাহিক ভাবে ঘটে চলা অনেক দুর্নীতি ও অত্যাচারের তিক্ত অভিজ্ঞতা। প্রায় দু’মাস ধরে চলা এই আন্দোলনের তীব্রতায় শাসকের অনিচ্ছুক হাত থেকে কিছু দাবি আদায় হয়েছে।‌ কিন্তু স্বচ্ছতা, সুরক্ষা ও জনস্বার্থমূলক কিছু ন্যায্য দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের আমরণ অনশনে বসতে হয়েছে। এটা ঠিক, আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে তরুণ অনভিজ্ঞ নির্ভীক কিছু ডাক্তারের নেতৃত্বে। কিন্তু প্রবন্ধকার অরাজনৈতিক এই আন্দোলনের পিছনে রাজনীতির প্রচ্ছন্ন মদত অনুভব করেছেন, যা এই রাজ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রাখে।

অন্য দিকে, ডাক্তারদের অনশনকারী বাছাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি, কোনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রতা, কিছু কিছু মতভেদ ইত্যাদি উল্লেখ করে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। বলা হয়েছে, টানাপড়েনের ঘূর্ণাবর্তে ক্ষতি হতে পারে একঝাঁক সম্ভাবনাময় তরুণ ডাক্তারের। মনে রাখা দরকার, এই আন্দোলন শুধু ডাক্তারদের জন্য নয়, সামগ্রিক স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার মঙ্গলের জন্য। তাই শাসকের দমনপীড়ন আর আইনের বেড়াজালে এ আন্দোলন বিভ্রান্ত হবে না, কারণ এর সঙ্গে যুক্ত আছে জাগ্রত জনতা আর সিনিয়র ডাক্তারদের সহানুভূতি, আবেগ ও স্বার্থ ত্যাগের সাহসী মানসিকতা। পুজো এল, চলেও গেল, বহাল রইল আন্দোলনের অঙ্গীকার— ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’।

সারনাথ হাজরা, হাওড়া

ক্ষোভের আগুন

দেবাশিস ভট্টাচার্যের বক্তব্য অনুসরণ করে বলা যেতে পারে, সরকারের দেওয়া ন্যূনতম সময়ভিত্তিক আশ্বাসে নির্ভর করে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করার পরই অনশনের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল জুনিয়র ডাক্তারদের। সরকার-বিরোধী যে কোনও প্রতিবাদ বা আন্দোলনে বিরোধী রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটবে না, তেমন আশঙ্কা অস্বাভাবিক নয়। ঠিক এই আশঙ্কাতেই চিকিৎসকদের আন্দোলন দিগ্‌ভ্রান্ত হওয়ার যে কথা এই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, সেটাও একেবারেই অমূলক নয়। আবার প্রশাসন সম্বন্ধেও গুরুতর অভিযোগ, আর জি করের ঘটনা এত দিন পেরিয়ে গেলেও এমন কোনও সিদ্ধান্ত তারা এখনও নিতে পারেনি, যাতে সাধারণ মানুষ সরকারের সদিচ্ছার প্রতি আশ্বস্ত হতে পারেন। সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা তখনই ফিরবে, যখন দেখা যাবে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে, অনৈতিক যে কোনও কাজে দৃঢ় পদক্ষেপ করতে বা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সরকার কালক্ষেপ করছে না। অথচ, সরকার যখন মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত মতামতকে অগ্রাহ্য করে উৎসবে ফেরার আহ্বান জানায়, যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকেরই এতে কুণ্ঠাবোধ হওয়া স্বাভাবিক। যদিও প্রেক্ষাপট আলাদা, কিন্তু করোনাকালেও উৎসব থেকে দূরেই ছিলাম আমরা সকলে। কালের বা প্রকৃতির নিয়মে মানুষের এই সহজাত ক্ষমতা বা প্রবৃত্তি এখনও আছে বলেই সে মানুষ।

তবে প্রবন্ধকার প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করার জন্য এই সমস্ত প্রতিশ্রুতিমান চিকিৎসক তরুণ-তরুণীদের কেরিয়ার গঠনে যে বাধা আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হওয়া সম্ভব নয়। তাঁদের ক্ষোভের আগুন এত তীব্রতর হওয়ার কারণ হিসাবে আর জি করের নারকীয় কাণ্ডই যে একমাত্র দায়ী নয়, সেটা আজ জলের মতো পরিষ্কার। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা নানা অনৈতিকতার যে ছবি সামনে আসছে, তাতে এই চিকিৎসকদের কেরিয়ার এমনিতেই বাধাপ্রাপ্ত এবং তাঁদের চলার পথও রীতিমতো বন্ধুর। পাঁচ সন্তানের মধ্যে চার জনকেই যদি সবচেয়ে বখে যাওয়া সন্তানের অঙ্গুলিহেলনে চলতে হয় এবং তাঁদের অভিভাবক এই ক্ষেত্রে সব জেনেও নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করেন, তবে বাকি চার জনের সেই অভিভাবকের প্রতি ক্ষোভ জন্মানোই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের মুখে অনেক সিদ্ধান্তই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। রাজ্যের অভিভাবকরূপী সরকারের ক্ষেত্রে ঠিক এই কারণেই ক্ষোভের আগুন স্ফুলিঙ্গের মতো ছিটকে বেরিয়ে আসছে। আগামী দিনে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত হওয়ার ব্যবস্থা এখনই না করতে পারলে, ‘ক্ষমতার দুর্গ’ জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়।

অশোক দাশ রিষড়া, হুগলি

উৎসবহীন

দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধটির মূল বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। এই আন্দোলনের যদি সারবত্তা না থাকত, তবে সব মানুষ পুজো নিয়েই মাতত। কিন্তু তা হয়নি। পুজোর মধ্যেও যে সব জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনে, অনশনে ছিলেন, যাঁদের পাশে ছিলেন অসংখ্য সিনিয়র ডাক্তার, বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ, এই পুজো, এই উৎসব তাঁদের ছিল না। এঁরা রাজ্যকে একটি উজ্জ্বল সকাল দেওয়ার জন্য অহিংস আন্দোলন করছেন। অথচ, কোনও সঙ্গত কারণ ছাড়াই পুলিশ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা ভাবে এঁদের সংহতি ভেঙে দেওয়ার, আন্দোলন বানচাল করার চেষ্টা হয়েছে। আশ্চর্যজনক ভাবে, এর প্রতিবাদ কিন্তু প্রবন্ধে পেলাম না। কলকাতা-সহ প্রত্যেক জেলার প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করলে জানা যাবে, এ বছর পুজোর বাজার ভাল ছিল না। আর্থিক সঙ্গতির কথা বাদ দিলেও আর জি করের নৃশংসতার প্রতিবাদে অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বিবেকের তাগিদেই এ বার পুজোয় আনন্দের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারেননি।

রাজ্য জুড়ে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর যে শোচনীয় অবস্থা, সে প্রশ্ন উঠেছে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে। হাসপাতালে জাল ওষুধ, মৃতদেহ নিয়ে কারবার, ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির পুনর্ব্যবহার, হুমকি-প্রথা, শিক্ষাদান ও শিক্ষার যে অবর্ণনীয় পরিবেশ— এগুলো তদন্তে উঠে না এলে গোটা রাজ্য, দেশ ও দুনিয়া কখনও জানতে পারত কি? এই অনিয়মের পর্দা ফাঁস করার জন্য ডাক্তার ও সাধারণ মানুষের প্রয়াস নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। অনশন করে রাজ্য থেকে শিল্প তাড়ানো যদি অপরাধ না হয়, তবে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য অনশন অপরাধ হবে কোন যুক্তিতে। কোন যুক্তিতে এই আন্দোলনকে ‘দিগ্‌ভ্রান্ত’ তকমা দেওয়া হচ্ছে? প্রথম থেকেই এই আন্দোলন অরাজনৈতিক, এটি ডাক্তার ও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের মানুষ তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষ হয়ে এতে অংশগ্রহণ করেছেন। কোথাও এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক রং লাগানোর প্রচেষ্টা হলেও জুনিয়র ডাক্তাররা তো বটেই, সাধারণ মানুষও সে সুযোগ দেননি। সংসারে কোনও বিষয়কে কেন্দ্র করে দু’-চার জন মানুষের মধ্যে মতপার্থক্য হয়েই থাকে, আবার সহমতেও আসেন তাঁরা। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনেও তেমনটাই হয়েছে। এতে ‘গেল গেল’ রব ওঠার, সংহতি নষ্ট হওয়ার কোনও কারণ নেই। বরং বলা যেতে পারে, জুনিয়র ডাক্তার ফোরামে গণতন্ত্র উজ্জ্বল। জুনিয়র ডাক্তাররা সকলেই সুশিক্ষিত, নিজেদের ভবিষ্যৎ, ভাল-মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে, অধিকার আছে। সেখানে অকারণ উদ্বেগ রোপণের প্রচেষ্টা ঠিক নয়। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে লাল ফিতের বাঁধন থেকে কাজ বেরোতে প্রচুর সময় লাগে। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে সেই কাজ কোনও লাল ফিতের পরোয়া করে না। আর জি করের দেওয়াল ভেঙে ফেলা তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তবে এই অভূতপূর্ব প্রতিবাদ দেখিয়ে দিল মানুষের মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করার দিন গিয়েছে।

গৌতম পতি তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

অন্য বিষয়গুলি:

Kolkata Doctor Rape and Murder Mamata Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy