Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
China

সম্পাদক সমীপেষু: সত্যের জোর

সুবোধ সরকার চিনের মানুষের পরিচ্ছন্নতা বোধ, রাস্তাঘাটের মসৃণতা, দারিদ্রহীনতা, সর্বোপরি পর্যাপ্ত খাদ্যের যে ভাবে প্রশস্তি করেছেন, তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত। তবে দু’একটা বক্তব্য সঠিক মনে হয়নি।

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:৩০
Share: Save:

‘শুধুই প্রাচীর নয়’ (৩০-৮) প্রবন্ধে সুবোধ সরকার চিনের মানুষের পরিচ্ছন্নতা বোধ, রাস্তাঘাটের মসৃণতা, দারিদ্রহীনতা, সর্বোপরি পর্যাপ্ত খাদ্যের যে ভাবে প্রশস্তি করেছেন, তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত। তবে দু’একটা বক্তব্য সঠিক মনে হয়নি। যেমন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাহীনতা বা প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে বিদ্যমান ‘সেল্ফ-সেন্সরশিপ’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “সেটা কোন দেশে নেই?” অর্থাৎ নিন্দনীয় ব্যাপারটি খুব লঘু করে দেখানোর চেষ্টা তিনি করেছেন। এ-ও বলেছেন, চিন তার সমস্ত নাগরিককে খেতে দিতে পারে, এ জন্য চিনের সব দোষ ক্ষমা করে দেওয়া যায়। না, সব দোষ ক্ষমা করে দেওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সোভিয়েট ইউনিয়নের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি সম্বন্ধে ‘রাশিয়ার চিঠি’-তে এক দিকে লিখেছিলেন, “আমাদের সকল সমস্যার সব চেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা।... এখানে সেই শিক্ষা কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়।” অপর দিকে সাম্যবাদী সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, “সোভিয়েটরা এই সমস্যাকে সমাধান করতে গিয়ে তাকে অস্বীকার করতে চেয়েছে। সেজন্যে জবরদস্তির সীমা নেই। একথা বলা চলে না যে মানুষের স্বাতন্ত্র্য থাকবে না, কিন্তু বলা চলে যে স্বার্থপরতা থাকবে না।... সত্যের জোরকে গায়ের জোরের দ্বারা যত প্রবলভাবেই আমরা মেলাতে চেষ্টা করি একদা তত প্রবলভাবেই তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।” এই অভিজ্ঞতা কবি অর্জন করেছিলেন ১৯৩০ সালে। জীবদ্দশায় চিনের সমাজতান্ত্রিক পথে উত্তরণ (গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের জন্ম ১৯৪৯) তিনি দেখে যেতে পারেননি। তবে অনুমান করা যেতে পারে যে নাগরিকদের মধ্যে স্বাধীনতাবোধের অভাব প্রত্যক্ষ করলে তাঁর মধ্যে রাশিয়ার মতোই বিরূপ প্ৰতিক্রিয়ার সৃষ্টি হত। শেষে বলতে চাই, “আপনাদের চোখ অর্ধেক খোলা, চোখ পুরো খুললে কী হবে?” মন্তব্যটি অশোভন। কোনও মানুষের বা জাতির শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কি এই ধরনের মন্তব্য করা যায়?

গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪

কেবলই মলাট

সুবোধ সরকার যে ভাবে চিনকে বর্ণনা করেছেন, সেটা নেহাতই তাঁর ব্যক্তিগত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। তার সঙ্গে বাস্তবের মিল কম। বইয়ের মলাট দেখে যেমন বইয়ের গুণগত মান বিচার করা যায় না, তেমনই শহরের অট্টালিকা, বা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে দেখেই একটি দেশের সার্বিক মূল্যায়ন করলে সেটা পক্ষপাতদুষ্ট হবে। যে কোনও দেশের বিকাশের নেপথ্যে থাকে সুস্থ রাজনীতি আর নাগরিক জীবনের সচেতনতা, সেটা একটা বিবর্তনের পথেই গড়ে ওঠে। ১৯৭৮ সালে আর্থিক সংস্কারের মাধ্যমে চিন যে প্রগতির যাত্রা শুরু করে, কোভিড অতিমারির পরে ২০২২ সালে সেই গতি অনেকটা থমকে গিয়েছে। বাজার দখল করতে আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর উপর নতুন করে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে চিন। ‘ব্রিকস’-এ নতুন নতুন দেশকে নিজের দলে টানতে চাইছে। প্রবন্ধকারের চিন-প্রীতি বিশ্বপ্রেমের নিদর্শন হতে পারে, তবে চিন যে সব সময়েই ভারতের অনুকূল, এমন নয়। ভারতকে চাপে রাখার জন্য নানা সময়ে পড়শি দেশগুলো চিনের সঙ্গে হাত মেলায়।

তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান

খেলাতেও সেরা

সত্যিই ‘চিন যে ভাবে চিন হয়ে উঠছে’, তা খুবই মনোগ্রাহী। জেনে আনন্দিত হলাম, এখানে কোনও কৃষিজমি কেউ বিক্রয় করতে পারবে না। ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু জমির মালিকানা রাষ্ট্রের। সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, দেড়শো কোটি জনসংখ্যার কেউ ভুখা পেটে মারা যায় না। সেই দেশে ভিক্ষা করে কাউকে জীবনধারণ করতে হয় না। প্রবন্ধকার জানিয়েছেন, চিনের জিডিপি ভারতের দশগুণ। যেটার উল্লেখ করার অবকাশ পাননি, সেটা হচ্ছে অলিম্পিক্স বা এশিয়াডের মতো যে কোনও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চিনের প্রতিযোগীদের অসামান্য সাফল্য, যা এখন সর্বজনবিদিত। একটি টয়লেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চিন দেশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যে সার্বিক মানের ছবি প্রবন্ধকার তুলে ধরেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ জানাই।

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৭

দারিদ্রের ছবি

সুবোধ সরকার বেজিং শহর তথা চিনের সমৃদ্ধিতে মুগ্ধ হয়েছেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চয়ই হয়েছে। বেজিং শহরের অন্যতম ঝলমলে ওয়ানফুজিয়াং অঞ্চলে রাত ন’টায় ভদ্র পোশাক-পরিহিত যুবককে লম্বা কাঠি দিয়ে ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলতে দেখেছি। মন্দিরের সামনে মা ও শিশুকে ভিক্ষা করতে দেখেছি। আমি অলিম্পিক্স অনুষ্ঠানের শেষে গিয়েছিলাম। সমস্ত বস্তি অঞ্চল (হুটং) বিশাল সুদৃশ্য ভিনাইল দিয়ে ঢাকা তখন। সর্বসাধারণের টয়লেটে দরজা নেই, এমন অন্তত তিন-চারটে দেখেছি। জনসাধারণ তাতেই সামনে মুখ করে বসে কার্য সিদ্ধি করছেন। গুয়াংজং (পুরনো ক্যান্টন) শহরে বিকেলের বাজারে খালি গায়ে দু’টি দলের মারামারি, সম্ভবত বখরা নিয়ে, সেও দেখেছি। দেশে বাক্‌স্বাধীনতা নেই, সর্বসম্মত আইন নেই, শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কিছু বলার অধিকার নেই। এক জোড়া জিন্‌সের প্যান্ট আমেরিকার বাজারে যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তার থেকে কম মাসিক মজুরিতে এক জন নারী-শ্রমিক সেটি তৈরি করছেন। সে দেশে শিশুর কৌটোজাত দুধে মেলামাইন বিষক্রিয়ার মতো কেলেঙ্কারি হয় (২০০৮)। নারী ও শিশু পাচার এবং জোরপূর্বক শ্রম প্রচুর। আন্তর্জাতিক মানে দুর্নীতি ব্যাপক, বিশেষত ঘুষ দিয়ে কার্যসিদ্ধি। এহ বাহ্য। দশ‌ লক্ষ উইগুর মুসলিমদের অন্তরীণ করে সমস্ত রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন করার চেষ্টা চলছে। দক্ষিণ চিন সাগরে নানা ভাবে সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা চলছে। এ সব কি শুধুই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিয়ে ঢাকা যাবে?

প্রদীপ রায়, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান

জরুরি বার্তা

দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘“বার্তা’ বোঝার সময়” (২৯-৮) প্রবন্ধটি সত্যিই প্রণিধানযোগ্য। ১৪ অগস্টের স্বতঃস্ফূর্ত রাত দখল কর্মসূচি দেখিয়ে দিয়েছে, সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে মানুষ হিসাবে মানুষের স্বতন্ত্র সত্তা ও শক্তি আজও হারিয়ে যায়নি। শাসক চাইলেও সেই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, নিজের অনুকূল খাতে চালিত করতে পারে না। মানুষের দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও অসন্তোষ যে কোনও মুহূর্তে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে।

শাসক এবং শাসক-বিরোধী— এই দুই পক্ষের বিভাজনে জনমানুষকে দ্বিধা-বিভক্ত করতে পারলে শাসকের পক্ষে হিসাবনিকাশ করা সহজ হয়। ১৪ অগস্টের রাতে মানুষ যে ভাবে বন্যার মতো রাস্তায় নেমে এসেছে, তা অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী থেকে বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষের সুদীর্ঘ মিছিল— এই স্বতঃস্ফূর্ত আলোড়ন শাসকের উদ্দেশে যে বার্তা রেখে যায় তা হল, কিছু সামাজিক প্রকল্পের বিনিময়ে মানুষকে ভোটব্যাঙ্ক বানিয়ে রেখে দেওয়া যায় না। বিবেককে কেনা যায় না। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সে রুখে দাঁড়াবেই। দলীয় সংগঠনের চোখ-রাঙানি, ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা, চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ভয়— কোনও কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারে না। ন্যায়বিচার বার বার ব্যাহত হচ্ছে, শাসক অন্যায়কারীর পক্ষ নিচ্ছে, জনগণ তা নির্বিকার চিত্তে মেনে নিতে পারে না।

শাসকের উচিত, নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করা। জনগণের বার্তাকে উপেক্ষা না করা। সেই সদিচ্ছা তার আছে কি না, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

অপূর্ব সৎপতি, সারেঙ্গা, বাঁকুড়া

অন্য বিষয়গুলি:

China Democracy Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy