সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘দিতেছি কতই যন্ত্রণা’ (৯-১০) প্রবন্ধে ব্যক্তিগত যে অভিজ্ঞতাটির কথা বলে শুরু করেছেন, তা এক কথায় অনবদ্য। একটি ছোট মেয়ে মায়ের সঙ্গে ‘সাপলুডো’ খেলতে গিয়ে মায়ের গুটি বার করতে দেখে বিধিবহির্ভূত (অর্থাৎ, পুট না পড়া সত্ত্বেও) নিজের গুটিখানি বার করে বলছে, মা কি বেবিকে রেখে একা একা বেরিয়ে যাবে নাকি? মা বেরোলে বেবিও বেরোবে। সত্যি, জননী-জাতক বন্ধনের কী সুন্দর একটি প্রকাশ ওইটুকু মেয়ের মুখে! কিন্তু, দেবী দুর্গার মর্তে আগমনের প্রেক্ষাপটে উপরোক্ত সম্পর্কেরই একটা প্রতিচ্ছবি যখন ফুটে ওঠে, প্রবন্ধকার সেটাকে সহজ ভাবে নিতে পারেন না। তাঁর মনে হয়, ‘সংসার জননী’ হিসাবে দেবীকে মূর্ত করতেই স্বর্গের দেবতারা এই ভাবে তাঁকে পাঠিয়েছেন। দেবীর এই রূপটি ‘পাবলিক’-এর কাছে তাঁর অস্ত্রশস্ত্র-সজ্জিত রূপের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে তিনি বিদ্রুপও করেছেন। এমনকি, দুর্গার সঙ্গে তাঁর আত্মজ-আত্মজার পবিত্র এই বন্ধনের কল্পনা বা তাঁকে ‘ঘরের মেয়ে’ হিসাবে দেখা কিংবা উল্টো দিকে, মেয়েদের ‘দুর্গা’ বলে অভিহিত করে সম্মান দেওয়াটাও একটা নেতিবাচক অভ্যাস হিসাবে প্ৰবন্ধকারের কাছে বর্জনীয় মনে হয়েছে।
মেয়েদের প্রতি অত্যাচার-অনাচার এখনই বন্ধ হওয়া প্ৰয়োজন। প্রয়োজন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সম্পূর্ণ বদল। ‘মা-বোন’ হিসাবে শুধু ‘মুখে’ সম্মান দেখালেই হবে না, কাজের মাধ্যমেও পুরুষদের সম্মান দেখাতে হবে সর্বত্র। পরিবারে শুধু মেয়েরাই ত্যাগ-তিতিক্ষার আদর্শ মেনে চলবে আর বঞ্চিত হতে থাকবে, এ কখনও মেনে নেওয়া যায় না। প্রবন্ধকারের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত, পারিবারিক পরিসরে শ্রম এবং সম্পদের অসম বণ্টন, কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের গুরুত্বহীন করে রাখা বা তাঁদের উপর মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন— এই সমস্ত ব্যাপার এখনও ঠিকমতো চর্চায় আসে না। যত দিন না এই অন্যায়গুলো গুরুত্ব-সহকারে বিবেচিত হচ্ছে, তত দিন সমাজে এই অসাম্য থাকবে, এবং তার কুৎসিত প্রকাশও বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন সময় ঘটতে দেখা যাবে। ব্যক্তিগত ভাবে যদিও নারীকে আমি পুরুষের মতোই এক জন সহনাগরিক হিসাবে যথাযোগ্য সম্মান জানাতে পছন্দ করি, তবু অন্য কোনও পুরুষ যদি তাঁকে ‘মা’ বা ‘বোন’ ভেবে প্ৰকৃতই সম্মান করতে চান, তাতেও আমি আপত্তির কিছু দেখি না।
তবে, সব পুরুষকে একই বন্ধনীতে রেখে তাঁদের বিরুদ্ধে যে প্রচ্ছন্ন একটা কটাক্ষের সুর এই লেখায় ভেসে উঠেছে, তা-ও কিন্তু কখনও অভিপ্রেত নয়। আর একটা কথা না বলে পারছি না, যেখানে যুদ্ধে পাঠানোর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দেবী দুর্গার মুখ দিয়ে দেবতাদের উদ্দেশে তাঁর প্রতিস্পর্ধী বক্তব্য শুনতে চাইছেন প্রবন্ধকার। “আমি জননী বসুন্ধরার মাটির কন্যা। আমি জানি যুদ্ধ আমাদের অনন্ত দুর্গতি। মাটির কাছাকাছি থাকা রক্ষ-দানব-দৈত্য-অসুর বরং আমার সহোদর।” তা হলে আর মর্তের ‘রক্ষ-দানব-দৈত্য-অসুর’দের নিয়ে এত দুশ্চিন্তা কেন আমাদের? একটু কি স্ব-বিরোধী শোনাল না কথাটা?
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
শুধুই মা-বোন
সমাজে যে মেয়েদের ঠিক সহনাগরিক হিসাবে দেখা হয় না, ‘মায়ের জাত’ হিসাবে দেখা হয়, মেয়েরা বড় হয় ‘মা হওয়ার জন্য’— মেয়েদের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত অমানবিক। সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে ঠিকই বলেছেন— নেতাদের ভাষণ শুরু হয় ‘বন্ধুগণ’ এবং ‘মা-বোনেদের’ উদ্দেশে। যেন মা-বোনেরা বন্ধু নয়, সহনাগরিক নয়। তারা আলাদা, তারা মা-বোন, যেন তাদের বাদ দেওয়ার কথা কিন্তু দিচ্ছি না যে, সেটা আমারই (নেতার) মহত্ত্ব।
অন্য স্ত্রী-প্রাণীরা যেখানে স্নেহ মমতায় সন্তান প্রতিপালন করে প্রাকৃতিক নিয়মেই, সেখানে মানুষের মতো উন্নত জীবও যে তেমনটাই করবে, এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই! মাতৃবন্দনার কেন এত আয়োজন তবে? না হলে কি তারা সন্তান প্রতিপালনে অমনোযোগী হত?
ছোটবেলায় দারিদ্রের জীবনে খাওয়া-পরার যে কষ্ট পেয়েছি, তার বহু গুণ কষ্ট বোনেরা পেয়েছে, মায়ের কথা বাদই দিলাম। এক সঙ্গে খেতে বসেও গোটা ডিম ছেলেরা পেত, আর চোখের সামনে অর্ধেক ডিম স্নেহের বোনেরা খেত। সে দিন অন্য ভাবে ভাবতে পারিনি, মনে হত এটাই স্বাভাবিক। গোটা ডিমের প্রতি বোনের দৃষ্টি পড়ত, কখনও তাদের একটু-আধটু ভেঙে দিয়েওছি। সে সব কথা ভেবে এখন কষ্ট হয় বইকি। ভাবার মতো করে ভাবতে কি পারতাম না সে দিন! এও কি আশ্চর্যের কথা নয়?
এ ভাবেই ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা শিখে যায় পুরুষদের পাতে বেশি দিতে হয়। এ ভাবেই সমাজের ব্যবস্থাপনায় পরিবারে বৈষম্য লালিত হয়, পুষ্ট হয়, প্রসারিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত শুধু আর পুরুষ-নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বহুস্তরীয় বৈষম্যের উদ্ভব ঘটায়।
কিছু ধারণা এখনও কাজ করে। যেমন, মেয়েদের রক্ষা করা পুরুষদের কর্তব্য। তাদের পুরুষদের মতো স্বাধীন ভাবে চলা নিষেধ। স্বাধীন ভাবে চলতে গেলে যদি পুরুষের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তবে সেটা নারীরই দোষ। পুরুষেরা তো আক্রমণ করবেই। জীবজগতে সেটাই তো দেখা যায়। এগুলো মেনে নিলে বলতে হয়, তা হলে মানুষের মনুষ্যত্বের দাবি আর টেকে না।
পরিবারের অভ্যন্তরে সব দায়দায়িত্ব মূলত মায়েদের। তবু সংসারটা তাদের নয়। তারা গৃহিণী হিসাবে সংসারে যে ক্ষমতা ভোগ করে, তা নিতান্তই এক আপাত ক্ষমতা। অনেক গৃহিণীকেই তার পরিবারের কর্তার উপরে রাগ করে বলতে শুনেছি, “আমি আর তোমার সংসারে নেই। লোকের বাড়িতে কাজ করে খাওয়া এর চেয়ে ঢের সম্মানের।” স্বাধীনতা পশুর মধ্যেও আছে, মানুষের মধ্যে নেই, দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে সেটা এ ভাবে বেরিয়ে আসে কখনও কখনও। সুতরাং মাতৃবন্দনা মেয়েদের কোনও ন্যায্য ক্ষমতা বা অধিকার দেয় না, সুকৌশলে অর্থাৎ মাহাত্ম্যের প্রলোভন দেখিয়ে কেড়েই নেয়। তাই মেয়েদের অহেতুক সম্মান প্রদর্শন অভিসন্ধিমূলকই। দিনকাল পাল্টাচ্ছে। শিক্ষিত মেয়েরা এখন রোজগারের জন্য ঘরের বাইরে বার হচ্ছে, সামাজিক কাজকর্মে, প্রশাসনিক কাজকর্মে নিযুক্ত হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিকতাও তার কৌশল বদল করে নিজেকে জারি রাখছে।
দুর্গেশ কুমার পান্ডা, সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
অনুপ্রেরণা
কণাদ সিংহের ‘হেরেও যিনি বিজয়ী’ (৫-১০) শীর্ষক প্রবন্ধ সম্পর্কে কিছু কথা। প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থা, প্রতিকূলতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতের ইতিহাস কখনও মহিলা বর্জিত ছিল না, তা সে রানি লক্ষ্মীবাই হোন অথবা বেগম রোকেয়া বা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। বিশেষত বিনেশ ফোগতের সংগ্ৰামী জীবনকাহিনি উপন্যাসের মতো রোমাঞ্চকর। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে, অদম্য মানসিক জেদে, প্রতিবাদী মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রামের জীবন থেকে বেরিয়ে খেলাধুলার জগতে পা রেখে মহিলা কুস্তিতে একের পর এক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় জিতেছেন বিনেশ। তিনি কমনওয়েলথ, এশিয়ান গেমস ও এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে একাধিক সোনা জিতেছেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও দু’টি ব্রোঞ্জ তাঁর দখলে। এই বছরের অলিম্পিক্সে ওজনে মাত্র একশো গ্ৰাম বেশি হওয়ায় তাঁকে বহিষ্কৃত হতে হল। কিন্তু তিনি লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরে দাঁড়াননি। হরিয়ানার জুলানা কেন্দ্র থেকে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের টিকিটে লড়েছেন।
ভারতকে এক দিন বিশ্ব ক্রিকেটের মসনদে বসার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ‘হরিয়ানা হারিকেন’ কপিল দেব। তিনি যেমন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘আইকন’, একই ভাবে গীতা, ববিতা, সাক্ষী মালিকদের সঙ্গে বিনেশ ফোগতও ভারতের উদীয়মান মহিলা কুস্তিগিরদের আদর্শ ও অনুপ্রেরণা।
হারান চন্দ্র মণ্ডল, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy