প্রতিবাদ: ইরানের প্রথম ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে এক জন ইরানি ফুটবলারও গলা মেলালেন না।
কাতার বিশ্বকাপের আসরে বিশ্ব দেখল, মৌলবাদী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি দেশের জাতীয় দলের ফুটবলারদের শান্তিপূর্ণ, অহিংস ও দৃষ্টান্তমূলক প্রতিবাদ। প্রসঙ্গত, গত ১৬ সেপ্টেম্বর ইরানে হিজাব ঠিকমতো না পরার অপরাধে নীতি পুলিশের নির্যাতনে প্রাণ হারান মাহসা আমিনি। তার পরই মৌলবাদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হন ইরানের সাধারণ মানুষ, বিশেষত মেয়েরা। হিজাব-বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয় ইরান। আন্দোলন ঠেকাতে প্রশাসন নিরীহ মানুষের উপর চালায় লাঠি, গুলি, গ্রেফতার হন বহু। সমাজমাধ্যমে হিজাব খুলে ফেলার ভিডিয়ো পোস্ট করার জন্য আটক করা হয় দুই নামী ইরানি অভিনেত্রীকেও। ধরপাকড় করেও যখন আন্দোলন থামানো যায়নি, তখন প্রাণদণ্ড দিয়ে ভয় দেখাতে চেয়েছে প্রশাসন। কিন্তু আন্দোলন তাতে দমেনি। চাপের মুখে কিছুটা স্বর নরম করতে বাধ্য হয়েছে রইসি সরকারও। সম্প্রতি নীতি পুলিশ বাতিলের ঘোষণা করেছে তারা।
কিন্তু এই টালমাটালের মধ্যে নজর কাড়ল ইরানের জাতীয় দলের ফুটবলারদের বিশ্বকাপের আসরে খামেনেই-রইসি’র জমানার বিরুদ্ধে অভিনব প্রতিবাদ। প্রথামতো, খেলা শুরু হওয়ার আগে স্টেডিয়ামে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। খেলোয়াড় ও মাঠে উপস্থিত দর্শকরা নিজ দেশের জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে গলা মেলান। এ বারে কিন্তু অন্য রকম। ইরানের প্রথম ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে এক জন ইরানি ফুটবলারও গলা মেলালেন না। গ্যালারিতে বসা সমর্থকরাও খেলোয়াড়দের সমর্থন করে নীরব রইলেন। এ নীরবতার ভাষা বড় ভয়ঙ্কর। বড় বাঙ্ময়। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ স্মরণ করিয়ে দিল ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিক্সে হিটলারের নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ ও বিশ্বসেরা অ্যাথলিট জেসি ওয়েন্সের প্রতিবাদকে।
হয়তো দেশে ফিরে শাস্তির মুখে পড়বেন ইরানের ফুটবলাররা। তবুও হিম্মত দেখালেন তাঁরা। ফুটবলের অঙ্গনও জোরালো প্রতিবাদের ক্ষেত্র হতে পারে, যা স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রকে টলিয়ে দিতে পারে, এমনই দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলার ফলাফল যা-ই হোক না কেন, প্রতিবাদী ইরান কিন্তু জিতে নিয়েছে সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়। ইরানের ফুটবলারদের হাজার কুর্নিশ, সেলাম।
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
সত্যাগ্রহ
সেমন্তী ঘোষ (‘প্রতিবাদী দেশপ্রেম’, ২৯-১১)-এর ভীষণ প্রাসঙ্গিক ও যথার্থ লেখাটি থেকে সমৃদ্ধ হলাম এবং বিশ্বকাপে নিজেদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠার সময় ইরানি ফুটবলারদের বিভিন্ন খেলার দিন বিভিন্ন রকম আচরণের একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পেলাম। ২১ নভেম্বর ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় নিজেদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠার সময় ইরানের এগারো জন ফুটবলার যখন রীতি অনুযায়ী গানে ঠোঁট না মিলিয়ে নীরব রইলেন— দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝলাম, ইরানের তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ইরান জুড়ে শুরু হওয়া হিজাব তথা সরকার-বিরোধী প্রতিবাদের সমর্থনে এ ছিল ইরানি ফুটবলারদের প্রতিবাদ। কিন্তু বিশ্বকাপে খেলোয়াড়দের আচরণের সঙ্গে দেশের সম্মান, জাতীয় আবেগ জড়িয়ে আছে। আর জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠার সময় গলা মেলানো তো দেশের প্রতি ভালবাসা ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ, যা আপন হৃদয় থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উঠে আসাটাই স্বাভাবিক।
দেশ মানে তো শুধু অত্যাচারী শাসক নয়, তার বাইরে দেশের মানুষ, প্রকৃতি, সম্পদ, সংস্কৃতি— সব কিছুই আছে। শাসক আজ আছে, কালের নিয়মেই তাকে বিদায় নিতে হবে। তাই ২৫ নভেম্বরের খেলায় জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠার সময় ইরানি ফুটবলাররা যখন গলা মেলালেন, এক জন ভারতীয় হয়েও আত্মতৃপ্তি অনুভব করেছিলাম। কারণ, জাতীয় সঙ্গীত তো প্রতিটি সচেতন মানুষের কাছে আবেগের বস্তু। প্রবন্ধকারও তাই ব্যাখ্যা করেছেন— সে দিন তাঁরা সঙ্গীতে গলা না মিলিয়ে যে বার্তাটি দিয়েছেন, তা দেশের বিরুদ্ধে নয়। দেশের শাসকের বিরুদ্ধে। মানুষের বিরুদ্ধে নয়, সরকারের বিরুদ্ধে। আর, তার পরের দিন জাতীয় সঙ্গীতে গলা মিলিয়ে তাঁরা যে বার্তাটি দিয়েছেন, সেটা দেশপ্রেমের। মানুষের জন্য।
সত্যকে আঁকড়ে ধরে আত্মকষ্টের মাধ্যমে শত্রুর মন জয় করাই হল মিনিয়েচার সত্যাগ্রহ। বিশ্বকাপ খেলতে আসা ইরানের খেলোয়াড়রা যে আত্মকষ্টের মাধ্যমে নীরব প্রতিবাদ করলেন, সে বিষয়টি শাসকের মনে কতটা রেখাপাত করল, তা সময় বলবে। ইতিমধ্যে ফুটবলারদের জেলে ভরার হুমকি, তাঁদের পরিবারকে অত্যাচারের শাসানির গুঞ্জন মিডিয়ার দৌলতে শোনা গিয়েছে। তবুও মৌলবাদের বিরুদ্ধে এ বিশ্বকে তরুণ প্রজন্মের বাসযোগ্য করব আমরা, বিশ্বকাপের বিশ্বমঞ্চে তাই যেন করে দেখালেন তাঁরা। তাঁদের এই ‘মিনিয়েচার সত্যাগ্রহ’-কে কুর্নিশ।
সৈকত রায়, আরামবাগ, হুগলি
হাতিয়ার
মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর থেকেই হিজাব বিরোধী আন্দোলনে ফুঁসছে ইরান। সেই প্রতিবাদের আঁচ উঠে এল বিশ্বকাপের মঞ্চেও। ফুটবলের আসরে কার্যত মৌনতাকেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নিলেন ইরানি ফুটবলাররা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে হারলেও কাতারের বুকে প্রতিবাদের এক অনন্য ভাষা তৈরি করে গেলেন ইরানের খেলোয়াড়েরা। ফুটবলের ইতিহাসে এই প্রথম বার প্রথম ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন না তাঁরা। পৃথিবীর নানা প্রান্তে কয়েকশো কোটি দর্শক বিশ্বকাপের খেলা দেখছিলেন। যাঁরা ইরানের আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাঁদের মনেও ঝড় তুলেছে এই অত্যাচারের কাহিনি। মানুষ জেনেছেন ইরানের মোল্লাতন্ত্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে। বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ ও সমর্থন প্রয়োজন ছিল। ইরানের খেলোয়াড়েরা তাই করেছেন। প্রতিবাদের সব রাস্তা যখন বন্ধ, জাতীয় সঙ্গীতে ঠোঁট না মেলানোর মতো প্রতীকী প্রতিবাদের কোনও বিকল্প নেই। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। ঘুরে দাঁড়ানোই শেষ উপায়। নীরবতাই হোক প্রতিবাদের হাতিয়ার।
উৎপল মুখোপাধ্যায়, চন্দননগর, হুগলি
সম্প্রীতির কাপ
বিশ্বকাপ এ বার কাতারে। এই আসরে নিজেদের সংস্কৃতি তুলে ধরার একটি সুযোগ পেয়েছে মরুদেশটি। পশ্চিমি দুনিয়ার যাবতীয় বিদ্রুপকে যদি কাতার এই বিশ্বকাপে ছুড়ে ফেলতে পারে, তবে দেশটির কাছে তার থেকে বড় প্রাপ্তি আর হয় না। কিন্তু ইতিমধ্যেই উঠেছে অনেক প্রশ্ন। বিশ্বকাপের বোধনের মুহূর্তেও নাকি লঙ্ঘিত হয়েছিল মানবাধিকার। একেবারে শুরুর দিকে ভারত ও ফিলিপিন্সের ২০৫ জন পুরুষ ও ৭ জন মহিলা কর্মীকে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখানোর ব্যবস্থা করেও তাঁদের স্টেডিয়ামের বাইরে প্রচণ্ড রোদের মধ্যেই বসিয়ে রাখার অভিযোগ উঠেছে। শাকিরা-সহ অনেক তারকা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। এবং বিশ্বকাপ শুরুর আগেই কাতারে বিতর্কিত ইসলামি ধর্মগুরু জ়াকির নায়েকের উপস্থিতি নিয়েও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যে ফুটবল মানবতা এবং ভ্রাতৃত্বের কথা বলে, সেই ফুটবলেরই বিশ্ব আসরে ধর্ম নিয়ে এত বিতর্ক হবে কেন? ফুটবলের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নেই। এই প্রথম শীতকালে ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন হয়েছে। তবুও মরুদেশের গরমের কারণে প্রতিটি স্টেডিয়ামকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করার আয়োজন অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। সম্প্রীতির বার্তাটিও যদি শেষ পর্যন্ত দেখানো যায়, তবে আসরটি আরও সুন্দর হতে পারে। তাই এ ফুটবল সম্প্রীতির ফুটবল হয়ে থাক— এটাই একমাত্র প্রার্থনা। ধর্মের সঙ্গে ফুটবলকে গুলিয়ে না ফেলে বিশ্বকাপের আসরকে একতা, শান্তি ও সম্প্রীতির মহাযজ্ঞ করে তোলাই শ্রেয় নয় কি?
প্রদ্যুৎ সিংহ , অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy