‘কিছু বিশুদ্ধ চোখের জল’ (৬-৭) শীর্ষক প্রবন্ধে ঈশানী দত্ত রায় যথার্থই উল্লেখ করেছেন, আমরা সবাই কিন্তু নিজের কারণে কাঁদছি। আমাদের দেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না, তাই মারাদোনা বা মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখলে আমরা কাঁদি। আবার নিজের কাছের লোকের কোনও খারাপ খবর বা দুঃখেও যেমন মন বেদনাতুর হয়ে ওঠে, তেমনই তাদের সাফল্যও আমাদের চোখে অজানতেই জল এনে দেয়। ১৯৮৩ সালে ক্রিকেটে পিছিয়ে থাকা দল হিসেবে বিশ্বজয়টা ছিল আমাদের কাছে এক দিনের রূপকথার মতো। শুনতে যতই খারাপ লাগুক, সেই জয়টা যে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো ছিল, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছিলাম কয়েক দিন বাদে ভারতে এসে ভারতকে এক প্রকার মাঠে দুরমুশ করে ৫-০ ফলাফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের এক দিনের সিরিজ় জয় দেখে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট সংস্থা ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সৌজন্যে যে ভাবে ভারতে ক্রিকেটের প্রসার ঘটেছে, তাতে সমস্ত দিক দিয়েই আজ ভারত বিশ্বক্রিকেটে চালকের আসনে। এই বিশ্বজয়ের কান্না অতীতে প্রথম হওয়া ছাত্রের বার বার ফেল করতে করতে আবার পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করার জন্য কাঁদা, নিজের নেতৃত্বে জয়লাভের জন্য কাঁদা, না কি টি২০ বিশ্বকাপে নিজের শেষ ম্যাচ খেলার জন্য কাঁদা, তার ‘বিশুদ্ধতা’ নিয়ে সঠিক উত্তর ভারতীয় ক্রিকেটাররাই দিতে পারবেন।
এক সময়ে ভারতকে হকিতে বিশ্বের সেরা দল হিসেবেই দেখা হত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে হকিতে উৎসাহী দেশের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকায়, এবং আধুনিক হকির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে, আমরা এই খেলায় অনেক পিছিয়ে পড়েছি। তাই এর দুঃখেও ক্রীড়াপ্রেমীদের চোখ আজ ভরে ওঠে জলে।
সেই কথা স্মরণে রেখে, বিশ্বে প্রথম সারির ক্রিকেট-খেলিয়ে দলের সংখ্যা যতই দুই অঙ্কেরও নীচে সীমাবদ্ধ থাকুক না কেন, বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দকে কখনওই খাটো করে দেখা উচিত নয়।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
ঝাপসা চশমা
‘কিছু বিশুদ্ধ চোখের জল’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। সত্তরের দশকে আমার স্কুলবেলায় মায়ের সঙ্গে আমাদের বিরাটির ‘রমা’ সিনেমা হলে দেখতে গিয়েছি ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ও অভিনীত ছায়াছবি, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো সিনেমার এক জায়গায় বাংলাদেশ থেকে নির্যাতিতা, উদ্বাস্তু হয়ে আসা পালিতা কন্যার ভূমিকায় শাঁওলি মিত্রের দিকে তাকিয়ে পালক পিতার ভূমিকায় ঋত্বিক ঘটক দেবব্রত বিশ্বাসের মন্দ্র স্বরে গাইছেন, ‘কেন চেয়ে আছেন গো মা, মুখপানে...’।
গলার মধ্যে কষ্টের দলা পাকালো, তার পর চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় জল ঝরে পড়ল। একে কী বলে, সমানুভূতি? ওই যে প্রবন্ধকার বলেছেন, আমরা নিজের জন্যই কাঁদি। বিয়াল্লিশ বা বিন্দুর ছেলে সিনেমা দেখতে গিয়ে আমার মা, পাড়াতুতো জেঠিমা কাকিমাদের কেঁদে ভাসাতে দেখেছি। আনন্দাশ্রুর উজ্জ্বলতম নিদর্শন মতি নন্দীর লেখা বই, কোনি সিনেমাতে শেষ পর্যন্ত কোনি যখন সাঁতারের প্রতিযোগিতায় জয়ী হল, খ্যাপা একগুঁয়ে কোচ ক্ষিদ্দার চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে যাওয়া। সে জলছাপ এখনও বহু দর্শকের বুকের মাঝে আছে।
২০১৩ সালে আন্দামান বেড়াতে গিয়ে পোর্ট ব্লেয়ারে সেলুলার জেল স্মারক মিউজ়িয়ামের উল্টো দিকের হোটেলে ছিলাম। সকালে খুঁটিয়ে দেখে এসেছি কঠিনতম অত্যাচারিত বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনের পরিণতি। সন্ধের ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ প্রোগ্রামে ওম পুরীর ভরাট গলায় শোনা যাচ্ছিল সেলুলার জেলে বিপ্লবীদের উপর অত্যাচারের কাহিনি, আর আলো ফেলা হচ্ছিল সাভারকর, উল্লাসকর দত্ত প্রমুখের সলিটারি সেলে, মানুষ দিয়ে ঘানি টানার জায়গায়, এক সঙ্গে তিন জনকে ফাঁসি দেওয়ার সেই মঞ্চে। দর্শকাসনে তখন পিনপতনের নৈঃশব্দ্য। আলো জ্বললে দেখা গেল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের চোখে জলের ধারা। এ চোখের জলে কোনও গ্লানি বা মালিন্য নেই, আছে দেশকে ভালবাসার বিশুদ্ধ আবেগ। দেশ তো শুধু গুটিকতক রাজনৈতিক নেতার কুক্ষিগত সম্পত্তি নয়, দেশ জল, মাটি, দেশবাসীর।
বার্বেডোজ়ে গত ২৯ জুনের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনাল শুধুমাত্র দুই দলের মধ্যে একটি খেলা ছিল না, ছিল একশো ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর হৃদ্স্পন্দন। অক্ষর পটেলের ওভারে চার ছয়ের ঝোড়ো রানে ক্লাসেন বাইশ তুললেন। ত্রিশ বলে ত্রিশ রান দরকার সাউথ আফ্রিকার জয়ের জন্য। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে হার্দিক এসে ক্লাসেনকে আউট করলেন। টিভির পর্দায় চোখ রেখে আমরা উঠে বসলাম। আশায় বাঁচে চাষা। বাকিটা ইতিহাস। হার্দিকের শেষ ওভারে যখন ১৬ রান দরকার, সূর্য যদি ওই অবিশ্বাস্য ক্যাচটি না নিতে পারতেন এবং ডেভিড মিলার ছয় হাঁকাতেন? ওই পাহাড়প্রমাণ চাপ নিয়ে ভারত যখন বিশ্বজয়ী হল, হার্দিক তো সমস্ত কষ্ট উজাড় করা আনন্দের কান্না কাঁদবেনই, রোহিত রণক্ষেত্রের মাটি মুখে দেবেন, আর আমরা সারা দেশবাসী তাঁদের সঙ্গে উদ্বেল আনন্দে কাঁদব। প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন, জয়ের পিছনে অনেক অপমান পরাজয় থাকে। তাই তো দেশে ফিরে মুম্বইয়ের পথে দল ও হাজার হাজার মানুষ ‘আমরা সবাই রাজা’-র আনন্দে একাকার হলেন।
দেশকে ভালবাসার এই বিশুদ্ধ আবেগ টিভির পর্দায় দেখে আমরা আরও এক বার কাঁদলাম।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
স্মৃতির হলং
‘পুড়ে ছাই হলং বনবাংলো, প্রশ্ন’ (১৯-৬) শীর্ষক বেদনাদায়ক প্রতিবেদন প্রসঙ্গে এই চিঠির অবতারণা। জলদাপাড়ার এই অঞ্চলটি ভ্রমণপিয়াসি মানুষের প্রিয়। ‘জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্ক’-এর তৃতীয় ডিভিশনের মধ্যে থাকা একটি বিশেষ এলাকা হলং সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তারই সুদৃশ্য বনবাংলোটি নষ্ট হওয়া যেন সুন্দরের অপমৃত্যু। কিছু দিন আগে এই অভয়ারণ্য ঘুরে আসার কারণে হলং বাংলোটির ছবিটা বড় বেশি করে স্মরণে আসছে। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি এই আবাস, পাশে ছোট্ট নদী হলং। নদীর ও পাড়ে সারি সারি ‘সল্ট পিট’। বন্য প্রাণীরা রাতের বেলায় এখানে নুন চাটতে আসে। এখান থেকেই এই বনাঞ্চলের সৌন্দর্য দেখতে হাতির পিঠে চেপে গভীর অরণ্যে ঢোকা হয়। সঙ্কীর্ণ বনপথে হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে লম্বা লম্বা ঘাসের বনের মধ্যে অনেক প্রাণীর সঙ্গে গন্ডারের দর্শন পাওয়া যায়। হরিণের দল, ঝাঁক ঝাঁক পাখি আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাতির সহাবস্থান হলং।
পাশেই রয়েছে আর একটি বনবাংলো ‘জলদাপাড়া টুরিস্ট লজ’। তুলনায় বেশ কিছুটা বড় আকারের এই লজের প্রশস্ত অঙ্গনে ছড়িয়ে রয়েছে গন্ডার, হাতি, বাইসন, হরিণ, সম্বর— এমন সব বন্যপ্রাণীর প্রমাণ আকারের মডেল। দেখলে আসলই বলে মনে হবে। রাতের অন্ধকারে তাদের গায়ে আলো ফেলে চলে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এর অনুষ্ঠান। হলং-এর সূত্রে আসে সিকিয়া ঝোরা, জয়ন্তী নদী, বক্সা অরণ্যভূমির কথা। সিকিয়া ঝোরার পাশে বয়ে চলা জলপথে ছোট নৌকায় চড়ে চলে ‘বোট সাফারি’। সেই চলার পথে জলের দু’ধারে ঝোপঝাড় দেখে ভয়মিশ্রিত একটা অদ্ভুত অনুভূতি জাগে। হলং-এর কাছাকাছি বনাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটা ‘ওয়াচ টাওয়ার’। এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে পর্যটকদের কোনও রকম দাহ্যবস্তুর ব্যবহার, জোরে কথাবার্তা বলা নিষিদ্ধ আছে, জঙ্গলের প্রাণীদের নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে। তবুও আগুন লাগার মতো অঘটন ঘটে গেল।
হলং-এর বনবাংলো ধ্বংস হওয়া একটা বড় ক্ষতি। প্রায় ষাট বছরের পুরনো, বহু মানুষের সুখস্মৃতি জড়িয়ে থাকা এই বনবাংলোটি উত্তরবঙ্গের পর্যটনক্ষেত্রের এক বড় সম্পদ ছিল৷ তাই এই ক্ষতি অপূরণীয়। বনবাংলোটির পুনর্গঠন নিশ্চয়ই হবে। পুরনো ঐতিহ্য মেনে কাঠের বাংলোটির সেই পুরনো রূপটি ফিরিয়ে আনলেই ভাল।
অমলকুমার মজুমদার, শিবপুর, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy