Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Coromondel Express Accident

পদত্যাগ উঠে গেল?

শাস্ত্রীজি মনোবেদনা নিয়ে নেহরুর সিদ্ধান্ত মেনে নেন। এই ঘটনার তিন মাস পরে তামিলনাড়ুতে আবার একটি রেল-দুর্ঘটনা ঘটে।

দুর্ঘটনাস্থল।

দুর্ঘটনাস্থল। — নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২৩ ০৭:৩৫
Share: Save:

বালেশ্বরের বাহানাগা বাজার রেলপথের পাশে সাদা কাপড়ে ঢাকা সারি সারি মৃতদেহ— এই মর্মান্তিক দৃশ্য আমাদের নির্বাক করে দিয়েছে। কেন ঘটল এমন ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা? এত বড় দুর্ঘটনা, এত মানুষের মৃত্যু, অথচ নৈতিক দায় স্বীকার করে রেলমন্ত্রী কিংবা রেলের কোনও বড় কর্তা পদত্যাগ করেননি। অর্থাৎ, ঘটনার দায় কোনও মন্ত্রী বা আমলার নয়। ভারতের রেল কি মানুষের ব্যবস্থাপনায় চলে? না কি ঈশ্বরের ভরসায়?

১৯৫৬ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে মাহবুবনগরে এক রেল-দুর্ঘটনায় মারা যান ১১২ জন যাত্রী। তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এই দুর্ঘটনার দায় স্বীকার করে সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিস্মিত হয়ে বলেন— দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু পদত্যাগ করতে হবে কেন? তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। শাস্ত্রীজি মনোবেদনা নিয়ে নেহরুর সিদ্ধান্ত মেনে নেন। এই ঘটনার তিন মাস পরে তামিলনাড়ুতে আবার একটি রেল-দুর্ঘটনা ঘটে। এ বার মারা গেলেন ১৪৪ জন যাত্রী। বিবেকের দংশন থেকে ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে লালবাহাদুর শাস্ত্রী আবার পদত্যাগ করেন। এ বার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী নেহরু। কিন্তু সংসদে বিবৃতি দিয়ে নেহরু বলেছিলেন, “যদিও তিনি (লালবাহাদুর শাস্ত্রী) পদত্যাগ করেছেন, এবং আমরা তা গ্রহণ করেছি, এর মানে এই নয় যে মিস্টার শাস্ত্রী তাঁর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। পদত্যাগ পত্র এ কারণে গ্রহণ করা হয়েছে যাতে ভবিষ্যৎপ্রজন্ম জানতে ও শিখতে পারে, তিনি সংবিধান, গণতন্ত্র ও দায়িত্বের প্রতি কতটা সৎ এবং নিবেদিত ছিলেন।”

আমরা জানি, কিছু দিন আগে পর্তুগালে বেড়াতে গিয়ে এক অন্তঃসত্ত্বা ভারতীয় মহিলা মারা যান। ঘটনার দায় স্বীকার করে পর্তুগালের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মার্তা টেমিডো পদত্যাগ করেন। কেউ পদত্যাগ করলেই যে মৃত্যু বা দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে, এমনটা নয়। কিন্তু একটা ঘটনার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করলে মানুষের কাছে একটা নৈতিক বার্তা যায়। যে সরকারটি দেশ চালাচ্ছে, সেই সরকারটি গণতন্ত্র ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ— এই বার্তা। এ দেশ থেকে পদত্যাগ ব্যাপারটা কি উঠেই গেল? দেশটা যত বেশি পদলোলুপ নেতায় ভরে উঠবে, মানুষের জীবনের দাম তত সস্তা হয়ে যাবে।

মৃণাল মাইতিডিভিসি, বাঁকুড়া

ঝুঁকির যাত্রা

গত ২ জুন সন্ধ্যায় বালেশ্বর ও ভদ্রক স্টেশনের মাঝামাঝি বাহানাগা বাজার স্টেশনে ভয়াবহ রেল-দুর্ঘটনা হল। এই খবরের পাশাপাশি আরও একটি খবরও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে— পরের দিনই প্রধানমন্ত্রী গোয়াতে ‘বন্দে ভারত’-এর যাত্রার সূচনা করবেন। এই দুটো খবর অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল।

প্রায়ই শোনা যাচ্ছে দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে আধুনিক প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ, অধিকতর নিরাপদ, দ্রুতগতি সম্পন্ন ‘বন্দে ভারত’-এর যাত্রার শুভ সূচনা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এই নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উৎসাহ এখন তুঙ্গে। এই সব করতে গিয়ে বাকি চলমান ট্রেনগুলির সুবিধা-অসুবিধার দিকে রেল মন্ত্রকের কোনও খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। তাই তো এক্সপ্রেস ট্রেন লেট, এমনকি লোকাল ট্রেনের লেট হওয়াও অতীতের বহু রেকর্ড ভেঙে ফেলছে। তা ছাড়া, দূরপাল্লার এক্সপ্রেস বা সুপারফাস্ট ট্রেনগুলিতে সংরক্ষিত কামরায় আসন পাওয়া লটারির টিকিট জেতার সমগোত্রীয়। এর ফলে জেনারেল কম্পার্টমেন্ট যা ক্রমহ্রাসমাণ, সেগুলিতে তিল ধারণের জায়গা থাকে না।

এ বারের দুর্ঘটনায় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যে জেনারেল বগিতে সর্বাধিক মানুষ মারা গিয়েছেন, তা ছিল পুরনো বগি। আধুনিক প্রযুক্তি-পুষ্ট বগি হলে বহু মৃত্যুকে এড়ানো যেত বলে বিশেষজ্ঞদের মত। এ ছাড়া আরও একটি প্রশ্ন এখানে বিচার্য। ট্রেনের আয় ক্রমবর্ধমান। আয় আরও বাড়াতে সমস্ত বিরোধিতা উপেক্ষা করে একটার পর একটা বেসরকারিকরণ অব্যাহত। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রেলকর্মীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। অধিক থেকে অধিকতর মুনাফার লক্ষ্যে এটাই দস্তুর। এ ক্ষেত্রে খরচ কমিয়ে লাভের অঙ্ক বাড়াতে গিয়ে যাত্রী-নিরাপত্তা আরও শিথিল হতে বাধ্য।

রেল কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে এই দুর্ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু যে দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা রেল পরিচালিত হচ্ছে তাতে হাজার তদন্ত করেও এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব। তদন্তও হবে, আবার ‘তেজস’, ‘বন্দে ভারত’-দের আবির্ভাব ঘটবে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী। বিশেষ এক শ্রেণির ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে বিশাল সংখ্যক যাত্রীর নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ যাত্রার ন্যূনতম অধিকার।

গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

বাড়ুক নিরাপত্তা

করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় এতগুলি মানুষের মৃত্যু ভারতীয় রেলকে অনেক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। বর্তমানে রেল সফর করা কতটা নিরাপদ? প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে সিগন্যালিং সিস্টেম-এর ত্রুটির কারণে দ্রুতগামী এই ট্রেনটি মেন লাইনে যাওয়ার পরিবর্তে লুপ লাইনে ঘণ্টায় প্রায় ১৩০ কিলোমিটারের কাছাকাছি বেগে গিয়ে মালগাড়িতে ধাক্কা মারে। বিপুল খরচ করে আধুনিক প্রযুক্তির সিগন্যাল সিস্টেম বসানোর পরেও এই হাল কেন?

একটা ভুলের জন্য যেখানে এতগুলি প্রাণ ঝরে যায়, সেখানে এই ধরনের সিস্টেমের বিকল্প ভাবা আশু প্রয়োজন। কোটি কোটি টাকা খরচ করে অত্যাধুনিক লিঙ্ক হফম্যান বুশ প্রযুক্তির কোচ লাগানো হয়েছিল এই দ্রুতগামী ট্রেনটিতে, যাতে দুর্ঘটনা ঘটলে ট্রেনের কামরাগুলি একটির উপর আর একটি উঠে না যায় বা উল্টে না যায়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল প্রায় প্রতিটি কামরা উল্টে গিয়েছে এবং একটি কামরার উপর অন্য কামরা উঠে গেছে। তা হলে এই ধরনের প্রযুক্তির কামরার বাস্তবে প্রয়োজন আছে কি?

বন্দে ভারত ট্রেন চালু হয়েছে, ভাল কথা। কিন্তু রেল-যাত্রার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত না করে এত মহার্ঘ যাত্রা আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে না তো? অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম (কবচ) ব্যবস্থা অতি দ্রুত বাস্তবায়িত করা দরকার রেলপথগুলিতে। যেখানে যাত্রী-ভাড়া বাড়ছে বিপুল হারে, প্রবীণ যাত্রীদের টিকিটের উপর কোনও ছাড় দেওয়া হয় না, প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম বেড়েছে অনেক— সেখানে নিরাপদে রেল-যাত্রা করার দাবি সাধারণ মানুষ চাইতেই পারেন। সুতরাং, রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে ভবিষ্যতে কী ভাবে এই ধরনের ভয়ঙ্কর ট্রেন-দুর্ঘটনা আটকানো সম্ভব, তা ভারতীয় রেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের ভাবা উচিত।

সৌগত কাঞ্জিলাল, রামপুর, বাঁকুড়া

কেমন নিয়ন্ত্রণ

করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার ফলে বহু ট্রেন বাতিল হওয়ায় পরবর্তী কয়েক দিন দক্ষিণ ভারত যাওয়ার একমাত্র উপায় দাঁড়িয়েছিল উড়ান ধরা। মওকা বুঝে তার টিকিট আকাশ ছুঁয়েছে, সাত-আট হাজার টাকার টিকিট বেড়ে হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। সংস্থাগুলি ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকিয়ে সর্বনাশের প্রহরে পৌষের ফসল তুলতে চাইছে। দেশের এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সঙ্গে সহমর্মী হওয়ার দায় কি উড়ান সংস্থাগুলির নেই?

দুর্ঘটনার পরে বিমান সংস্থাগুলিকে ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে সতর্ক করেছিল সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিএ। তার পরও বিমানভাড়া লাফিয়ে সাত-আটগুণ বাড়ে কী করে? বিমান সংস্থাগুলি যে যার মতো যুক্তি সাজালেও ডিজিসিএ-র নির্দেশ অমান্য করে কোন সাহসে! স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যে নিয়মে ভাড়া ওঠানামা করে একই নিয়মে সঙ্কটকালেও তার অন্যথা হল না, এ কেমন প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ!

সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪

অন্য বিষয়গুলি:

Train accident Balasore Odisha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy