দেবলীনা হেমব্রম। —ফাইল চিত্র।
রাজ্য বিধানসভায় দলীয় সদস্যের সংখ্যা শূন্য। নির্বাচনে জনসমর্থনের অনুপাত ৫ শতাংশের আশেপাশে। রাস্তা তথা ময়দানের রাজনীতিতে মাঝে-মাঝে শোরগোল তোলার সামর্থ্য এখনও অন্তর্হিত হয়নি, কিন্তু প্রতিস্পর্ধী এবং সংগঠিত আন্দোলন ধরে রাখার শক্তি সীমিত। এমন একটি রাজনৈতিক দলের জেলা কমিটির শীর্ষ পদে কে আসীন হলেন, তা নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকের মাথা ঘামানোর বিশেষ কোনও কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও, সিপিআইএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক পদে দেবলীনা হেমব্রমের অধিষ্ঠিত হওয়ার সংবাদটি তাৎপর্যপূর্ণ। তাৎপর্যপূর্ণ কেবল তাঁর দলের এবং দলীয় রাজনীতির প্রসঙ্গেই নয়, এ-রাজ্যের বৃহত্তর সামাজিক বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতেও। যে অতীত এখন সিপিআইএমের প্রধান সম্বল, সেই অতীতের প্রেক্ষাপটেই উন্মোচিত হয় তাৎপর্যের প্রথম মাত্রাটি। দেবলীনা হেমব্রমের মনোনয়ন আক্ষরিক অর্থে ঐতিহাসিক, কারণ ১৯৬৪ সালের জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি দলের কোনও জেলা সম্পাদক হিসাবে কোনও মহিলার ঠাঁই হয়নি, তিনিই এমন পদে প্রথম নারী। ব্যক্তি হিসাবে তিনি অবশ্যই বিশেষ স্বীকৃতি দাবি করতে পারেন। একটি অনগ্রসর এবং ‘দূরবর্তী’ অঞ্চলের জনজাতি সমাজের মানুষ হিসাবে নিজের দীর্ঘ ও সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের জোরে তিনি এত দূর অগ্রসর হয়েছেন, এই নতুন ভূমিকাটি নিঃসন্দেহে তাঁর অর্জিত। যাকে ‘গ্লাস সিলিং’ বলা হয়ে থাকে, মেয়েদের উত্তরণের পথে সেই বাধা ভাঙার ‘রেকর্ড’ গড়েছেন তিনি। কেবল একটি দল নয়, তার ধারক বঙ্গসমাজও লিঙ্গবৈষম্য দূর করার পথে এক পা অগ্রসর হতে পেরেছে। দলীয় পরিচিতির বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ এই অর্জনের জন্য তাঁকে রাজ্যবাসী অবশ্যই অভিবাদন জানাবেন।
কিন্তু এমন এক রেকর্ডের জন্য সিপিআইএম নামক দলটিকে ছয় দশক পার করে দিতে হল কেন? প্রশ্ন তো কেবল জেলা কমিটি স্তরে পুরুষের নির্বিকল্প আধিপত্য নিয়ে নয়! এই দলের বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বে মহিলাদের ভূমিকা বরাবরই অত্যন্ত সীমিত, বহু ক্ষেত্রে কার্যত শূন্য। এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস বিশেষত অগৌরবের। বিভিন্ন সময়ে অতি অল্পসংখ্যক মহিলা দলের পরিসরে সামনের সারিতে এসেছেন বটে, কিন্তু তাঁদের ‘ব্যতিক্রমী’ অস্তিত্বই সর্বদা প্রকট থেকেছে। আজও, পশ্চিমবঙ্গের সমাজে এবং সামাজিক আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকা ও গুরুত্ব যখন চমকপ্রদ ভাবে বেড়েছে, তখনও সিপিআইএম-সহ বামপন্থী দলগুলির নেতৃত্বে যে দিকে দু’চোখ যায় ধু ধু করছে কেবল পুরুষ, পুরুষ এবং পুরুষ। এমনকি তরুণ প্রজন্মের যে মেয়েরা দলের রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রধান মুখ হয়ে উঠছেন, দলীয় নেতৃত্বের উপরমহলে তাঁদেরও নিতান্তই পুরুষ-নেতাদের সহযোগিনী এবং সহকর্মিণীর আসনে থাকতে হচ্ছে। প্রবীণ এবং পুরুষ দলনেতারা হয়তো মনে করেন যে তাঁরাই নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য, তরুণরা, বিশেষত তরুণীরা, আজও সেই সামর্থ্য অর্জন করেননি।
হয়তো বা তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে সমাজ সম্পর্কে একটি পুরনো ধারণা। সেই ধারণা বলে যে, সাধারণ মানুষ বামপন্থী দলের চালকের আসনে অভিজ্ঞ পুরুষকেই চান। এরই জন্য দেবলীনা হেমব্রম বিধায়ক হিসাবে, মন্ত্রী হিসাবে, এমনকি দলেরই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে (ব্যতিক্রমী) নেত্রী হিসাবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পরে তাঁকে জেলা কমিটির সম্পাদকের আসনে বসানোর কথা ভাবা যায়! সেই ভাবনার পিছনেও জনজাতি সমাজের এক নারীকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রগতিশীল মানসিকতার কতটুকু প্রভাব আছে আর জনজাতি গোষ্ঠীর ভোট এবং মেয়েদের ভোট টানার পাটিগণিত কতখানি কাজ করেছে, বলা শক্ত। এই কারণেই সংশয় হয়, শেষ অবধি দেবলীনা হেমব্রমের এই ঐতিহাসিক স্বীকৃতিও নিতান্তই ব্যতিক্রম, সিপিআইএমের সমাজভাবনা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy