পয়লা বৈশাখ প্রকাশিত ‘সে ভাষা ভুলিয়া গেছি’ (১৫-৪) অভীক মজুমদার-এর মেধাবী লেখা। আজকের গোলকায়নের আগেও বাঙালির গোলকায়ন ছিল সংস্কৃতি-চর্চায়। অনুবাদ আর রূপান্তরে নাটক, পত্রপত্রিকায় বিদেশি সাহিত্যের কথা, শীতকালে বিদেশি ক্রিকেট, নৃত্য, নাটক আসত। ‘বাংলিশ’ এত প্রবল ছিল না। যে সব বাড়িতে বাংলার ঐতিহ্যের সম্মান ছিল, সেখানে ইংরেজির সঙ্গে বাংলার কদর করা হত। স্টেটসম্যান, পরিচয়, দেশ বাড়িতে বাড়িতে আদৃত হত, কারণ তাদের বিষয় এবং ভাষা সুপাঠ্য বলে খ্যাত হয়েছিল। অভিভাবকরা ভাল ইংরেজি আর ভাল বাংলা শেখার কথা বলতেন। বলা হত, মাতৃভাষায় দখল থাকলে ইংরেজিতে দখল আসবে।
কিন্তু বাংলার মুখ পুড়তে দেরি হল না। ইংরেজি মাধ্যমের কাছে মলিন হল মাতৃভাষা। তারিখ, দরখাস্ত ইত্যাদি লেখায় বাংলা ভাষার ব্যবহার আজও খুব চালু হয়নি। বহু বছরের দাসত্ব জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করেছে, তা কি সহজে ভোলা সম্ভব?
নিত্যদিনের জীবনে স্থূলতা অধিকতর প্রতীয়মান আজ। কটু লাগে শুনতে, যখন সাধারণ মানুষের উদ্দেশে জননেতা যা বলেন তার মধ্যে কিছু তাঁর জানা ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে কথা বলেন। বাম-ডান সবার মুদ্রাদোষ ‘বাংলিশ’ বলা। তাঁদের ছেলেমেয়েরা মিশ্র ভাষায় কথা তো বলবেই। কিন্তু আবশ্যক না হলে মিশ্র ভাষায় কথা বলা সভ্য কথাবার্তার কিঞ্চিৎ অপমান বলে মনে করি।
স্পেনের যশস্বী লেখক রামোন গোমেস দে লা সের্না বলেছিলেন, “বাংলা ভাষা নানা বর্ণের পাখির কলকাকলি”। শুধু ধ্বনিমাধুর্যে তাঁর এমন উপলব্ধি হয়েছিল। আজ আমরা সেই ভাষাকে হিন্দি-ইংরেজির অনাবশ্যক অনুপ্রবেশে উৎকট করে তুলছি। শিক্ষিত মানুষ একটা গোটা বাংলা বাক্য বলছেন শুনলে খুব ভাল লাগে। যেমন অমর্ত্য সেনের কথা খুব শুনতে ইচ্ছে করে। কিন্তু-র বদলে বাট, কারণ-এর বদলে বিকজ়, কিছু বলতে সাম ইত্যাদি তিনি বলেন না।
তরুণ কুমার ঘটক
কলকাতা-৭৫
অনুকরণপ্রিয়
‘এই সময়ের শব্দতলায়’ (১০-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে বিশ্বজিৎ রায় বাঙালির নিজেদেরই তৈরি করা ভাষাসন্ত্রাস নিয়ে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তা মোটেই অমূলক নয়। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বাঙালি, বিশেষত আমরা শিক্ষিত বাঙালিরা বড় বেশি করে অনুকরণপ্রিয় হয়ে উঠেছি। ধনতেরাসে অলঙ্কার, বাসন, ঝাড়ু ইত্যাদি কিনতে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ি, তেমন নবরাত্রি পালন এবং সেই উপলক্ষে অস্ত্র নিয়ে মিছিল, ছট, গণেশ, হনুমান ইত্যাদি পুজো নিঃশব্দে প্রবেশ করেছে আমাদের মজ্জায়। আমরা ২৫ ডিসেম্বর নিয়ে যে মাতামাতি করি, তা উধাও হয়ে যায় ২৫ বৈশাখে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে বাংলা নববর্ষকে উপেক্ষা করলেও ভুলতে পারি না ইংরেজি নববর্ষকে।
এই ভাবে নিজস্বতা বিসর্জন দেওয়ার প্রভাব পড়েছে আমাদের ভাষাচর্চায়। সেই জন্যেই আমরা বাংলা কথার মধ্যে হিন্দি, ইংরেজি প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করে নিজেদের ভাষাকেই করে তুলেছি নিজেদের কাছে দুর্বোধ্য। মাসকয়েক আগে ফুটবল খেলার বাংলা ধারাবিবরণীতে ভাষ্যকার এক জায়গায় বলছিলেন, অনেক দিন কোনও প্লেয়ার অ্যাবসেন্ট থাকলে তাঁর পারফরম্যান্সে এফেক্ট পড়ে। কিন্তু তিনি যে পেডিগ্রির প্লেয়ার, তাতে তিনি ওভারকাম করবেন বলেই মনে হয়। অনেক বিশিষ্ট মানুষকেও দেখা যায় গণমাধ্যমে বাংলায় কথা বলার সময় বাট আর বিকজ় শব্দ দুটো বেশি ব্যবহার করছেন। এই ধরনের শব্দ গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার আগে খুবই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ এ ভাবে বলা মানে বাংলা ভাষাকে হত্যার শামিল। শুধু এক দিন মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন করলেই বাংলা ভাষার প্রতি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। রাজ্যে সরকারি কাজ যত দূর সম্ভব যেমন বাংলায় করা উচিত, তেমন বাংলা ভাষা প্রসারে উদ্যোগীদের উৎসাহিত করা উচিত রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে।
মনে রাখতে হবে, বাংলাতে যে ভাবেই কথা বলি না কেন, তার মধ্যে যেন কৃত্রিমতা না থাকে। এই ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয় ও উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে বর্তমান প্রজন্মকেই। দক্ষিণ ভারতকে অনুসরণ করে প্রতিবাদে শামিল হতে হবে জোর করে হিন্দি চাপানোর বিরুদ্ধে। এগুলো না করতে পারলে আমরা হয়তো এক দিন নিজভূমেই পরবাসী হয়ে যাব।
অশোক দাশ
রিষড়া, হুগলি
বেনোজল
‘এই সময়ের শব্দতলায়’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। খুব সুন্দর ভাবে লেখক প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন বলার বাংলা কেবল মানুষের মুখে ভর করেই ছোটে না, তা টিভি-রেডিয়োর মাধ্যমে কানে যায়। সত্যি এটা খুবই পরিতাপের বিষয় যে, বাংলা ভাষার সঙ্গে হিন্দি আর ইংরেজি ভাষার অহেতুক মিশেল ঘটিয়ে অ-সরকারি রেডিয়ো চ্যানেলের উপস্থাপকরা কথার তুবড়ি ছুটিয়ে দেওয়াটাকে রপ্ত করেছেন। এতে অবাধে বেনোজল ঢুকে বাংলা ভাষাকে কার্যত পঙ্গু করে তুলছে।
বাংলা নাটক কিন্তু আগাগোড়া কথ্য বাংলা ভাষার বিভিন্ন শ্রেণি আর সম্প্রদায়ের ভাষাকে যথোচিত মর্যাদা দিয়ে এসেছে। মধুসূদন দত্তের হানিফ গাজী নিজের স্ত্রী ফতেমা বিবির সম্ভ্রম রক্ষার জন্য যে কথ্য ভাষার ব্যবহার করেছেন, ধর্ষণকামী ভক্তপ্রসাদ কিন্তু সে ভাষায় কথা বলেনি। ঠিক তেমনই দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের তোরাপ যে ভাষায় কথা বলেছে, সাধুচরণ সে ভাষায় বলেনি। আধুনিক যুগে নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর লেখায় যে ভাষায় তাঁর চরিত্রদের দিয়ে কথা বলিয়েছেন, সে ভাষা আরোপিত শালীনতার তোয়াক্কা করেনি।
কিন্তু দেখা গেল এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। স্বঘোষিত এক ছাত্রনেতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সম্প্রতি কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছে। সে জানিয়েছে, নবারুণ ভট্টাচার্যের ভাষা ব্যবহারের রীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে এমন কাজ করেছে। আমরা সত্যিই লেখকের বক্তব্য থেকে এই উপলব্ধি করতে পারছি যে, বাংলা ভাষাকে গ্রাম, মফস্সল, শহরের অলিগলির ভাষা না করে তুলতে পারলে, কৃত্রিম ভাবে তাকে প্রয়োগের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারলে বাঙালিকে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হবে।
স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা
ঝকঝকে বাংলা
আজকাল নানান লেখায়, সেমিনারের আলোচনায়, বিদগ্ধ বাঙালির কথোপকথনে একটা বিষয় খুব চর্চিত— বাংলা ভাষার অবনমন। একটা কথা যেন আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, বাংলা ভাষা যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। কিসের যুদ্ধ?
আজকালকার তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলে দেখেছি, তারা এই সব আলোচনার অর্থ খুঁজে পায় না। যাঁরা বাংলা বলার সময় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার নিয়ে মশকরা করেন, তাঁরাও সকালে উঠে এক ‘পেয়ালা’ চা খান? বাস-কে ‘শকট’ বলেন? আসলে আমরা মূল বিষয়টা ছেড়ে আগডুম-বাগডুম ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। যেটা দরকার সেটা হল, আরও অনুবাদের কাজকর্ম। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সেটা খুব বেশি করে দরকার। আর ঠিক এইখানেই বাঙালি ধারাবাহিক ভাবে ভুল করে যাচ্ছে। সার্ত্র-দেরিদাতে বাঙালির উচ্চমেধারা যা সময় নষ্ট করেছে বা এখনও করে, তার চেয়ে যন্ত্রপাতির গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে বেশি মাথা ঘামালে বাঙালিকে এই সব অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করতে হত না। সব কিছুরই প্রয়োজন আছে। কিন্তু কোনটা কতটা প্রয়োজন সেটা জানা দরকার।
এখনকার স্মার্ট ছেলেমেয়েদের মাথার মধ্যে এ সব ভাষাগত বিষয়ের কূটকচালি না ঢোকালেই ভাল। বাংলা ভাষার কোনও অবনতি হয়নি, শুধু বাঁক নিয়েছে। ভাষার চলমানতা এবং আধুনিকতার মধ্যেকার প্রভেদ নিয়ে চর্চা নিশ্চয়ই হবে। তবে এখনকার ঝকঝকে ছেলেমেয়েরা সঠিক ব্যবহারে বাংলা ভাষাকে আরও ঝকঝকে বানিয়ে দেবে। আর সেটা বাংলা ভাষার পক্ষে মঙ্গল।
অশোক বসু
বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy