অনলাইনেই চলছে গিটারের ক্লাস।
নয় নয় করে দেড়মাস কেটে গেল গৃহবন্দি হয়ে। হাডসনের ওপারে নিউইয়র্ক শহর করোনাভাইরাসের এপিসেন্টার। দেশে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে আমার স্টেট নিউ জার্সি। এমনটাই হবার কথা ছিল। নিউ জার্সিকে আদর করে বলা হয় নিউইয়র্ক শহরের রাতের বিছানা। দিনে প্রায় সাত লক্ষ মানুষ রুজি-রুটির জন্যে নিউইয়র্ক শহরে যাতায়াত করেন। তার মধ্যে শুধু নিউ জার্সি ট্রানজিট-এর নিউইয়র্কগামী বাস আর ট্রেনে চাপেন প্রায় পাঁচ লক্ষ লোক। কাজেই সংক্রমণ ছড়াতে দেরি হয়নি। বিশেষ করে নিউ জার্সির উত্তর আর পূর্বাঞ্চলে ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ এই দু’টি অঞ্চল নিউইয়র্ক শহরের খুব কাছে। বের্গেন, এসেক্স-এর মতো কাউন্টিতে সংক্রমণ আর মৃত্যুর হার নিউ জার্সির মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
মার্চের মাঝামাঝি থেকেই নিউ জার্সিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হল। আর সেই সঙ্গে রাতের বেলায় কারফিউ। দিনে খুব দরকার না হলে বেরনো বারণ। নিউইয়র্কগামী বাস ও ট্রেন সার্ভিস বন্ধ। মার্চের শেষাশেষি নিউইয়র্ক শহরের সবকটি সীমানা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হল। শুরু হল এক সর্বগ্রাসী লকডাউন।
করোনা-ঝড়ে পরিবারের সবাই বাড়িবন্দি। তার ফলে মা-বাবার এখন চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটি। নিজেদের বাড়ি থেকেই ভার্চুয়াল অফিস চলছে। সারাদিন মিটিং, ভিডিয়ো কনফারেন্স। আর বাচ্চাদের ক্যালেন্ডার তো বাবা-মায়ের থেকেও বেশি ব্যস্ত। স্কুলের পড়াশোনা এবং অন্য আরও নানা বিদ্যা, যা এতদিন নানা জায়গায় হাজির হয়ে শেখা হচ্ছিল এবং বাবা-মা পালা করে শোফারের কর্তব্য পালন করছিলেন— সবই নিমেষে হয়ে গেল ভার্চুয়াল। চেঞ্জ ম্যানেজমেন্টের সুযোগ না দিয়েই করোনা-কালে সব স্কুল-কলেজ হুড়মুড় করে বাড়িতে এসে গেল। স্কুল ডিস্ট্রিক্টগুলি গুগল-ক্লাসরুম বা ‘classdojo’ মতো যে কোনও একটি আন্তর্জালিক ক্লাসরুম বেছে নিল। শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী সবাই প্রথম প্রথম একটু হোঁচট খেলেও পরে সামলে নিল। ভার্চুয়াল পড়াশোনা তার সমস্ত সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে সর্বস্তরে চালু রইল।
সত্যিকারের ইনোভেশন কিন্তু দেখা গেল অন্যান্য বিদ্যাশিক্ষায়। যেমন ধরা যাক ক্যারাটে। ছাত্র-শিক্ষক বাড়িবন্দি হলেও ক্যারাটে ক্লাস কিন্তু পূর্ণোদ্যমে চালু আছে। সামনে ল্যাপটপে ক্যারাটে-গুরু শিক্ষা দিচ্ছেন। ভবিষ্যতের ব্ল্যাকবেল্ট তা দেখে দেখে হাত-পা চালাচ্ছে— ফুট সুইপ, নি স্ট্রাইক, ফ্রন্ট কিক। ভার্চুয়াল কারাটে ক্লাস মোটেই খারাপ হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: এ বছর দেশের আর্থিক বৃদ্ধি হবে ০%, আরও ভয়াবহ পূর্বাভাস মুডিজ-এর
গানের ক্লাস এখন স্টেট অফ দ্য আর্ট। ওস্তাদজির সামনে খান চারেক ল্যাপটপ বা আইপ্যাড। প্রতিটায় আবার চারটি করে খোপ। এক এক খোপে এক এক সঙ্গীতপিপাসু শিক্ষার্থী। ১৬ জনের ক্লাস, ভার্চুয়াল সঙ্গীতশিক্ষা চলছে। ইচ্ছে করলে অন্যেরাও লগ-ইন করে শুনতে পারেন। নাচের ক্লাসও কম যায় না। জুম্ বা স্কাইপে নাচের প্রশিক্ষণ এখন জলভাত।
তবে সব ইনোভেশনকে দশ গোল দিল আমার পাড়া পারসিপেনির সকার ক্লাব। ভ্রাতৃপ্রতিম এক বন্ধুর পুত্র সকার ভক্ত। পারসিপেনির ক্লাবেই শেখে। কথায় কথায় বন্ধু জানাল যে, সকার ক্লাস হচ্ছে গুগল ক্লাসরুমে। জানতে পারলাম, বল নিয়ে প্র্যাক্টিস হয় বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে। কোচ ভিডিওতে অ্যাসাইনমেন্ট পাঠিয়ে দেন। পুত্র সেটি ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে প্র্যাক্টিস করে। তারপর পিতা ফাইনাল আউটপুট ভিডিও করে কোচের কাছে পাঠিয়ে দেন।
আরও পড়ুন: ১০০ মাইল হাঁটার ক্লান্তিতেই কালঘুম, রেললাইনে পড়ে রইল বাসি রুটির টুকরো
নিউ জার্সি আর নিউইয়র্ক— দু’টো রাজ্যেরই শাসক বা গভর্নর রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাট।ওয়াশিংটনের রিপাবলিকান শাসকের সঙ্গে করোনাভাইরাস নিয়ে তাঁদের তরজা আর চাপানউতোর এখন নিউ জার্সিবাসীর গা-সওয়া। তারা ভার্চুয়াল জীবনযাপন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়। ইউরোপ আস্তে আস্তে নিয়ম শিথিল করা শুরু করেছে। তবে সঙ্গত কারণেই দুই রাজ্যের দুই ডেমোক্র্যাট গভর্নর লকডাউন তুলতে তাড়াহুড়ো করার বিপক্ষে। এই লেখার সময় উত্তর আমেরিকার সংক্রমণ-সংখ্যা দ্রুত এক মিলিয়নের দিকে এগোচ্ছে। মৃত্যু ৬০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে নিউ জার্সিতে এক লক্ষেরও বেশি মানুষ সংক্রামিত। ছ'হাজার মানুষ মারা গিয়েছেন। এর মধ্যে একটাই ভাল খবর, নিউ জার্সি আর নিউইয়র্কে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা সামান্য হলেও আগের থেকে কম। হয়তো আমরা করোনার চূড়া পার হয়ে এসেছি।নিউ জার্সির গভর্নর ছ-দফা পরিকল্পনা পেশ করেছেন। ঝড় থামলে কি করে ধাপে ধাপে দরজা খুলবে, সাধারণ মানুষ ফিরবে তাদের জীবন আর জীবিকায়— তারই একটা রূপরেখা। যদিও কবে সে পরিকল্পনা বাস্তবে কার্যকরী হূবে, তার কোনও সময় তিনি দেননি। শুধু একটু আশার আলো ছুঁইয়ে রেখেছেন— দেখা যাক, মেমোরিয়াল ডে মানে পঁচিশে মে নাগাদ যদি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যায়। নিউইয়র্ক-নিউ জার্সির সব চাষা এখন সেই আশাতেই বেঁচে আছে।
সংগ্রামী লাহিড়ী
নিউ জার্সি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy