জনশূন্য রাস্তাঘাট।
আমার জন্ম, বড় হওয়া কলকাতাতে। স্বামী ও নিজের কর্মসূত্রে বিগত চার বছর আমরা ক্যালিফোর্নিয়ার বে-এলাকার বাসিন্দা। মার্কিন মুলুকের ৫০টি রাজ্য করোনাভাইরাসের কবলে। তাতে প্রকৃতপক্ষেই আমেরিকা আজ সর্বশ্রেষ্ঠ।এই মুহূর্তে মার্কিন মুলুকে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ৩ লক্ষ ১১ হাজার ৭৫৭। গতকালের থেকে প্রায় ৩৫ হাজার বেশি। ক্যালিফোর্নিয়ার বে-এলাকায় যেখানে আমরা থাকি, শুধুমাত্র এখানেই প্রায় ১৪ হাজার মানুষ সংক্রমিত। ক্যালিফোর্নিয়ায় আইনত ভাবে গত ১৬ মার্চ থেকে ‘‘শেল্টার ইন প্লেস’’ বা লক ডাউন চলছে, চলবে আগামী ৩ মে পর্যন্ত। যদিও বেসরকারি ভাবে আজ এক মাস হলো আমরা ঘরবন্দি। বাড়ি থেকেই কাজ অফিসের কাজ করে চলেছি।
করোনা শুধুমাত্র ষাটোর্ধ্ব মানুষের বেশি ক্ষতি করছে এটা আজকের দিনে হয়ত সঠিক নয়। এখানে সব বয়েসের মানুষ অসুস্থ হচ্ছেন, আর অনেকে মারা যাচ্ছেন। যদিও এখনও আমেরিকার কিছু রাজ্য আছে যেমন, আরকানসাস, আইওয়া, নেব্রাস্কা, নর্থ-ডাকোটা ও সাউথ-ডাকোটা, যেখানে এখনও সরকারি নিয়মে লকডাউন শুরু হয়নি। অর্থাৎ আমাদের মতো বহু মানুষ আলাদা থেকে, করোনার প্রকোপ কম করার চেষ্টা করলেও, কিছু মানুষের ভুল সিদ্ধান্তের ক্ষতিপূরণ হয়ত সকলকেই দিতে হবে।
শুনতে হাস্যকর লাগলেও, সরকারি ভাবে, আমেরিকাতে এই ‘লক ডাউন’ বা ‘হাউস অ্যারেস্ট’ শব্দ গুলো ব্যবহৃত হয় না। কারণ মার্কিন নাগরিকরা নিজেদের নাগরিক অধিকার নিয়ে খুব সচেতন। আর এই ধরনের শব্দ নাকি তাদের অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে! তাই লক ডাউন বোঝানোর জন্য, বিভিন্ন নতুন নতুন শব্দ শুনতে পাচ্ছি। যেমন ক্যালোফোর্নিয়া ও অন্যান্য রাজ্যে এটাকে বলা হচ্ছে ‘‘শেল্টার ইন প্লেস’’, নিউয়র্ক আগে বলা হচ্ছিল ‘‘ফুল ওয়ার্কফোর্স রিডাকশন’’, এখন বলা হচ্ছে ‘‘NYS অন পজ’’।
আরও পড়ুন: ফুটপাতেও করোনা হানা, কলকাতায় গোষ্ঠী সংক্রমণের প্রাথমিক ইঙ্গিত?
ভারতে এখনও প্রয়োজনে সরকারি চিকিৎসা পাওয়া যায়, কিন্তু মার্কিন মুলুকে ছবিটা অনেকটা আলাদা। আমেরিকায় চিকিৎসার খরচ অনেক। আমরা যাঁরা স্থায়ী চাকরি করি, তাঁদের স্বাস্থ্যবিমার খরচ কোম্পানিই বহন করে। কিন্তু অসংখ্য মানুষ আছেন যাঁদের সেই সৌভাগ্য নেই। সরকারি হিসাবে, গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৬ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছেন এখানে। এতদিন পর্যন্ত মার্কিন সরকার শুধুমাত্র করোনাভাইরাস পরিক্ষার খরচ বহন করছিল। গত ৩ এপ্রিল জানানো হয়েছে, এখন থেকে যাঁদের ইন্সুরেন্স নেই, তাঁদের চিকিৎসার খরচ, সরকার পরিশোধ করবে।
টেস্টকিট, মাস্ক এবং PPE অর্থাৎ ‘পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট’ এখানে এতটাই কম যে কিছুদিন আগে নিউয়র্কের গভর্নের বলেছেন যে এখন শুধু উপসর্গ থাকলেই আর টেস্ট করা হবে না। যাঁরা হসপিটালে ভর্তি, যাঁরা হসপিটালে কাজ করছেন, যাঁদের বয়েস ৬০ বছরের বেশি, একমাত্র তাঁরাই টেস্ট করাতে পারবেন, বাকিরা নয়। এই একই কথা CDC থেকেও বলছে। এর মানে, আমাদের আশেপাশে কেউ যদি করোনায় আক্রান্ত হন। তাঁরা সেটা জানতেও পারবেন না, আমরাও জানতে পারব না। এই সবের মধ্যে, যদিও একটা ভাল খবর আছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যেমন সেফায়েড, রস, এখন টেস্ট কিট বানানোর জন্য FDA অনুমোদন পাচ্ছে। তাই আগামী দিনে ছবিটা কিছুটা অন্য রকম হতে পারে।
আরও পড়ুন: করোনার ধাক্কা কর্মক্ষেত্রে, লকডাউনের জেরে বেকারত্বের হার বাড়ল ২৩ শতাংশ
সচেতনতার অভাব দেশে ও মার্কিন মুলুকে একইরকম। পশ্চিমঙ্গে যে রকম, লক ডাউনের মধ্যেও লোকজন পাড়ার দোকানে এখনও চা খেতে যাচ্ছেন, গ্রামের দিকে ছেলে-ছোকরার দল পুকুরে মাছ ধরছে, তাস খেলছে, এখানেও লোকজন এখনও পার্টি করছেন, বাস্কেটবল খেলছেন, ধমীয় সমাবেশে যাচ্ছেন। এখানে এরকম অনেকেই আছেন যাঁরা সচেতন কিন্তু চার দেওয়ালের মধ্যে হাঁফিয়ে উঠে পার্কে খোলা হাওয়ায় দৌড়োচ্ছেন, পাহাড়ের ট্রেইলে হাঁটতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে একই কাজ করছেন। এই মুহূর্তে খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়াটা বিলাসিতা হতে পারে কিন্তু অপরিহার্য নয়। আজ আমরা বাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকতে পারছি কারণ এই দুর্দিনেও কিছু মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তাঁদের ইচ্ছা থাকলেও বাড়িতে থাকার উপায় নেই, তাঁদের কাছে বাড়িতে থাকাটা বিলাসিতা মাত্র।
প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমরা কত ভাল আছি, কত সুবিধা পাচ্ছি। আমাদের বাড়ি থেকে কাজ করার সুবিধা আছে, মাথার উপর ছাদ আছে, ২৪ ঘন্টা কলে জল আছে, ভালো স্বাস্থ্যবিমা আছে। এখন যখনই বাইরে বেরোচ্ছি মাস্ক পড়রছি। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না করে ভিডিয়ো কলে করতে করতে ডিনার করছি। এখানে ‘‘শেল্টার ইন প্লেস’’ কতদিন চলবে সত্যি জানা নেই। প্রয়োজনীয় দোকানপাট যদিও খোলা রয়েছে, ডেলিভারি সার্ভিস চলছে, সাপ্লাই চেন চালু রয়েছে, তা-ও অনেকে ‘প্যানিক-বাই’ করছেন। ভয় পেয়ে আমেরিকায় লোকজন প্রথমে টয়লেট পেপার আর কোল্ড ড্রিংকসের বোতল কিনছিলেন। কিন্তু এখন দৈনন্দিন ব্যবহারের অনেক জিনিসও পাওয়া যাচ্ছে না। জরুরি অবস্থার কথা চিন্তা করে, আমরা চাল, ডাল আর প্যাকেটে ভরা আলু ভাজা কিনে রেখেছি। কালকের ভোর আমাদের জন্য কি নিয়ে আসবে জানি না। আমরা বাড়িতে থাকছি, দেশের কথা চিন্তা করে, বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করে প্রতিমুহূর্তে বুক কাঁপছে। আশা একটাই যে আমরা এই দুর্জয়কে একদিন ঠিক জয় করবো।
প্রিয়ঙ্কা দে
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy