স্তব্ধ আইওয়া।
আইওয়া সিটি উত্তর আমেরিকার একটি ছোট শহর। অবশ্য নিউ ইয়র্ক বা শিকাগোর মত বড় শহর না হলেও অনেক বাঙালির কাছেই আইওয়া সিটি পরিচিত নাম। তার কারণ এখানকার ‘ইউনিভার্সিটি অব লোওয়া’-র বিখ্যাত ‘জাতীয় লেখা প্রতিযোগিতা’, যেখানে ফি বছর সারা বিশ্বের নির্বাচিত কিছু সাহিত্যিক অংশ নেন। বাংলার বহু প্রথিতযশা সাহিত্যিক – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে শঙ্খ ঘোষ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীজাত এবং আরও অনেকে এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। এখানে বসেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’ আর শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন ‘আইওয়া ডায়েরি’ কিম্বা ‘ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম’।
মূলতঃ আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই শহরে আমি গত চার বছর সপরিবারে আছি, পেশায় পোস্ট-ডক্টরেট গবেষক। ছোট্ট নিরিবিলি শহর আর মাঝখান দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে আইওয়া নদী – ছবির মত সাজানো এই শহরে হঠাৎ ছন্দপতন মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ। সারা পৃথিবী ততদিনে জেনে গেছে মারণ করোনা ভাইরাসের কথা। মার্চ মাসের ৮ তারিখে জানা গেল করোনা থাবা বসিয়েছে আইওয়াতেও।
প্রথম প্রথম দিনে ২-৩ জন করে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা জানা যেতে থাকলেও সংখ্যাটা দ্রুতই বাড়তে থাকল। প্রথমেই বন্ধ হয়ে গেল শহরের সমস্ত স্কুল। তারপর ইউনিভার্সিটির সমস্ত ক্লাস অনলাইন করে দেওয়া হল। সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের বলা হল একান্ত নিরুপায় না হলে হস্টেল ছেড়ে চলে যেতে। বন্ধ হয়ে গেল সমস্ত লাইব্রেরী, জিম। একের পর এক অনুষ্ঠান হয় বাতিল হয়ে গেল (আইওয়ার বিখ্যাত ‘টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল’ যেটা প্রতিবছর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হয়, বাতিল হয়ে গেছে সেটাও) অথবা যতদূর সম্ভব অনলাইনের মাধ্যমে কাজ চলতে থাকল। আমাদের কাজ যেহেতু ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি-নির্ভর তাই আমরা এখনও প্রতিদিন কাজে আসছি। শুধু চেষ্টা করছি যথাসম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে।
আরও পড়ুন: শুধু লাশ গোনা চলছে, নিউইয়র্ক সিটি যেন মৃত্যুপুরী
এরই মধ্যে ইউনিভার্সিটি থেকে আসতে লাগল একের পর এক ইমেল। জানানো হল কিভাবে অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস করতে হবে বা জরুরী কাজ সারতে হবে। জানানো হল, এই সময় বিদেশ থেকে পড়তে বা গবেষণা করতে আসা ছাত্রছাত্রীরা যাতে খুব জরুরী কারণ ছাড়া দেশের বাইরে না যায়। অনেক দেশ থেকে এই দেশে ঢোকার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হল। ক্রমশঃ বদলাতে লাগল ইমেলের সুর। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহেই জানানো হল, এখানকার ইউনিভার্সিটি হসপিটালে (যেটা আইওয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও উন্নত) এন-৯৫ মাস্ক অপ্রতুল, তাই সমস্ত ল্যাবে আবেদন করা হল যাদের কাছে বাড়তি এন-৯৫ মাস্ক আছে, সেগুলো হসপিটালে দিয়ে দিতে। করোনা-পরীক্ষার প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রীও অপর্যাপ্ত, তাই চাওয়া হল সেগুলোও।
এখানেই শেষ নয়, চাওয়া হল স্বেচ্ছাসেবকও। কারণ একসাথে অনেক লোক আক্রান্ত হলে তাদের চিকিৎসা করার জন্য যথেষ্ট চিকিৎসাকর্মী নেই! জানিয়ে দেওয়া হল, এখন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সমস্ত অপারেশন, যেখানে প্রাণসংশয় নেই, সেগুলো বাতিল! ছোটখাট শারীরিক অসুবিধাতেও হসপিটালে না আসার আবেদন। কেন? কারণ, পুরো হসপিটাল, তার প্রায় সমস্ত মানবসম্পদ এবং পরিকাঠামোকে প্রস্তুত রাখছে শুধু এই আসন্ন বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে! কবিতার শহর, সাহিত্যের শহর লিখতে শুরু করল করোনা-বধের আখ্যান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি স্টেটের মধ্যে হাতে গোনা চার-পাঁচটা ষ্টেটে এখনও সরকারিভাবে ‘লকডাউন’ (এখানে এটাকে বলা হয় ‘স্টে অ্যাট হোম’) ঘোষিত হয়নি। আইওয়া তেমনই একটি স্টেট। এখানকার গভর্নর প্রতিদিন সাংবাদিক বৈঠক করে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাচ্ছেন, কিন্তু সরকারিভাবে লকডাউন ঘোষণা না করার ব্যাপারে তিনি অনড়, এখনও পর্যন্ত। এদিকে এই মুহূর্তে (১১ই এপ্রিল) আইওয়াতে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা ১৫১০, মারা গেছেন ৩৪ জন। সংখ্যার হিসেবে নিউ ইয়র্ক বা ক্যালিফোর্নিয়ার চেয়ে ভাল ঠিকই, কিন্তু প্রতিদিনই নতুন করে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন – অর্থাৎ ‘গ্রাফ’ এখনও ঊর্ধ্বমুখী!
আরও পড়ুন: আমাদের বাড়িতে ফেরান, না হলে মরেই যাব!
সরকারিভাবে ‘লকডাউন’ ঘোষণা না করে নাগরিকদের বলা হয়েছে যতদূর সম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং জরুরী কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে না বেরতে। রাস্তাঘাট একেবারে শুনশান। অদৃশ্য ভাইরাস ঘরবন্দি করে ফেলেছে আট থেকে আশি সবাইকেই। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে রেস্তোরাঁ, পানশালা, শপিং মল এবং ছোট বড় আরও অজস্র দোকান। এখানকার একমাত্র ‘ইন্ডিয়ান স্টোর’টিও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। খোলা আছে বড় বড় ‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’, যদিও সেখানে যাতায়াত অবাধ নয়। অর্থাৎ, একসঙ্গে খুব বেশি লোককে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রথমের দিকে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে প্রচুর জিনিস একসাথে কিনে ফেলায় অনেক কিছুই (যেমন চাল, চিনি, নুন, ডিম, রান্নার তেল, মাংস, সাবান, টিস্যু পেপার, স্যানিটাইজার ইত্যাদি) বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছিল। এখন অবশ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মোটের ওপর সবই পাওয়া যাচ্ছে।
এত দূরে বসে চিন্তা হচ্ছে আমার দেশের জন্য। আমার প্রিয় শহর কলকাতার জন্য। এবিপি আনন্দের লাইভ সম্প্রচারে দেখছি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা। প্রতিদিন সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। শুধু তো আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে না, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ! এই লকডাউন যত দীর্ঘ হবে, তত সমস্যায় পড়বে দিন-আনি-দিন-খাই মানুষ, ভেঙ্গে পড়বে দেশের তথা পৃথিবীর অর্থনীতি! অথচ লকডাউন ছাড়াও যে গতি নেই! লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুমিছিল ঠেকাতে আর তো অন্য পথ নেই! সারা পৃথিবীতেই বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরি করতে (এখানকার একাধিক গবেষকও তার মধ্যে আছে); কিন্তু নিজে একজন জীববিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে বেশ বুঝতে পারি, কাজটা কতটা কঠিন! বিশেষত এই কারণে যে এই ভয়ঙ্কর ভাইরাসটি অনবরত বদলে ফেলছে নিজের গঠনশৈলী! তাই এ যেন সেই পুরাণের মহিষাসুর! যে বারবার অবতীর্ণ হচ্ছে নতুন নতুন রুপে আর আমাদেরও বার বার বদলাতে হচ্ছে রণকৌশল।
মাঝে মাঝে মনে হয় দুঃস্বপ্ন দেখছি। হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে জানতে পারব, করোনা ভাইরাস বলে আর কিচ্ছু নেই! জানি বাস্তবে হঠাৎ কিছুই বদলাবে না, কিন্তু বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টা, সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপ আর আমাদের মানে জনসাধারণের সচেতনতা আর সাবধানতা অবলম্বনের মাধ্যমেই আমরা এই লড়াই জিতব। সবশেষে, আমার দেশের মানুষকে বলতে চাই, প্রথম বিশ্বের এই ‘তথাকথিত’ অসীম ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকাও কিন্তু আজকে বিপর্যস্ত (এখনো পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ, মৃত কুড়ি হাজারের কিছু বেশি)। মৃত্যুর সংখ্যায় সবার আগে, আজকেই ছাড়িয়ে গেছে ইতালিকে। কাজেই বুঝতেই পারছেন, ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশের সরকার বা চিকিৎসক – চিকিৎসাকর্মীদের কাজটা কতটা দুরূহ। দয়া করে তাদের সাথে সহযোগিতা করুন আর মেনে চলুন সবরকম সতর্কতা।
মনে বিশ্বাস রাখুন, আবার নিজের ছন্দে ফিরবে আমার প্রিয় শহর কলকাতা। আবার প্রাণ ফিরে পাবে এই ছোট্ট আইওয়া সিটি। উই শ্যাল ওভারকাম।
শ্রীজিৎ দাশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy